গত শতাব্দীর ৭০'র দশকের শেষ দিকে চীন সংস্কার আর মুক্তদ্বার নীতি চালু করে। তখন থেকে চীনের বৈদেশিক বেতারও এক উন্মুক্ত ও উদার পথে চলেছে এবং তার প্রভাবও দিনে দিনে সম্প্রসারিত হয়েছে। জার্মানীর "রেডিও কুরিয়ার" পত্রিকা সি আর আই এর জার্মান ভাষার অনুষ্ঠানের পরিবর্তনকে সুদূর চীন থেকে আসা টাটকা বাতাস বলে এবং সি আর আইকে জনপ্রিয় বেতার হিসেবে অভিহিত করে। উত্তর আমেরিকান রেডিও ক্লাব সি আর আইকে বিশ্বের বৃহত্তম বেতার হিসেবে নির্বাচন করেছে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চীনের বিকাশ সম্বন্ধে জানার আগ্রহ বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সি আর আই এর অনুষ্ঠানের বিষয়বস্তু এবং পদ্ধতির পরিবর্তনও শুরু হয়েছে। চীনের শ্রেষ্ঠ বার্তা সম্পাদক পুরস্কার বিজয়ী সি আর আই এর সিনিয়ার সম্পাদক মিঃ ওয়াং জো চৌ স্মরণ করে বলেছেন, এখন আমাদের বেতারের অনুষ্ঠান একঘেঁয়েমি থেকে মুক্ত হয়ে বৈচিত্র্যময় হয়েছে। অনুষ্ঠানগুলো অসাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্বের কাছে এক সত্য ও উন্নয়নশীল চীনকে উপস্থাপন করেছে।
ওয়াং জো চৌ গত শতাব্দীর ৬০'র দশকের প্রথম দিকে সি আর আইতে যোগ দেন। এখন প্রায় ৭০ বছর বয়স্ক মিঃ ওয়াং সি আর আইয়ের বিদেশে পাঠানো প্রথম ব্যাচের সংবাদদাতাদের একজন। বিশাধিক বছর আগেকার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, "সংবাদ স্টেশন প্রতিষ্ঠার প্রথম দিন থেকে আমরা নানা কঠিন অবস্থা অতিক্রম করে শ্রমসাধ্যভাবে কাজ শুরু করি । এর বহু উদাহরণ আছে, যেমন জেনিভায় আফগান শান্তি চুক্তি স্বাক্ষরের বিশ মিনিট পর আমাদের খবর প্রচারিত হয়েছে। "
১৯৮০ সাল থেকে চীন আন্তর্জাতিক বেতার পর পর বিদেশে সংবাদ স্টেশন প্রতিষ্ঠা করেছে। সি আর আই প্রথমে জাপানের টোকিও এবং জুগোস্লাভিয়ার বেলগ্রেদে সংবাদ স্টেশন খুলেছে। বিদেশে আমাদের বহু সংবাদদাতাদের মধ্যে লিউ সু ইয়ু হচ্ছেন সবচেয়ে সম্মানজনক নারী সংবাদদাতাদের অন্যতম। কারণ জেরুজালেমের বিস্ফোরণ সম্বন্ধে তিনি বিপুল পরিমাণ খবরাখবর পাঠিয়েছেন। দেশে ফিরে আসার পর তিনি বলেছেন, "২০০০ সালের অক্টোবরে ফিলিস্তিন আর ইস্রাইলের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটার সময় লড়াই গাজা অঞ্চলে কেন্দ্রীভুত ছিলো। আমরা একটি জাতীয় পতাকা নিয়ে গাজায় গিয়েছিলাম। সেখানে আমি স্বচক্ষে একজন ফিলিস্তিনী গুলি বিদ্ধ হয়ে মারা যাওয়ার দৃশ্য দেখেছি, তখনও তাঁর গা থেকে রক্ত ঝরছিল। সেই লোক আমার থেকে মাত্র কয়েক মিটার দূরে , হঠাত্ আমি উপলব্ধি করেছি যে, জীবন আর মৃত্যু আমার এতো কাছে। আমাদের উপরও যে কোনো সময় ঘটতে পারে দুর্ঘটনা। তারপর কয়েক বছরে এমন গুলি বিনিময়ের দৃশ্য আরো অনেক বার দেখলাম। "
এখন বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে চীন আন্তর্জাতিক বেতারের মোট ২৭টি সংবাদ স্টেশন আছে। বিশ্বের কোন গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটলে আমাদের সংবাদদাতারা সময় মতো ঘটনাস্থল থেকে খবর পাঠান। বৈদেশিক বেতার ব্রতের সম্প্রসারণ আর উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে এখন সি আর আই প্রতিদিন ৪৩টি ভাষায় বিশ্বের কাছে ৭৮০ ঘন্টার বেশি অনুষ্ঠান প্রচার করে। ব্যবহৃত ভাষার সংখ্যা , অনুষ্ঠান প্রচারের সময় আর শ্রোতাদের চিঠির সংখ্যার দিক থেকে সি আর আই বিশ্বের তিনটি বৃহত্তম আন্তর্জাতিক বেতারের তালিকাভূক্ত হয়েছে।
সংস্কার আর উন্মুক্ততা হওয়ার পর চীনে চাকরি অধ্যয়ন, পর্যটন এবং ব্যবসা করতে আসা বিদেশীদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। তাঁদেরকে সময়োচিতভাবে চীনের দেশি-বিদেশী রীতিনীতি জানানো, সঠিকভাবে চীনকে জানানো এবং চীনের ব্যাপক বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিবিদ, শিক্ষা মহলের কর্মকর্তা এবং ছাত্রছাত্রীদের সুযোগসুবিধা দেয়ার জন্য ১৯৮৪ সাল থেকে সি আর আই প্রথমে পেইচিংয়ে ইংরেজী অনুষ্ঠান চালু করে। এই বিভাগের বর্তমান উপ-পরিচালক ম্যাডাম ওয়াং লু তখনকার কথা বলতে গিয়ে গর্বিত বোধ করেন। তিনি বলেছেন, "ইজি এফ এমকে বলা যায়, আজ পর্যন্ত চীনের সবচেয়ে পেশাগত ইংরেজী বেতার অনুষ্ঠান । সংগীত বা ইংরেজীর মান যে কোন দিক থেকে আমরা নিঃসন্দেহে চীনের মূলভূভাগের এক প্রতিষ্ঠাতা। " চীনের বৈদেশিক বেতারের প্রভাব দিনে দিনে সম্প্রসারণের সঙ্গে সঙ্গে সি আর আই যদি আগের মতো মাত্র বেতার অনুষ্ঠান প্রচার করে , তাহলে পরিস্থিতির উন্নয়নের সঙ্গে খাপ খাবে না।
১৯৯৮ সালে সি আর আই ইন্টারনেটে বহু ভাষার এক ওয়েবসাইট --- সি আর আই অনলাইন চালু করেছে। এখন ৪৩টি ভাষার অক্ষর আর ৪৮ রকম ভাষার অডিও অনুষ্ঠান নিয়ে গঠিত এই ওয়েবসাইট চীনে সর্বাধিক ভাষার ওয়েবসাইটে পরিণত হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গোটা পৃথিবীর নানা বড় আন্তর্জাতিক বেতারের প্রতিষ্ঠিত ওয়েবসাইটের মধ্যে সি আর আই অনলাইন সবচেয়ে বিখ্যাত।
চীনাদেরকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংস্কৃতি আরো ভালভাবে জানানোর জন্য সি আর আই এর বিদেশী ভাষার পারদর্শী কর্মকর্তারা বহু বিদেশী উপন্যাস, চলচ্চিত্র, নাটক এবং নানা গবেষণা প্রবন্ধ অনুবাদ করেছেন। এর সঙ্গে সঙ্গে চীনের কিছু বিখ্যাত বইও তাঁদের হাত থেকে বিভিন্ন দেশের ভাষায় অনুদিত হয়েছে, এভাবে চীনের সংস্কৃতি বিশ্বের কাছে সম্প্রচারিত হয়েছে। কিছু কর্মকর্তা সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের শ্রেষ্ঠ অবদানের জন্য অন্য দেশের নানা গৌরব অর্জন করেছেন। যেমন উর্দু বিভাগের প্রবীন উপস্থাপক লু সুই লিন ১৯৯৭ সালে পাকিস্তান সরকারের দেয়া "শ্রেষ্ঠ অবদান পদক" অর্জন করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, "আমি কেবল অবসর সময়ে আমার পছন্দনীয় কিছু কাজ করেছি। যদি বলা যায়, এই কাজগুলো চীন ও পাকিস্তানের সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের জন্য কিছু অবদান রেখেছে , এটা আমার ব্যক্তিগত ছোট আশা-আকাঙ্ক্ষাও বটে। "
|