বিদেশীদের অনেকেই মনে করেন, চীন এখন প্রচুর পণ্য উত্পাদন করছে। কিন্তু চীনে বা বিদেশের বাজারে চীনা পণ্যদ্রব্যের স্বকীয় মার্কা খুব কম। অনেক বেশি পণ্যের উপরেই মাল্টি-ন্যাশনাল কোম্পানির লেবেল। চীনের স্বকীয় মেধাসত্বের পণ্যদ্রব্য খুবই কম এবং প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতাও দুর্বল। তবে এই অবস্থার ক্রমেই পরিবর্তন ঘটছে। চীনের শিল্পোদ্যোক্তারা স্বকীয় মূলপ্রযুক্তি ও মেধাসত্বের ট্রেডমার্ক সৃষ্টির মাধ্যমে পণ্যের প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা বাড়ানোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন।
দীর্ঘকাল যাবত্ দেশবাসীরা মনে করেন, দেশী পণ্যের গুণমান খারাপ। বিদেশী মার্কার পণ্য হলেই উত্কৃষ্ট মানের পণ্যদ্রব্য। একই ধরনের দ্রব্য বাচাই করার সময়ে চীনা খদ্দেররা বিদেশী পণ্যই বেছে কিনেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কতকগুলো ক্ষেত্রে দেশী কোম্পানির প্রযুক্তি বহুজাতিক কোম্পানির মান ছাড়িয়েছে । ৫ বছর আগে চীনের কার্বোন পেপার বাজারে জার্মানি, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের প্রায় একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। যদিও চীনা কারখানা প্রায় একই ধরনের কার্বোন পেপার উত্পাদন করে, কিন্তু এই কাগজের কালার ডেভেলোপার তৈরির প্রযুক্তি ছিল বহুজাতিক কোম্পানির হাতে। তাই চীনা কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী ক্ষমতা খুবই সীমিত । ১৯৯৭ সালে চীনের হোনান প্রদেশের রুইফেং কোম্পানি স্বকীয় উদ্ভাবনের ভিত্তিতে নতুন ধরনের কালার ডেভেলোপার তৈরী করেছে এবং মেধাসত্বের আবেদন করতে পেরেছে । রুইফেং কোম্পানির জেনারেল ইঞ্জিনিয়ার লিউ জোংলাই বলেছেন, "আমাদের কালার ডেভেলোপার, বিদেশী কালার ডেভেলোপারের ত্রুটি এড়িয়েছে । বিদেশী ডেভেলোপারের রং ডেভেলোপ করার গতি মন্থর, আলোতে রং তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যায় এবং সময় একটু বেশি হলেই রং নষ্ট হয়ে যায় এবং রং গভীর( প্রগাঢ়) ছিল না।"
এই নতুন প্রযুক্তি ফেংরুই কোম্পানির জন্য বিরাট মুনাফা ডেকে এনেছে। কারণ কোম্পানিটির নতুন কার্বোন পেপারের গুণমান বহুজাতিক কোম্পানির চেয়ে ভাল, অথচ উত্পাদন খরচ কম। ফলে রুইফেং কোম্পানির কালার ডেভেলোপার দ্রুতই চীনা বাজারের শতকরা ৯০ ভাগ দখল করে ফেলেছে, বছরে বিক্রী মূল্য প্রায় ১০ কোটি ইউয়ান, পক্ষান্তরে বহুজাতিক কোম্পানির কার্বোন পেপার ক্রমেই চীনা বাজার থেকে সরে গেছে।
দেশের বাজারে সফল হবার পর চীনা কোম্পানি আবার বিদেশে যাওয়াব ব্যবস্থা নিয়েছে । কতকগুলো চীনা কোম্পানি সম্পূর্ণ স্বকীয় মেধাসত্বের হাইটেক দ্রব্য বিদেশের বাজারে বিক্রয় করতে শুরু করেছে। যেমন, কণ্টেইনারের নিরাপত্তা পরীক্ষাসরঞ্জাম ।চীনের এই সরঞ্জাম এখন ব্যাপকভাবে বিদেশের শুল্ক-বিভাগে ব্যবহার করা হচ্ছে । গুটিকয়েক বছর আগেও শুধু যুক্তরাষ্ট্র ও জার্মানিই এই সরঞ্জাম তৈরি করতে পারতো । কিন্তু এখন চীনের ছিংহুয়া থোংফাং কোম্পানির এই কণ্টেইনারের নিরাপত্তা পরীক্ষা সরঞ্জাম বিশ্ব বাজারের শতকরা ৫৭ ভাগ অধিকার করেছে। এই সরঞ্জাম ৩৮টি দেশ ও অঞ্চলে রপ্তানি করা হয়েছে। ছিংহুয়াথোংফা কোম্পানির চেয়ারম্যান খাং খোচুন মনে করেন, এই প্রযুক্তির মূল অংশ আয়ত্ত করা হলো কোম্পানির সফলতার চাবিকাঠি। তিনি বলেছেন, " এই সাফল্যের প্রধান কারণ আমাদের মোবাইল ধরনের কণ্টেনার পরীক্ষাযন্ত্র সিস্টেম উদ্ভাবন। ফলে এই ক্ষেত্রে এখন আমরা সারা বিশ্বেই এগিয়ে আছি। তাছাড়া যাত্রীদের বহন করা বোতল বা পাত্রের মধ্যে তরল পদার্থ সহজে বিস্ফোরিত হতে পারে কিনা,তা পরীক্ষার নতুন প্রযুক্তিও সারা বিশ্বে শুধু আমাদের আছে। আমরাই এই লাইনে অগ্রনী স্থানে রয়েছি।"
স্বকীয় প্রযুক্তি আয়ত্ত করার পর চীনা কোম্পানি নিজস্ব ট্রেডমার্ক প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করেছে। আগে চীনা কোম্পানি ছিল নামকরা বিদেশী কোম্পানির পণ্য প্রক্রিয়াকরণের ঘাঁটি, তাদের বেশির ভাগ মুনাফা চলে যায় বিদেশীদের হাতে। এই অবস্থা বদলে যাচ্ছে এখন।
১৯৯৭ সালে প্রতিষ্ঠিত চীনের চেরি গাড়ি কোম্পানি এখন স্বকীয় ট্রেডমার্কের গাড়ি উত্পাদন করে। ২০০৫ সালে চেরি কোম্পানি যত গাড়ি রপ্তানী করেছে , তা চীনের গাড়ি রপ্তানীর মোট পরিমাণের তিন ভাগের এক ভাগ। চেরি কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ইন থোংইয়াও বলেছেন, "আমাদের স্বকীয় ট্রেডমার্কের পণ্য থাকলেই কেবল বিদেশে উন্নয়ন লাভ করতে পারে। কারণ বিদেশী ট্রেডমার্ক তাদের চীনা সহযোগী অংশীদারদের সঙ্গে তাদের মুনাফার কেক শেয়ার (ভাগাভাগি) করতে চায় না। আমাদের নিজস্ব ট্রেডমার্ক আছে বলে বিদেশে রপ্তানি ও উন্নয়ন করতে পারি।"
চীনের কয়েকটি কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে 'তিন জি মোবাইল টেলিকমিউনিকেশন' প্রযুক্তির মানদণ্ড সৃষ্টি করেছে, এর নাম: টিডি-এসসিডিএম'এ। এটা এখন বিশ্বে তিন ধরনের 'তিন জি' মানদণ্ডের মধ্যে একটি। চীনের এই মানদণ্ডের মূলপ্রযুক্তি থেকে মানদণ্ড , চিপ থেকে গোটা যন্ত্রসিস্টেম এক সম্পূর্ণ শিল্প-সিরিজ আমাদের হয়েছে। ফলে আগামী কয়েক বছরে চীনে 'তিন জি সিস্টেমের' অবকাঠামো নির্মাণ ও রিসিভার- টার্মিনাল সরঞ্জাম --এই দুটো বাজারে নিহিত থাকবে কয়েক ট্রিলিয়ন ইউয়ানের মূল্য। বিদেশীরা এই মানদণ্ড গ্রহণ করলে তার ভবিষ্যত সম্ভাবনা আরও বিরাট হবে।
নিজেদের প্রচেষ্টা ছাড়াও চীনা কোম্পানির সফলতার আরেকটি কারণ স্বকীয় উদ্ভাবনের প্রতিষ্ঠানের প্রতি সরকারের সক্রিয় সমর্থন। অর্থাত্ যে সব উচ্চ প্রযুক্তির বিশ্ব মান আছে এবং ব্যাপক বাজারের সম্ভাবনা , সেগুলোকে আর্থিক সমর্থন দেয়া এবং কর-মুক্ত সুবিধা দেয়া। শান'সি প্রদেশের পাওচি শহরের মেয়র ইয়াও ইংলিয়াং বলেছেন, " আমরা প্রযুক্তি উন্নয়নে আরও বেশী পুঁজি বিনিয়োগ করতে এবং নামকরা ট্রেডমার্ক জনপ্রিয় করতে উত্সাহ দিয়েছি। যেমন, আমরা সংশ্লিষ্ট শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও প্রধান প্রযুক্তিবিদকে পুরস্কার প্রদানের ব্যবস্থা করি। এটাই সরকারের নীতি।সরকার প্রযুক্তির সংস্কার এবং নতুন পণ্য গবেষণা ও উন্নয়নে বিভিন্ন বিশেষ অর্থতহবিল দিয়ে সমর্থন দেয়।"
চীনের স্বকীয় উদ্ভাবনের নিজস্ব মেধাসত্বের ট্রেডমার্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টার কল্যাণে চীনের রপ্তানী পণ্যের গুণগত মানের অনেক উন্নতি হয়েছে । ফলে এখন চীনের রপ্তানী পণ্যদ্রব্যর মধ্যে সবচেয়ে দামী একটিমাত্র জিনিসের দাম ৩০ লক্ষ মার্কিন ডলার। অথচ ৫ বছর আগে রপ্তানী করা সবচেয়ে দামী একটি জিনিসের দাম ছিল মাত্র ২০ হাজার ডলার। অর্থনীতির বিশ্বায়নের প্রক্রিয়ায় চীনের পণ্যদ্রব্য বিশ্ব জনগণের জীবনে আরও বেশি কল্যাণকর প্রভাব ফেলবে।
|