ছুয়ান লি নামক একজন মহিলা ১৯৮৪ সালে চীনের বিখ্যাত পিকিং বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করেন । ১৯৮৯ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত ওয়ারটন স্কুল অফ কমার্স থেকে এম বি এ ডিগ্রি লাভ করেন । ১৯৯০ সালে তিনি সুপরিচিত ফ্যাশন মার্ক গুচি কোম্পানির কর্মচারী হন । ১৯৯৮ সালে তিনি তাঁর দৃষ্টি বিলুপ্তপ্রায় চীনা বাঘের ওপর নিবদ্ধ করেছেন এবং মনেপ্রাণে এই কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন । ছুয়ান লি হচ্ছেন চীনা বাঘ বাঁচানো সক্রান্ত আন্তর্জাতিক তহবিলের প্রতিষ্ঠাতা । আজকের অনুষ্ঠানে ছুয়ান লি সম্বন্ধে কিছু বলছি আমি শি চিং উ ।
ছুয়ান লি পেইচিংয়ের পূর্ব দিকে অবস্থিত সোহো আধুনিক নগর নামে একটি আবাসিক ভবনে থাকেন । আমাদের সংবাদদাতা তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখতে পেলেন , ঘরের সর্বত্রই রয়েছে বাঘের চিহ্ন । দেয়ালে টাংগানো রয়েছে বাঘের চিত্র । সোফায় ছড়িয়ে রয়েছে কাপড়ের বাঘের পুতুল । বুকশেলফে সাজানো রয়েছে নানা ধরণের বাঘ সংক্রান্ত বইপত্র ও চিত্রসংকলন । তাতে প্রতীয়মান হয় যে, ছুয়ান লি বাঘকে অত্যন্ত পছন্দ করেন । তিনি বলেছেন ,
শিশুকাল থেকে আমি বাঘকে ভালোবেসে এসেছি । আমার মনে হয় , বাঘ হচ্ছে সদ্গুণে পরিপূর্ণ এক রকম জন্তু । তার গায়ের রং দারুণ সুন্দর । তার স্বভাব অনন্য । কখনো কখনো সে মুখ খুলে তার হিংস্রতা প্রদর্শন করে । আবার সময় সময় সে অত্যন্ত নম্রতা ও নমনীয়তা প্রদর্শন করে। সত্যিই বাঘ বেশ মজার প্রাণী ।
ছুয়ান লি একজন অত্যন্ত ভদ্র মহিলা । কথা বলার সময়ে তিনি হাসতে পছন্দ করেন । বাঘের কথা উল্লেখ করলে তিনি অনর্গল কথা বলতে শুরু করেন । ছুয়ান লি এখন চীনা বাঘ সংরক্ষণের কাজে তাঁর সমস্ত মন ও শক্তি নিয়োগ করছেন । তার কারণ হচ্ছে , তিনি বাঘকে ভালোবাসেন । অপর দিকে তিনি বাঘ সংরক্ষণের বিরাট তাত্পর্য অনুধাবন করেছেন । তিনি বলেছেন ,
বাঘ প্রাকৃতিক পরিবেশের শীর্ষদেশে বসবাস করে । সে জীবজন্তুর রাজা বলে পরিচিত । বাঘকে বাঁচাতে পারলে গোটা প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচানোর সামিল হবে । বাঘ লালন পালন করতে হলে ঘাস খাওয়া জীবজন্তু থাকতে হবে । ঘাস খাওয়া জন্তু লালন পালন করতে হলে ঘাস থাকতে হবে । আবার ঘাস থাকতে হলে জল ও গাছ থাকতে হবে । এসব নিয়ে এক গোটা প্রাকৃতিক পরিবেশ গড়ে ওঠে । সুতরাং আমরা বাঘকে বাঁচাতে পারলে গোটা প্রাকৃতিক পরিবেশকে বাঁচিয়ে তুলতে পারবো ।
এই দায়িত্ববোধ নিয়ে প্রবাসী চীনা ছুয়ান লি ১৯৯৯ সাল থেকে বাঘের ওপর তাঁর নজর রাখতে শুরু করেন । চীনের জাতীয় বন ব্যুরোর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সংগে আলাপ করে ছুয়ান লি জানতে পারলেন , দক্ষিণ চীন বাঘ অর্থাত চীনা বাঘ এখন বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় রয়েছে ।
চীনা বাঘদের বাঁচানোর জন্যে ১৯৮০ সাল থেকে চীন সরকার শিকার নিষিদ্ধ করা , প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণ এলাকা প্রতিষ্ঠা এবং বাঘের হাড়ের লেনদেন নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি ব্যবস্থা নিয়েছে । তবে পর পর চালানো জরীপের ফলাফল থেকে জানা যায় , চীনের বাঘগুলো এখনো বিলুপ্তির পথে রয়েছে । গত ২০ বছরে চীনা বাঘের দল আর দেখা যায় নি । ছুয়ান লি মনে করেন যে , এখন চীনা বাঘের জন্যে কিছু করার সময় এসেছে । তিনি বলেছেন ,
চীনের এই বিশেষ বাঘ এখন এমন বিলুপ্তপ্রায় অবস্থায় বিদ্যমান আছে । আমার মনে হয়, একজন চীনা লোক হিসেবে আমার উচিত চীনা বাঘের জন্যে কিছু করা ।
চীনের বন ব্যুরোর সমর্থনে ছুয়ান লি লক্ষাধিক মার্কিন ডলার পুঁজি বিনিয়োগ করে লন্ডনে চীনা বাঘ বাঁচানো সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক ফেডারেশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন । বৃটিশ সরকারের অনুমোদনক্রমে ২০০০ সালের আগস্ট মাসে চীনা বাঘ বাঁচানো সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক তহবিল আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় । এটা হচ্ছে চীনা বাঘ ও চীনের অন্য বিরাটাকারের বিড়াল জাতীয় জন্তুর জন্যে প্রথম বিশ্ব পর্যায়ের আন্তর্জাতিক তহবিল সংস্থা ।
চীনা বাঘ সংরক্ষণের জন্য গঠিত এই তহবিল সংস্থা পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানের জনতার সমর্থন লাভ করেছে । এতে ছুয়ান লি অত্যন্ত আনন্দিত । তিনি বলেছেন , একদিন আমি একটি চিঠি পেলাম । চিঠিটির মধ্যে ১৭.৯ স্টার্লিং ছিল । চিঠিটিতে বলা হয়েছে , আমি বৃটেনের সর্বনিম্ন স্তরের লোক । আমি আবর্জনা সাফ করি । রোজ অন্যদের ছুটির পর আমি বিভিন্ন অফিসে গিয়ে আবর্জনা সাফ করি । এই কাজ করার সময়ে আমি প্রায় কিছু ধাতব টাকা সংগ্রহ করি। এসব টাকা আমার নয় । তাই আমি সেগুলো আপনাদের তহবিল সংস্থায় চাঁদা দিয়েছি । মানুষের চেয়ে জীবজন্তুদের এসব টাকার আরো দরকার হবে । অন্যান্য জন্তুর তুলনায় বাঘের এসব টাকার আরো প্রয়োজন হবে ।
চীনা বাঘ বাঁচানো সংক্রান্ত তহবিল সংস্থা বহু লোকের সমর্থন পেয়েছে । তাদের মধ্যে স্বভাবতই রয়েছে ছুয়ান লির স্বামী - মার্কিন নাগরিক স্টুয়াট ব্রেই। তিনি বৃটেনের একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন । ছুয়ান লি আমাদের সংবাদদতাকে বলেছেন , চীনা বাঘদের বাঁচিয়ে তুলতে হলে প্রথমে চিড়িয়াখানার বাঘগুলোকে বনে ছেড়ে দিতে হবে যাতে তারা আবার বনে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সামর্থ্য লাভ করে । একটি বন্য বাঘের চলাফেরার জন্যে ১৫ থেকে ১ হাজার বর্গকিলোমিটারের পরিসরের দরকার । চীনের অভ্যন্তরে এমন বিশাল ভূমি খুঁজে পাওয়া মুস্কিল । ছুয়ান লির ব্রতকে সমর্থন করার জন্যে চীনা বাঘদের প্রজনন ও বনে ফিরে যাওয়ার প্রশিক্ষণের ঘাঁটি হিসেবে ব্রেই ৪০ লাখ মার্কিন ডলার পুঁজি বিনিয়োগ করে আফ্রিকায় ৩০ লাখেরও বেশ কিলোমিটার ভূমি কিনেছেন । বর্তমানে চীনের চিড়িয়াখানাগুলো থেকে আসা তিনটি চীনা বাঘ সেখানে বন্যায়নের প্রশিক্ষণ পাচ্ছে ।
ছুয়ান লির স্বামী ব্রেই আমাদের সংবাদদাকে বলেছেন , প্রথম দিকে তিনিও ছুয়ান লির এই কাজকে সমর্থন করতেন না । তবে এখন তিনি তার স্ত্রীর জন্যে গর্ববোধ করছেন । তিনি বলেছেন ,
আমার মনে হয়, তাঁর প্রচেষ্টা অত্যন্ত উত্সাহব্যঞ্জক । তিনি এই কাজের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেন । তিনি এই কাজের জন্যে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।
ছুয়ান লির প্রচেষ্টা ও অবদান চীন সরকারের স্বীকৃতি পেয়েছে । চীনের জাতীয় বন ব্যুরোর বন্য প্রাণী গবেষণা কেন্দ্রের লু চুন বলেছেন,
আমাদের সংগে ছুয়ান লির সহযোগিতা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে । প্রবাসী চীনাদের মধ্যে তিনি হলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি চীনা বাঘদের বাঁচানোর প্রস্তাব দিয়েছেন ।
|