গত কয়েক বছরে চীন-ভারত সম্পর্কের স্থিতিশীল বিকাশ ও সার্বিক উন্নয়নের সংগে সংগে সামরিক নিরাপত্তা এবং অ-প্রথানুগ নিরাপত্তার ক্ষেত্রে দুই দেশের সহযোগিতা এক নতুন সময়পর্বে প্রবেশ করেছে । নিম্নোক্ত কযেকটি ক্ষেত্রে তার প্রধান প্রতিফলন ঘটেছে।
দীর্ঘদিন ধরে সামরিক ক্ষেত্রে চীন ও ভারতের আদান-প্রদান ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের সংগে অসংগতিপূর্ণ ছিল । ২০০১ সালের পর দুই দেশের সামরিক বিনিময় ধাপে ধাপে পুনরায় চালু হয় । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন-ভারত সামরিক আদান-প্রদান ও সহযোগিতা অনবরত জোরদার হয়েছে। দুই দেশের সামরিক বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের সফর বিনিময় বেড়ে চলেছে । ২০০৩ সালে দু'দেশের দুই নৌ বাহিনী প্রথমবারের মত সমুদ্রে যৌথ ত্রাণ মহড়ার আয়োজন করে । তার পর পরই দু দেশের মধ্যে নৌ বহরের সফর বিনিময় বাস্তবায়িত হয় । গত এক বছরে দুই দেশের সামরিক কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ , সামরিক বিদ্যা গবেষণা , শান্তি রক্ষী বাহিনীর প্রশিক্ষণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে আদান-প্রদান ও সহযোগিতা চলেছে। চীন ও ভারত সীমান্তে বাস্তব নিয়ন্ত্রণ রেখা বরাবর এলাকায় সামরিক আস্থার ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্যে যে প্রচেষ্টা চালিয়েছে, তাতে সাফল্য পাওয়া গেছে । দুই দেশের সীমান্ত বাহিনীর মধ্যে চালু করা হটলাইন ও নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা দুই দেশের সীমান্ত বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্যে কল্যানকর হয়েছে, লোকজনের আসা যাওয়া সুগম করেছে , উত্তেজনা ও সংঘর্ষের সম্ভাবনা কমিয়ে দিয়েছে এবং সীমান্তের বাস্তব নিয়ন্ত্রণ লাইন বরাবর এলাকার নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করেছে । সন্ত্রাসবাদ, মাদকদ্রব্য পাচার ও আন্তঃদেশীয় অপরাধ দমন এবং পরিবেশগত নিরাপত্তা প্রভৃতি ক্ষেত্রে চীন-ভারত সহযোগিতা আরো জোরদার হয়েছে। ২০০৫ সালে দুই দেশের মধ্যে যুক্ত সন্ত্রাস-বিরোধী সংলাপ ব্যবস্থা চালু হয়েছে।
চীন বিপুল প্রয়াসের সংগে " পারস্পরিক আস্থা, পারস্পরিক উপকারিতা, সমতা ও সমন্বয়কে" কেন্দ্র করে নিরাপত্তার নতুন নীতি অনুসরণ করছে । চীন জোটনিরপেক্ষ ও কোনো তৃতীয় পক্ষের বিরুদ্ধে নয় , এমন সহযোগিতার নীতিতে বিশ্বাসী । চীন সক্রিয়ভাবে আঞ্চলিক জোটনিরপেক্ষ সংগঠনে যোগ দেয় এবং তা সমর্থন করে । গত কয়েক বছরে ভারত শাংহাই সহযোগিতা সংস্থার পর্যবেক্ষক হয়েছে । ভারত হচ্ছে আসিয়ানের সংলাপকারী দেশ। সে দেশ "দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মৈত্রী ও সহযোগিতা চুক্তি" স্বাক্ষর করেছে । ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে চীন ও ভারত একযোগে আসিয়ান আয়োজিত প্রথম পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দেয় । চীন সাফল্যের সংগে প্রথম আসিয়ান ফোরামের নিরাপত্তা নীতি সম্মেলন আয়োজন করেছে এবং আসিয়ান দেশগুলোর সংগে মিলে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় নিরাপত্তা সংক্রান্ত সেমিনার আয়োজনের প্রস্তাব উত্থাপন করেছে । চীন ও ভারত সম্মিলিতভাবে আঞ্চলিক নিরাপত্তার সহযোগিতায় যে শামীল হচ্ছে , তা দুই দেশের সন্দেহ ও সংশয় কমিয়ে এনেছে এবং সংগে সংগে দু পক্ষের নিরাপত্তার চাহিদা মিটিয়েছে ।
চীন সবসময় সহযোগিতার মাধ্যমে নিরাপত্তা অন্বেষণের নীতিতে বিশ্বাসী এবং সংঘাত ও স্নায়ু যুদ্ধের মর্মতেজের বিরোধী । নিরাপত্তার ক্ষেত্রে চীনের এই নতুন ধারণার প্রতি ভারতের সম্মতির মাত্রা বেড়ে চলেছে । ২০০৫ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত চীন-ভারত যুক্ত বিবৃতিতে ঘোষণা করা হয়েছে , চীন ও ভারত বিশ্ব শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং সম্মিলিত উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে জাতি সংঘের গুরুত্ব উপলব্ধি করেছে । এই দুই দেশ আন্তর্জাতিক সমাজের সংগে মিলে জাতি সংঘ ব্যবস্থা আরো জোরদার করতে বদ্ধপরিকর, যাতে জাতি সংঘ যৌক্তিক ও বহুপাক্ষিক ভিত্তিতে বিশ্বের সমস্যা সমাধান করতে পারে । চীন ও ভারত সক্রিয়ভাবে জাতি সংঘের শান্তি রক্ষার তত্পরতা সমর্থন করে । গত ১৫ বছরে চীন পর পর জাতি সংঘের ১৫টি শান্তি মিশনে অংশ নিয়েছে এবং এগুলোতে ৩ হাজার ৩ শ'রও বেশি সামরিক ব্যক্তি, পুলিশ ও বেসামরিক কর্মকর্তাপাঠিয়েছে । বর্তমানে ভারতের ৬ হাজারেরও বেশি শান্তি রক্ষী সৈনিক পৃথিবীর দশ বারোটি দেশে শান্তি রক্ষী তত্পরতায় নিয়োজিত রয়েছেন । বিশ্বের বহুমেরুকরণ ত্বরান্বিত করা , নতুন হস্তক্ষেপবাদ ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের বিরোধিতা করা , উগ্র ধর্মীয় শক্তি রোধ করা , বিশ্বজোড়া সন্ত্রাস-বিরোধী আইন ব্যবস্থা জোরদার করা এবং মাদকদ্রব্য পাচারের ওপর আঘাত হানা প্রভৃতি ক্ষেত্রে চীন ও ভারত পরস্পরের সংগে সমন্বয় করেছে এবং পরস্পরকে সমর্থন করেছে । সময়মত আঞ্চলিক ও বিশ্বজোড়া নিরাপত্তার সমস্যা নিয়ে সংলাপ ও সমন্বয় করার জন্যে ২০০৫ সালে চীন ও ভারত উপমন্ত্রী পর্যায়ের রণকৌশলগত সংলাপ ব্যবস্থা চালু করেছে ।
ভবিষ্যতের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই যে, চীন ও ভারত তাদের উন্নয়নের গতিধারায় অ-প্রথানুগ হুমকি সহ অধিক থেকে অধিকতর হুমকির সম্মুখীন হচ্ছে । সুতরাং দু দেশের শান্তি ও উন্নয়নের জন্যে এক নিরাপদ আন্তর্জাতিক ও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে দুই দেশের সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন ।
|