থিয়েনচিন মহানগর রাজধানী পেইচিং থেকে মাত্র শতাধিক কিলোমিটার দূরে পোহাই উপসাগরের তীরে অবস্থিত। চীন সরকার এই মহানগরের উপকূলীয় নতুন এলাকার উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী আগামী পাঁচ বছরে এই উপকূলীয় নতুন এলাকা একটি উন্নত মানের আধুনিক পণ্য উত্পাদন শিল্পঘাঁটি এবং আন্তর্জাতিক পরিবহন ও লজিস্টিক্স কেন্দ্র এবং সুষ্ঠু পরিবেশের আধুনিক অর্থনৈতিক এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে।
এই নতুন এলাকার একটি অংশ হলো থিয়েনচিন অর্থনৈতিক প্রযুক্তি এলাকা। তার সংক্ষিপ্ত নাম 'থাইতা' এলাকা। প্রায় ২০ বছর আগে থাইতা এলাকার উন্নয়ন শুরু হয়।। ২০০৫ সালের শেষ নাগাদ থাইতা উন্নয়ন এলাকায় মোট চার হাজারেরও বেশি বৈদেশিক পুঁজিবিনিয়োজিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান সরকারের অনুমোদন পেয়েছে এবং তাতে ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি বৈদেশিক পুঁজি বিনিয়োজিত হয়েছে।
বিশ্ববিখ্যাত মটরোলা কোম্পানি ১৯৯৪ সালে এই থাইতা উন্নয়ন এলাকায় মোবাইল ফোন কারখানা স্থাপন করে । এই কোম্পানির পাবলিসিটি বিষয়ক পরিচালক ইয়াং পোনিং সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন, এই কারখানাই সারা বিশ্বে মটরোলার বৃহত্তম মোবাইল ফোন উত্পাদন ঘাঁটি । তিনি বলেছেন, "চীন হলো সারা বিশ্বে মটরোলার ব্যবসার এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। একক দেশ হিসেবে চীন হলো মটরোলার বৃহত্তম বাজার। থাইতা এলাকায় মটরোলার উত্পাদিত মোবাইল ফোন স্থানীয় আর বিদেশের উভয় বাজারে সরবরাহ করা হয়। সারা বিশ্বের বাজারে আমাদের এখানে উত্পাদিত মটরোলার মোবাইল ফোন পাওয়া যায়। চীনে মটরোলার উত্পাদনকেন্দ্র এবং গবেষণাকেন্দ্র আছে। আমাদের গবেষণাধীন অনেক পণ্য স্থানীয় বাজারের জন্য নয় ,বরং বিশ্ব বাজারের জন্য। আমরা মনে করি, ইউরোপ আর আমেরিকার ব্যবসায়ীদের সরবরাহ করা মোবাইল ফোনের সফ্টওয়্যার আমাদের চীনস্থ গবেষণাকেন্দ্রে উদ্ভাবিত।"
থাইতা উন্নয়ন এলাকা হলো থিয়েনচিন মহানগরের উপকূলীয় নতুন এলাকার একটি অংশ, এই এলাকায় চীনের অন্যতম বড় বন্দর থিয়েনচিন বন্দর আছে। এই বন্দরের স্থলভাগ ও জলসীমার মোট আয়তন ২০০ বর্গকিলোমিটার। দেড় লক্ষ টনী জাহাজ সহজে এই বন্দরে ভিড়তে পারে। এই বন্দরের মাধ্যমে বছরে ২০ কোটি টন মাল খালাস বা বোঝাই করা হয়। এখানে রয়েছে উত্তরচীনের বৃহত্তম শুল্কমুক্ত এলাকা। এলাকাটিতে ইতিমধ্যেই ৫৭০০টিরও বেশি দেশী -বিদেশী কোম্পানি প্রবেশ করেছে এবং এখানে চীনের বৃহত্তম খাদ্য ও ভোজ্য তেল প্রক্রিয়াকরণ ঘাঁটি এবং রপ্তানিমুখী টমেটো প্রক্রিয়াকরণ ঘাঁটি স্থাপন করেছে। থিয়েনচিন বন্দর আর তার শুল্কমুক্ত এলাকা সম্প্রসারণ সম্পর্কে থিয়েনচিন পরিবহণ কমিটির সম্পাদক লিউ মিংতে বলেছেন, "থিয়েনচিন বন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্পে আড়াই লক্ষ টনী জাহাজ ভিড়বার জন্য গভীর পানির সমুদ্রপথ নির্মাণ করা হবে। বন্দরের বার্ষিক মাল বোঝাই ও খালাসের পরিমাণ হবে ৩০ কোটি টনেরও বেশি । এটি উন্নত সাজসরঞ্জামে সজ্জিত এক আধুনিক আণ্তর্জাতিক গভীর পানির বন্দরে পরিণত হবে।এটাই হবে উত্তরপূর্ব এশিয়া এবং মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার জন্য মাল পরিবহনের প্রধান কণ্টেইনার বন্দর । এটি হবে চীনের উত্তর অংশের সবচেয়ে উন্মুক্ত শুল্কমুক্ত বন্দর -এলাকা । থিয়েনচিনের এই উপকূলীয নতুন এলাকা একটি আন্তর্জাতিক পরিবহন ও লজিস্টিক্স কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হবে ।"
এই নতুন এলাকায় ইতিমধ্যেই ইলেক্ট্রনিক তথ্য, গাড়ি নির্মাণ, তেল-রসায়নিক শিল্প , ধাতু ঢালাই , জীববিদ্যা প্রযুক্তি , আধুনিক ওষুধ, নতুন শক্তিসম্পদ উন্নয়নের ভিত্তিতে এক বিরাট শিল্পের কাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। তবে অর্থনীতির দ্রুত উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতি , সমাজ ও পরিবেশের সমন্বিত উন্নয়নের কথা ভাল করে বিবেচনা করা হয়। শিল্পজাত আবর্জনার যথাযথ প্রক্রিয়াকরণ প্রকল্পের কাজ এখানে বিভিন্ন পক্ষের কার্যকর সমর্থন পায়। নতুন এলাকাটিতে পাঁচ শো বর্গকিলোমিটারের জলাভূমি কার্যকরভাবে সংরক্ষণ করা হয়, এলাকাটি মোট আয়তনের ৩৫ শতাংশের ওপর সবুজের ছড়াছড়ি। এলাকাটির প্রতি হাজার ডলার জি ডি পির জন্য শক্তিসম্পদের খরচের মাত্রা শুধু চীনের গড়পড়তা মাত্রার দশ ভাগের এক ভাগ।
সংবাদদাতা থিয়েনচিনে তেল-রসায়নিক কোম্পানিতে পরিদর্শন করার সময়ে দেখেছেন, হরিন এবং ময়ুর এই শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভেতরে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে। নানা রকম বড়বড় গাছ, ঝোপ এবং ফুল ইত্যাদির দৃশ্য খুবই মনোরম। কোম্পানিটির দায়িত্বশীল ব্যক্তি জেং ওয়ানচুন বলেছেন, " আমরা সবুজায়নের ওপর গুরুত্ব দেই, সবুজায়নের মাধ্যমে এখানকার বায়ু বিশুদ্ধ হয়ে যায়, দূষিত পদার্থের যথাযথ প্রক্রিয়াকরণ করা হয়। দূষিত পানি নিষ্কাষণের আগে তার যথাযথ প্রক্রিয়াকরণ করা হয়, দূষিত পানি মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে রাষ্ট্রীয় মানদণ্ড পূরণ হবার পরই শুধু নদীতে প্রবাহিত হয়।"
এই সমন্বিত উন্নয়নের কল্যাণে এলাকাটির বাসিন্দারা সুন্দর পরিবেশে জীবনযাপন করতে পারছেন। এখান রয়েছে যেমন সারি সারি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কারখানার দালান, তেমনি আবাসিক এলাকার মধ্যে রয়েছে ছোট ছোট পার্ক , বিনোদন চত্বর এবং প্রশস্ত রাস্তা । যেখানে সেখানে সবুজ গাছগাছড়া এবং সবুজ ঘাসের লন এবং সবুজ চত্বরদেখা যায় এই উপকূলীয় নতুন এলাকা একটি বসবাসের উপযোগী শহর হিসেবে গড়ে উঠার চেষ্টা করছে। যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো থেকে আসা ফ্লোরেনি চেরি এই নতুন এলাকায় চাকরি করেন এবং থাকেন। তিনি সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন, উপকূলীয় নতুন এলাকাটির পরিবেশ সংরক্ষণের সযত্ন আর অতি সূক্ষ্ম বন্দোবস্ত দেখে তিনি বিস্মিত হন। তিনি বলেছেন, " দীর্ঘকাল ধরে তাঁরা আমাদের যুক্তরাষ্ট্রের মতো সমস্ত বর্জ্য কাগজ , ধাতু ও প্লাস্টিকের মতো আবর্জনা সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছেন । তাঁরা বর্জ্য কাগজ, ধাতুর ক্যান ইত্যাদি ফেলে দেন না। বরং পুনরায় ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেন। এইভাবে পরিবেশ সুরক্ষা করা হয়। মানে গোটা পৃথিবীর পরিবেশ সুরক্ষা হয়। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ প্রকৃতিতে ভারসাম্য থাকা উচিত, ভারসাম্য নষ্ট হলে মারাত্মক বিপদ হবে। তাই আমাদের অবশ্যই পরিবেশ সুরক্ষা করতে হবে।"
|