কয়েক বছর আগে" সুন্দর জীবন" নামে ইতালির একটি ছায়াছবি অস্কার পুরস্কার লাভ করেছে । ছায়াছবিটির কাহিনী এমনি: দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সময়ে একজন লোক নাতসি বন্দী শিবিরে আটক হয় । যাতে নিষ্ঠুর বাস্তব জীবন তার ছেলের মনে কালো মানসিক ছায়া না ফেলে , সেজন্যে তিনি তার ছেলেকে বলতেন , বন্দী শিবিরে যা ঘটেছিল , তা ছিল একটি খেলা মাত্র । তাই বন্দী শিবিরে তাঁর জীবন তার ছেলের স্মৃতিতে একটি অত্যন্ত সুন্দর জীবনে পরিণত হয় । আজ চীনে ক্যান্সারে আক্রান্ত একটি ছোট মেয়ের স্বপ্ন পূরণের জন্যে কয়েক হাজার লোক একযোগে একটি সুন্দর গল্প বানিয়েছেন । তারা আশা করছেন যে, তারা তাদের ভালোবাসা দিয়ে একটি বিস্ময় সৃষ্টি করবেন ।
সিন ইউ'র বয়স ৮ বছর । সে চীনের রাজধানী পেইচিংয়ের প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ছিয়াং ছুন শহরে বসবাস করে । গত বছর সে গুরুতর মস্তিষ্কের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় । তার রোগের অবনতির সংগে সংগে সে অন্ধ হয়ে যায় এবং কথা বলাও দুষ্কর হয়ে পড়ে । চিকিত্সক তার বাবামাকে বললেন, মেয়েটি যা চায় , তা পুরণ করতে দিন । কেন না , তার বেঁচে থাকার সময় আর বেশি নেই ।
সিন ইউর সবচেয়ে বড় আকাংক্ষা হলো পেইচিংয়ের থিয়ান আন মেন মহাচত্বরে গিয়ে জাতীয় পতাকা উত্তোলোনের দৃশ্য দেখা । তবে চিকিত্সক বলেছেন , তার শরীর দীর্ঘ ভ্রমণের ধাক্কা সহ্য করতে পারবে না । সিন ইউর বাবাকে স্থানীয় গণ মাধ্যমের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করতে হলো । তিনি আশা করছেন , তারা ছিয়াং ছুনে তার মেয়ের জন্যে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করবেন যাতে অন্ধ সিন ইউ মনে করতে পারে যে , সে সত্যি সত্যিই পেইচিংয়ের থিয়ান আন মেন মহাচত্বরে জাতীয় পতাকা উত্তোলোনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকছে । অল্প দিনের মধ্যে স্থানীয় " শহুরে সন্ধ্যা" পত্রিকায় তার সংবাদদাতা থাও পিনের একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় । প্রবন্ধে তিনি দয়ালু লোকদের উদ্দেশ্যে সিন ইউর জন্যে একটি সুন্দর গল্প বানানোর আহবান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন , তাঁর প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার পর পরই বহু শহরবাসীর মধ্যে সক্রিয় সাড়া পাওয়া গেছে । তিনি বলেছেন ,
আমি ভাবতে পারি নি যে, প্রবন্ধ প্রকাশের পরের দিন কয়েক শ' লোক আমাকে টেলিফোন করবে । ফোনে তারা সবাই এই তত্পরতায় শরীক হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন । কোনো কোনো স্কুল তাদের নিজদের স্কুলকে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জায়গা হিসেবে সুপারিশ করেছে । কেউ কেউ দর্শক হওয়ার উচ্ছা প্রকাশ করেছেন ।
২২ মার্চ ভোরে একটি ট্যাক্সি সিন ইউকে নিয়ে যাত্রা শুরু করলো । বাবামা সিন ইউকে বললেন , এবারের ভ্রমণের গন্তব্যস্থল হলো পেইচিংয়ের থিয়ান আন মেন মহাচত্বর । মেয়েটির ক্লান্তি লাঘবের জন্যে ট্যাক্সি খুবই মন্থর গতিতে চলল । ছোট সিন ইউ আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লো ।
তিন ঘন্টার পর ট্যাক্সিটি থামলো । সিন ইউ জেগে উঠে মনে করলো, সে পেইচিংয়ে পৌছেছে । এই গুজবের সত্যতা বাড়ানোর জন্যে সিন ইউর সংগীরা তাকে বললেন , অন্য স্থানের গাড়িগুলো সরাসরি শহরের কেন্দ্রস্থলে যেতে পারবে না । তাদের ৪ নং পাবলিক বাসে করে থিয়ান আন মেন মহাচত্বরে যেতে হবে। সেই সময়ে আগেভাগে অপেক্ষমান ছিয়াং ছুনের একটি পাবলিক বাস তাদের সামনে এসে পড়লো । বাসের সমস্ত যাত্রীই ছিলেন স্বেচ্ছাসেবীরা ।
বাসে সিন ইউর পাশে যাত্রীরা বাসের কন্ডাক্টারের সংগে আলাপের ভান করছেন । কথাবার্তা থেকে আভাস পাওয়া যাচ্ছে যে, এই বাস থিয়ান আন মেন মহাচত্বরের দিকে যাচ্ছে । সংগীরা একসাথে সিন ইউর হুইল চেয়ার বাসে তুলে দিল । আসল পরিবেশ গড়ে তোলার জন্যে বাসটি থিয়ান আন মান মহাচত্বরে পৌছার আগে চারটি স্টেশনে থামলো । এই সময়ের মধ্যে যাত্রীদের কেউ কেউ স্থানীয় ভাষায় পথ জিজ্ঞেস করছে , কেউ বা পেইচিয়ের আবহাওয়া নিয়ে আলাপ করছে । মনে হয় , যাত্রীরা সত্যিকারভাবে পেইচিংয়ের রাস্তায় চলাচল করছেন । অবশেষে বাসটি থিয়ান আন মেন মহাচত্বরে এসে পৌছলো ।
প্রকৃতপক্ষে সিন ইউ ও তার সংগীরা ছিয়াং ছুন গণ সম্পর্ক বিদ্যালয়ের চত্বরে পৌছলো । এই বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা বহু আগে থেকেই সারিবদ্ধভাবে জাতীয় পতাকা উত্তোলোনের জন্যে অপেক্ষা করছিলেন । স্বেচ্ছাসেবীদের ভূমিকায় অভিনয় করা পর্যটকরা থিয়ান আন মেন মহাচত্বরের সেই রকম আসল দৃশ্য গড়ে তোলার জন্যে চেষ্টা করছিলেন ।
জাতীয় পতাকা রক্ষীদের মত স্বেচ্ছাসেবীরা সমানতরাল পদক্ষেপে উদাত্ত শ্লোগান দিতে দিতে জাতীয় সংগীতের মধ্যে সিন ইউর জন্যে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করলেন । সিন ইউর সংগীরা তার পাশে থেকে তার জন্যে চত্বরটির দৃশ্য ব্যাখ্যা করলেন ।
ছিয়াং ছুনের "শহুরে সন্ধ্যা" পত্রিকার সংবাদদাতা থাও পিন বরাবরই সিন ইউর পাশে ছিলেন এবং আগাগোড়াএই তত্পরতা দেখেছেন । তিনি বলেছেন ,
যখন জাতীয় পতাকা কিছুক্ষণের মধ্যে উত্তোলন করা হবে , তখন আমি প্রথমবারের মত দেখতে পেলাম , সিন ইউর মুখে আর হাসি ধরে না । সে হাত তুলে সালাম দিল । তবে তার হাতে বিন্দুমাত্র শক্তি ছিল না । তাসত্ত্বে সে তার হাত তুলল । শেষ পর্যন্ত সে তার হাত আর নামাতে পারল না ।
ভালোবাসা দিয়ে গল্প বানানোর তত্পরতা সাফল্যের সংগে শেষ হলেও আমাদের কাহিনী কিন্তু সমাপ্ত হয় নি । সিন ইউয়ের কাহিনী পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর পেইচিয়ে তার জন্যে আবার ভালোবাসার রিলে শুরু হয়েছে । সিন ইউকে সত্যিকারভাবে পেইচিংয়ে এনে একটি মস্তিষ্ক হাসপাতালে ভর্তি করানো হলো । ৮ ঘন্টার অপারেশনের পর সিন ইউকে অপারেশন রুম থেকে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো । তার প্রধান চিকিত্সক শি সিয়াং এন বলেছেন , তার অপারেশন সফল হয়েছে । তিনি বলেছেন ,
সাধারণভাবে বলতে গেলে আমরা এই অপারেশনে সন্তুষ্ট । অপারেশনের পর তার চেতনা স্পষ্ট এবং হাতপা নড়াচড়া করতে পারে । অবশ্য তার পুরোপুরি আরোগ্যের জন্যে আরো সময়ের দরকার ।
এমন মুহুর্তে সবাই কামনা করছেন যে , সকলের ভালোবাসা একটি বিস্ময় সৃষ্ট করবে ।
|