গত ১৫ মে তাইওয়ান প্রণালীর দুই তীরের বাণিজ্য ফোরাম পেইচিংয়ে সমাপ্ত হয়। তাতে দুই তীরের মধ্যে অর্থাত্ চীনের মূলভূভাগ ও তাইওয়ান অঞ্চলের মধ্যে আর্থ-বাণিজ্যিক আদানপ্রদান , কৃষি সহযোগিতা , সরাসরি বিমান ও জাহাজ চলাচল, পর্যটন ও ব্যাংকিং ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়েছে এবং দুপক্ষের মধ্যে অর্থনৈতিক আদানপ্রদান ও সহযোগিতা জোরদার ও সুগভীর করা সংক্রান্ত অভিন্ন প্রস্তাব প্রণীত হয়েছে। এই ফোরামে চীনের মূলভুভাগ পক্ষ তাইওয়ানবাসীদের কল্যাণের জন্য ১৫ দফা নীতি ও ব্যবস্থা ঘোষণা করেছে। ফোরোমে অংশগ্রহণকারীরা মন্তব্য করেছেন যে, অর্থনীতির বিশ্বায়নের জোয়ারের মুখোমুখী হয়ে প্রণালীর দুই তীরের উচিত পারস্পরিক উপকারিতামূলক সহযোগিতা সার্বিকভাবে সুগভীর করা এবং অভিন্ন সমৃদ্ধি বাস্তবায়ন করা।
অর্থনীতির বিশ্বায়ন এবং আঞ্চলিক অর্থনীতির একায়ন হলো বর্তমান বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাধারণ প্রবণতা এবং তা যেমন বিরাট সুযোগ ,তেমনি বিরাট চ্যালেঞ্জ। তাইওয়ানস্থ চীনের কুওমিনতাং পার্টির সাম্মানিক চেয়ারম্যান লিয়েন চান এবারকার ফোরামে বক্তৃতা দেয়ার সময়ে বলেছেন, এই পরিস্থিতির মুখোমুখী হয়ে তাইওয়ান প্রণালীর দুই তীরের উচিত নিজের উত্কৃষ্টতা দিয়ে অন্যের অভাব পূরণ করা, যাতে উভয়ের বিজয়ের লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা যায়। তিনি উদাহরণ হিসেবে ইণ্টেগ্রেটেড সার্কিট শিল্পের কথা তুলে ধরে বলেছেন, " আইসি ডিজাইন থেকে কারখানায় উত্পাদন পর্যন্ত মূলভূভাগ উন্নততর হবার জন্য পুরোদমে প্রয়াস চালাচ্ছে । পক্ষান্তরে তাইওয়ান এই ক্ষেত্রে এগিয়ে রয়েছে, তার এই শিল্পব্যবস্থা ইতিমধ্যেই খুবই পূর্ণাঙ্গ এবং বেশ পরিপক্ক।কিন্তু তাইওয়ানের বাজার খুবই ছোট, তার পণ্যের বিশ্ববিখ্যাত মার্কাও কখনও প্রতিষ্ঠিত হতে পারে নি। তাই দু'পক্ষের মধ্যে যদি উত্পাদন ও বিক্রয় এবং প্রযুক্তির ক্ষমতা, বাজারের ব্যাপকতা ইত্যাদি দিক থেকে পারস্পরিক সমন্বয় ও সহযোগিতা করা যায় , তা'হলে একবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে সবচেয়ে বিরাট বাণিজ্যিক সুযোগ পাওয়া যাবে ।"
গত শতাব্দীর ষাটের দশক থেকে অর্থাত্ ৪০ বছর ধরে তাইওয়ানের অর্থনীতি দ্রুত বেড়েছে, গড়পড়তা বৃদ্ধিহার ছিল ৯ শতাংশ। কিন্তু দু' হাজার সালে মিনচিং পার্টি ক্ষমতায় আসার পর তাইওয়ান সরকার বিচ্ছিন্নতাবাদী পথে চলেছে, অর্থনৈতিক উন্নয়নে কিছুই করতে পারে নি। ফলে বার্ষিক বৃদ্ধিহার কমতে কমতে শুধু ৩ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। পক্ষান্তরে বেকারত্বের হার ক্রমাগতই বাড়ছে। তাইওয়ানের চীনা অর্থনীতি একাডেমির উপদেষ্টা ইয়ে ওয়ান'আন মনে করেন , তাইওয়ান যদি মূলভূভাগের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার না করে, তা'হলে বিপদের প্রান্তে উপনীত হতে বাধ্য। তিনি বলেছেন, " সাম্প্রতিক ৬ বছরে তাইওয়ানের জনগণের আয় বাড়ে নি,তাই ভোগ বা ব্যয়ের ক্ষেত্রে তারা খুব রক্ষণশীল, তাতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা কম বলে বাইরের চাহিদার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। অর্থাত্ মূলভূভাগের সঙ্গে তার বাণিজ্যিক উদ্বৃত্তের ওপর পুরোপুরি নির্ভর করতে হচ্ছে। বর্তমানে বিশ্বের অর্থনীতির একায়নের প্রক্রিয়ায় চীনের মূলভূভাগ ও আসিয়ানের মধ্যে এবং আসিয়ান আর চীন, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার কাঠামো ক্রমেই গড়ে উঠছে । যদি তাইওয়ান এই কাঠামোর বাইরে কোণঠাসা হয়ে পড়ে, তা'হলে তার খুবই বিপদ হবে। তাই মূলভূভাগের সঙ্গে অবশ্যই সহযোগিতা করতে হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মূলভূভাগের সক্রীয় উত্সাহে দু' পক্ষের বাণিজ্য দ্রুত বেড়ে চলেছে। দু হাজার পাঁচ সালে তাইওয়ানের মোট বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৩৭১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, তার মধ্যে ৯১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হলো চীনের মূলভূভাগের সঙ্গে বাণিজ্য, তাতে তাইওয়ানের বাণিজ্যিক উদ্বৃত্ত ছিল ৫৮.১ বিলিয়ন ডলার।কিন্তু তাইওয়ান কর্তৃপক্ষের বাধা সৃষ্টি ও রাজনৈতিক হয়রানির দরুণ প্রণালীর দুই তীরের মধ্যে পুঁজির স্থানান্তরণ ও পণ্যপরিবহন শুধু পরোক্ষভাবে চলতে পারছে, মূলভূভাগের কোম্পানিকে তাইওয়ান দ্বীপে প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। এ সব সমস্যা ওখনও সমাধানসাপেক্ষ।
এই সব সমস্যা আলোচনার জন্যে এবার দুই তীরের চার শতাধিক বিশিষ্ট ব্যক্তি ফোরামে মিলিত হয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, দুই তীরের মধ্যে স্থিতিশীল অর্থনৈতিক সহযোগিতার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। বাণিজ্যে নানা রকম প্রতিবন্ধকতা দূর করতে হবে।
দুই অঞ্চলের মধ্যে এখন সরাসরি বিমান ও জাহাজ চলাচল ও পরিবহনের ব্যবস্থা চালু হয় নি, অন্য স্থান হয়েই মাল ও যাত্রী পরিবহন করতে হয়। যদি সরাসরি পরিবহন ব্যবস্থা চালু হয়, তা'হলে বছরে এক শো কোটি মার্কিন ডলারের পরিবহন খরচ বাঁচানো যাবে। এ প্রসঙ্গে চীনের সমাজ বিজ্ঞান একাডেমির তাইওয়ান বিষয়ক গবেষণাকেন্দ্রের কর্মকর্তা চাং কুয়ানহুয়া বলেছেন,
" দুই তীরের মধ্যে সরাসরি বিমান ও জাহাজ পরিবহন সার্বিকভাবে চালু হবার আগে তাইওয়ানের কয়েকটি বন্দর ও বিমানবন্দরে অবাধ বাণিজ্য অঞ্চল স্থাপন করা যায় এবং মূলভূভাগেও অনুরূপ অঞ্চল স্থাপন ও সম্প্রসারণ করা যায়। দুই তীরের মধ্যে আংশিকভাবে সরাসরি পরিবহন ব্যবস্থা চালু করা যায়। পেইচিং, সাংহাই, কুয়াংচৌ ইত্যাদি বড় শহর এবং তাইওয়ানের থাইপেই, থাইচোং, কাওসিয়ং শহরের মধ্যে সরাসরি বিমান ফ্লাইট চালু করা যাবে ।"
তাইওয়ানের অনেক কোম্পানি আগে মূলভূভাগের শ্রমঘণীভূত শিল্পে বেশি পুঁজি বিনিয়োগ করতো , এখন ক্রমে প্রযুক্তি-ঘণীভূত শিল্পক্ষেত্রে বেশি বিনিয়োগ করছে। চীনের জাতীয় গণ-রাজনৈতিক পরামর্শ সম্মেলনের চেয়ারম্যান চিয়া ছিংলিন এই ফোরামে বলেছেন, " পরবর্তীকালে দুই তীরের মধ্যে কতকগুলো গুরুত্বপূর্ণ শিল্পে আদানপ্রদান ও সহযোগিতা জোরদার করতে হবে, দুই তীরের মধ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত সম্পদের সমভাগী হবার উপযুক্ত ব্যবস্থা ও প্লাটফর্ম গড়ে তুলতে হবে । দুই তীরের মধ্যে ইলেক্ট্রোনিক তথ্য, অপ্টিকাল বিদ্যুত, জীববিদ্যা এবং কৃষি ইত্যাদি ক্ষেত্রে কর্মবণ্টন ও সহযোগিতা চালাতে এবং দুই তীরের মধ্যে হাইটেক শিল্পের বিন্যাস সমন্বিত করতে হবে। দুই পক্ষের অভিন্ন প্রযুক্তিগত মানদণ্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং চীনাদের নিজস্ব আন্তর্জাতিক মার্কা সৃষ্টি করতে হবে।"
তিনি জানিয়েছেন , মূলভূভাগের অর্থনীতি আগামী ৫ বছরে ৭.৫ শতাংশ হারে বাড়তে থাকবে, তাতে শুধু মূলভূভাগের জন্য নয় , বরং তাইওয়ানের জনসাধারণের জন্যেও বিরাট বাণিজ্যিক সুযোগ সৃষ্টি হবে ।
|