উত্তর চীনের হোপেই প্রদেশের থাং শান শহরে রয়েছে বৃদ্ধাদের নিয়ে গঠিত একটি চামড়ার পাপেট নাচ দল ।দলের সবচেয়ে প্রবীণ সদস্য কাও লানের বয়স ৭৪ বছর । গত দশ বারো বছরে অনেকের কাছে অপরিচিত চামড়ার পাপেট নাচ কাও লান ও তার নাচ দলের অন্য সদস্যদের দৈনন্দিন জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশে পরিণত হয়েছে । এ বছর চীনের কেন্দ্রীয় টেলিভিশন কেন্দ্রে প্রচারিত বসন্ত উত্সবের সান্ধ্য-সম্মিলনীতে " ছিয়াও সিইয়াং" নামক তাদের দলের পরিবেশিত চামড়ার পাপেট নাচ অচিরেই দর্শকদের সমাদর পেয়েছে ।
গাধা ও গরুর চামড়ায় মানুষ , সাজসজ্জা ও হাতিয়ার খোদাই করে সেগুলোর ছায়া পর্দার ওপর নিক্ষেপ করে চীনের ঐতিহ্যবাহী চামড়ার পাপেট শো দেখানো হয় । চামড়ার পাপেট নাচ শিল্পীদের নাচের ভংগিমা দিয়ে চামড়ার পাপেট শোর বৈশিষ্ট্য ফুটিয়ে তুলে । এ বছর চীনের কেন্দ্রীয় টিভি কেন্দ্রে প্রচারিত বসন্ত উত্সবের সান্ধ্য-সম্মিলনীতে " ছিয়াও সিইয়াং" নামক নাচ দলটি চামড়ার পাপেট নাচ দেখিয়েছে । এই নাচের আনন্দদায়ক ছন্দ ও প্রবল কৌতুক-নাটকের ফলশ্রুতি সম্মিলনীটির আনন্দপ্রদ পরিবেশকে আরো সরগরম করে তুলেছে । এই নাচ দলের সদস্যদের সবার বয়স সত্তরের কাছাকাছি । তাদের নাচ বহু দর্শককে বিমোহিত করেছে । পেইচিংয়ের মেয়ে চাং সিয়াও লে তাদের অন্যতম । তিনি আমাদের সংবাদদাতাকে বলেছেন ,
নাচ দল ছিয়াও সিইয়াংয়ের তো খুব মজা । আমি প্রথমবার এই চামড়ার পাপেট নাচ দেখেছি । আমার কাছে দারুণ লাগে । যেসব বৃদ্ধা নাচ করেছেন , তাদের তো বেশ বয়স হয়েছে । তবে তারা খুবই ভালোভাবে নেচেছেন । এ তো সহজ কথা নয় । আমি সত্যিই তাদের সম্মান করি ।
ছিয়াও সিইয়াং নাচ দলটি ১২জন সদস্য নিয়ে গঠিত । কাও লান এই দলের নেত্রী । কি কারণে কাও লান এতো বুড়ো বয়সেও হলেও মঞ্চে আরোহণ করেছেন ? তিনি আমাদের সংবাদদাতাকে তার তখনকার ধারণা ব্যক্ত করে বলেছেন ,
একদিকে শরীর চর্চার জন্যে , অন্যদিক অবসর নেয়ার পর আমার মনের নি:সংগতা ও নির্জনতা কাটিয়ে উঠার জন্যে আমি নাচ করতে শুরু করেছি ।
অবসর নেয়ার পর কাও লানের জীবন কিছু সময়ের জন্যে মন্দা অবস্থায় ছিল । পরে থাং শান শহরে প্রবীণদের বিশ্ববিদ্যালয় চালু হয় । নাচের প্রেমিক কাও লান এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাচের ক্লাসে ভর্তি হন । তাঁর নিজের চিন্তাভাবনা আছে । তিনি নিজের শিখা নাচ একসাথে শরীরচর্চায় অংশগ্রহণকারী বৃদ্ধাদের শিখাতে চান । তিনি বলেছেন ,
রোজ আমি প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাচের ক্লাস করি । তারপর আমি পার্কে ফিরে এসে আমার শিখা নাচ আমার সহচরদের শিখিয়ে দিই । তাদের সংগে মিশতে আমার বেশ ভালো লাগছে । আমি তাদের শিখাতে ইচ্ছুক । কেন না , ছোটবেলা থেকে আমি নাচতে পছন্দ করি।
আসতে আসতে প্রতিদিন ভোরবেলায় অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যক লোক কাও লানের কাছ থেকে নাচ শিখতে আসেন । দশ বছর আগে কাও লান ও তার সহচররা "ছিয়াও সিইয়াং নাচ দল গঠন করেন । নাচ দলটি গঠনের প্রথম বছরেই তাদের নাচ প্রবীণদের এক জাতীয় নাচ প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পেয়েছে । এই পুরস্কার পেয়ে কাও লান ও তার সহচররা অত্যন্ত আনন্দিত হন । এতে নাচ করার ব্যাপারে তাদের উত্সাহ-উদ্দীপনা আরো বেড়েছে । তখন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে মঞ্চে নাচ পরিবেশন করা তাদের সবচেয়ে বড় আকাংক্ষা হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
শেষ পর্যন্ত সুযোগ মিলল । ১৯৯৭ সালে থাং শান শহরে প্রবীণদের একটি শিল্পী দল গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয় । কাল বিলম্ব না করে ছিয়াও সিইয়াং নাচ দল তাতে যোগ দেয়ার জন্যে আবেদন করে । তবে শিল্পী দল বলেছিল যে, যাদের উচ্চতা ১.৬ মিটারের বেশি আর যাদের বয়স ৫৫ বছরের নীচে তাদের কেবল ভর্তি করা হবে । তার ওপর কাও লান ও তার সহচরদের নাচের মানও উন্নত ছিল না । অবশেষে তাদের নাচ দল বাদ পড়েছে ।
এই ঘটনার মধ্য দিয়ে কাও লান ও তার সহচররা নিজেদের দুর্বলতা দেখতে পেয়েছেন এবং উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, শিখানোর জন্যে বিশেষ পেশাদার শিক্ষক নিযোগ করতে হবে আর নাচ দলটির নিজের প্রতিনিধিত্বকারী নাচ থাকতে হবে । দৈবাত নাচ দলটির একজন সদস্যা একদা স্থানীয় প্রখ্যাত চামড়ার পাপেট নাচের শিক্ষক ফান চিন ছাইয়ের কাছ থেকে এই নাচ শিখেছিলেন । সুতরাং নাচ দলটি তাঁর কাছে গিয়ে পড়ল । তাদের অনুরোধ ফান চিন ছাইকে এক অসুবিধায় ফেলে দিল । তিনি আমাদের সংবাদদাতাকে বলেছেন ,
তখন আমি ১১ বছর ধরে চামড়ার পাপেট নাচ করে এসেছি । এসব বৃদ্ধাদের দেখে আমার ভাবনা হলো, তারা একেবারেই নাচের শিল্পীদের মত নন । নি:সন্দেহে তারা আমার নাচের কর্মকে পদদলিত করবে । কিন্তু তারা তাদের নাচ শিখানোর জন্যে আমার কাছে তারা একান্ত অনুরোধ করলেন । তাদের নিষ্ঠা আমাকে মুগ্ধ করেছে ।
অবশেষে ফান চিন ছাই তাদের অনুরোধ গ্রহণ করেন । তাঁর ছাত্রদের বয়স তার চেয়েও বেশি । পরবর্তীকালের প্রশিক্ষণ তাঁকে বিমোহিত করে । শিক্ষক ফান যতদূর সম্ভব নাচের ভংগিমার কঠিনতা বহুলাংশে কমিয়ে আনলেও এইসব বয়স্ক ছাত্রের জন্যেও দৈনন্দিন প্রশিক্ষণ বরাবরই ছিল একটি নিতান্ত কঠিন ব্যাপার । তাদের মধ্যে সবচেয়ে বয়স্ক কাও লানের কাছে আরো বেশি দু:খ-দুর্দশার শিকার হতে হয়েছে । সবার জন্যে অপরিচিত চামড়ার পাপেট নাচ ভালোভাবে শিখার জন্যে কাও লান কঠোর পরিশ্রম করেছেন । তিনি বলেছেন ,
রান্না করার সময়েও আমি নাচ চর্চা করি । বাড়িতে আমি সবসময় নাচের ভংগিমা করি । এমন কি হাটার সময়ও আমি নাচ করতে থাকি ।
আমাদের সংবাদদাতা লক্ষ্য করেছেন , নাচ করার সময়ে কাও লান ও তার সহচরদের মুখে যে হাসি ফুটে উঠে , তা বিশেষভাবে লোকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ।
|