বেশির ভাগ লোকের কাছে পানি খুবই স্বাভাবিক বিষয় । কিন্তু পশ্চিম চীনের ক্ষরা পীড়িত অঞ্চলে সাংঘাতিক পানির অভাব স্থানীয় কৃষক,বিশেষ করে নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যের উপর প্রভাব ফেলে । ২০০০সালে নিখিল চীন নারী ফেডারেশন ও চীনা নারী উন্নয়ন তহবিল সমিতির মিলিত উদ্যোগে আয়োজিত ভালবাসা নামে এক পানীয় জল প্রকল্প পশ্চিম চীনের গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করে। "মা নামক জলাধার"প্রকল্পটি ১১লক্ষ মানুষের পানীয় জলের অভাব মিটিয়েছে। এখন প্রকল্পটি আরও ব্যাপক ,আরও গভীরভাবে চালানো হচ্ছে ।
মুখ-গহবরে রাখা পানি থেকে কিছুটা হাতের মুঠোয় নেয় এবং তা দিয়ে চেহারার এক পাশ ধোয়,তার পর মুখের অবশিষ্ট পানি হাতের মুঠোয় নিয়ে তা দিয়ে চেহারার অন্যপাশ পরিস্কার করে । এধরণের মুখ ধোয়ার পদ্ধতি শ্রোতাবন্ধুরা হয়ত ভাবতেও পারেন না । কিন্তু উত্তর পশ্চিম চীনের শিশুরা এমন কি বয়স্করাও প্রত্যেক দিনে এভাবে চেহারা পরিস্কার করতেন । কারণ শুধু একটাই, তাহল পানির অভাব ।
চীন এক গুরতর জলাভাবগ্রস্ত দেশ এবং বিশ্বের সর্বাধিকজলাভাবগ্রস্ত ১৩টি দেশ বা অঞ্চলের একটি। উত্তর পশ্চিম চীনের অবস্থা বিশেষ গুরুতর । বিশ্বের মাথা পিছু জলসম্পদের পরিমাণ ৭৯০০ ঘনমিটার , কিন্তু উত্তর পশ্চিম চীনের ক্ষরা এলাকায় তা ১১০ ঘনমিটারেরও কম । সেখানে ৩০ লক্ষ মানুষের পানির সাংঘাতিক অভাব । এ জায়গাটি চীনে পানির সাংঘাতিক অভাবগ্রস্ত এলাকাগুলোর অন্যতম ।২০০০ সাল নিংসিয়া হুই স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের ইয়েনছি জেলার ওয়াং ল্যচিং থানার লাংতোংকৌ গ্রামে মাত্র ৪-৫বার বৃষ্টি পড়েছিল । দারুণ পানি-সংকটসৃষ্ট ক্ষরার কারণে খাদ্যশস্য মাত্র ১০-১২ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়ত । গোটা গ্রামের বৃষ্টির পানি সংগ্রহের আধার একেবারেই শুকিয়ে যায় ।
পানির অভাবে ১১ বছর বয়সী মেয়ে লি থাওথাও জীবনের শুরুতেই দুঃসহ বাস্তবতা ভূগতে হয় । পানির অভাবে কোনো খাদ্যশস্য বা ফসল হয়নি,বাধ্য হয়ে থাওথাওয়ের বাবা বাইরে গিয়ে কুলিগিরি করে পাওয়া যত্সামান্য আয় দিয়ে সংসার চালাতেন । আর থাওথাও প্রত্যেক দিন তার বোবা-কালা মার সঙ্গে গ্রামের বাইরের এক লোণাজলের কুপ থেকে পানি আনতে যেতো । আসতে-যেতে কমপক্ষে তিনঘন্টা লাগে । পানি থাওথাওয়ের মনে এক দুঃখজনক স্মৃতি হয়ে দাঁড়ায় ।
তেষ্টা মেটাবো , সেই পানিও নেই । ব্যবহার তো দূরের কথা । তাই আমার মনে কষ্ট ।
নিং সিয়া হুইজাতির স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলের সঙ্গে সংলগ্ন কানসু প্রদেশের তুংসিয়াং জেলার তাংথু গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রা লি থাওথাওদের চেয়েও কষ্টকর ছিল । পানি আনার জন্যে তাদের ১০-১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত লিউচিয়াসিয়া জলাধারে যেতে হত ।
চীনের নারী উন্নয়ন তহবিল সংস্থার উপ মহাসচিব ছিং কোইং এই জেলা পরিদর্শন করার সময় এমন এক ঘটনা ঘটে। তিনি বলেছেন,---৪---আমি এক জনের বাড়িতে যাই । পরিবারের মালিক আমাকে বাড়ির অবশিষ্ট অত্যল্প পানি খাওয়ালেন । পানি দেখে বাচ্চাটিও খেতে চাইলো । অসাবধানে পানি টেবিলে পড়েছে । মা রেগে তাকে মারতে চেয়েছেন। মার পিটুনি উপেক্ষা করে সে টেবিলে ঝুঁকে পড়ে টেবিলের পানি চেটে খেয়ে ফেলল ।এই দৃশ্য দেখে আমাদের অত্যন্ত দুঃখ হল ।
এখন তাংথু গ্রামবাসীদের আর বাইরে গিয়ে পানি আনতে হবে না । ২০০১ সালে চীনের নারী উন্নয়ন তহবিল সংস্থার আর্থিক সাহায্যে ২০৩টি কুপ খনন করা হয়েছে । ফলে আংশিক গ্রামবাসীদের দৈনিক ব্যবহার্য পানির সমস্যার সমাধান হয়েছে।
পানির অভাবে আগে গ্রামবাসীরা মাসে মাত্র একবার গোসল করতে পারতেন । এখন প্রত্যেক দিন গোসল করতে পারছেন । এখন অনেকে পানি আনার কষ্ট থেকে মুক্তি পেয়ে বাইরে উপার্জন করতে যান ।
২০০০ সালে জাতীয় নারী ফেডারেশন ও চীনের নারী উন্নয়ন তহবিল সংস্থা মিলিতভাবে ১০ লক্ষ রেনমিনপি সংগ্রহ করে "ভূমির প্রতি ভালবাসা-- মা নামক জলাধার তহবিল" প্রতিষ্ঠা করেছে এবং "মা নামক জলাধার" প্রকল্প চালু করেছে ।
"মা নামক জলাধার " মানে প্রথমে মাটিতে ২০-৩০ ঘনমিটার গর্ত খনন করে , তার দেয়ালে সিমেন্টের পলেস্তারা দিতে হয় , যাতে পানি মাটিতে শুঁষে ফেলতে না পারে এবং গর্তের বাইরে চারপাশে কয়েক ডজন বর্গমিটার এলাকার মাটিতে সিমেন্টের আস্তরণ দিতে হয়, যাতে পানি চার দিক থেকে বেয়ে বেয়ে গর্তে এসে ঢোকে । সাংঘাতিক জলাভাবগ্রস্ত অঞ্চলে বৃষ্টির পানি সংগ্রহের আধার খনন করা কার্যকরভাবেবৃষ্টি সম্পদ ব্যবহার করে পানি সংকট সমাধানের সবচেয়ে সহজ, সস্তা ও কার্যকরউপায় ।
একটি ত্রিশ ঘনমিটারের জলাধারে রাখা পানি তিন থেকে পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একপরিবারের মানুষ ও গবাদি পশুর একবছরের পানীয় জলের চাহিদা মেটাতে পারে । এখন সানসি, কানসু, নিংসিয়া, ছিংহাই, অন্তর্মঙ্গোলিয়া, সিছুয়ান প্রভৃতি দশাধিক প্রদেশে মোট এক লক্ষ বৃষ্টির পানি সংগ্রহের আধার খনন করা হয়েছে ।
চীনের জাতীয় নারী ফেডারেশনের ভাইস চেয়ারম্যান মো ওয়েনসিউ বলেছেন,প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর আমরা যেখানে যাই সেখানকার মানুষের মানসিক অবস্থা এবং তাদের থাকার পরিবেশের পরিবর্তন আমরা লক্ষ্য করেছি ।
মাদাম মো জানিয়েছেন, মা নামক জলাধার তহবিল প্রতিটি জলাধারের জন্যে গড়ে ১০০০ ইউয়ান বরাদ্দ করবে । বাকি অর্থ স্থানীয় সরকার সংগ্রহ করে ।
এবছরের শুরুতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর্যায়অর্থাত নিরাপদ পানিয় জলের নিশ্চয়তার পর্যায়ে প্রবেশ করেছে । মার্চ মাসে এটা কানসু, নিংসিয়া ও অন্তর্মঙ্গোলিয়ায় পরীক্ষামূলকভাবে চালু হবে।
চীনের সংক্রমক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রের গ্রামাঞ্চলের পানি বিভাগের পরিচালক থাও ইয়ুং বলেছেন,পানির নিরাপত্তার জন্যে প্রকল্পটি যে কাজ করেছে তার গুরুত্ব ও তাত্পর্য অপরিসীম ।
প্রকল্পটি অব্যাহতভাবে বাস্তবায়ন করা পশ্চিমাঞ্চলের ক্ষরা এলাকার এবং যেখানকার পানি অপরিস্কার সেখানকার নারী ও শিশুদের জন্যে আরও বেশি কল্যান বয়ে আনবে ।
|