১৯৯২ সালে কম্ব্যাট ক্যাপ ও নীল ইউনিফোর্ম পরিহিত চীনের সৈন্যরা প্রথমবার যুদ্ধবিধ্বস্ত কাম্পোডিয়ায় গিয়ে শান্তি রক্ষার দায়িত্ব পালন করেন । এর পরবর্তী বারো বছরে প্রায় দু হাজার আট শো চীনা সেনা ও তিনশো চীনা পুলিশ জাতি সংঘের অনুরোধে শান্তি রক্ষার দায়িত্ব পালন করেছেন ।
২০০৪ সালে সুদুর আফ্রিকার লাইবেরিয়ায় মোতায়েন জাতি সংঘের শান্তি রক্ষীবাহিনীতে চীনা সেনারা প্রথম জনদৃষ্টি আকর্ষন করেন। সম্প্রতি তাঁদের মধ্যকার একজন চীনা সামরিক চিকিত্সক ও চীনে তাঁর স্ত্রীর সাক্ষাতকার নিয়েছেন সি আর আইয়ের সংবাদদাতা ।
প্রাণচঞ্চল মাদাম ছু লিন পেইচিংয়ের একটি হাসপাতালে কাজ করেন। ২০০৪ সালের প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে তার প্রথম কাজ হলো , ই মেল বাক্স খুলে দেখা, তাঁর স্বামীর চিঠি এসেছে কিনা ।
তারঁ স্বামীর সর্বশেষ ই মেল চিঠিতে মাত্র কয়েক লাইন শব্দ। তিনি শুধু বলেছেন ,তিনি দায়িত্ব পালন করতে বেরিয়ে যাবেন, ছয় থেকে আটদিন বাইরে থাকবেন , তিনি আরো বলেছেন ,তিনি শিগ্গীরি দেশে ফিরে আসবেন ।আমি যেন ধৈর্য সহকারে তাঁর জন্য অপেক্ষা করি ।
ছুলিনের স্বামী নাম লি থান সি , তিনি চীনা গণ মুক্তি ফৌজের সাধারন হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিত্সক । গত বছরের বসন্ত কালে তিনি স্ত্রী ও ছেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চীনের পাঁচ শতাধিক সৈনিক ও সামরিক অফিসারের সংগে লাইবেরিয়ায় গিয়েছেন ।তাঁরা সেখানে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষীবাহিনী হিসেবে একবছর ধরে শান্তিরক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন ।
দশাধিক বছরের যুদ্ধে ধ্বংসপ্রাপ্ত লাইবেরিয়ার টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা নিতান্ত অনুন্নত । কাজেই ছুলিনকে প্রধানত: ইন্টারনেটের মাধ্যমে স্বামীর সংগে যোগাযোগ বজায় রাখতে হয়েছে। ছুলিন বলেছেন , গত এক বছরে তিনি স্বামীর কাছ থেকে তেমন বেশী চিঠি পান নি । যে ক'টি চিঠি পেয়েছেন তার প্রতিটি শব্দ গভীর উত্কন্ঠায় পরিপুর্ণ ।দশাধিক বছর হলো তাঁরা বিয়ে করেছেন । কিন্তু কখনো এবারের মত এতবেশী সময় ধরে আলাদা হয়ে থাকেন নি । স্বামী মাতৃভুমি ছেড়ে বিদেশে যাওয়ার পর তাঁর মন অধীর অস্থির । স্বামীর চিঠি পেয়ে তাঁর মন কিছুটা শান্ত হয় । অনেক দিন চিঠি না পেলে তাঁর বুকটা খুব ফাঁকা ফাঁকা লাগে । ছু লিন বলেছেন , তাঁর স্বামী শান্তিরক্ষীবাহিনীতে যোগদানের পর "শান্তিরক্ষা" এই দুটো চীনা শব্দ তাঁর মনে বিশেষভাবে পবিত্র হয়েছে ।
তাঁদের একমাত্র ছেলে লি হো ছেন পেইচিংয়ের একটি প্রসিদ্ধ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র । সুদর্শন লি হো ছেন বেশ লম্বা ,মুখ ফরসা, চোখে চশমা পরা । সকল বিষয়ের পরীক্ষায় সে ভাল ফল পেয়েছে । গণিতেরপরীক্ষার ফল সবচেয়ে ভালো ।
নববর্ষ আসন্ন । কিন্তু দশদিন হলো তাঁর স্বামীর কোনো খবর তিনি পান নি । চিকিত্সক লির শান্তিরক্ষীবাহিনীর স্যাটেলাইট টেলিফোন নম্বর পেয়ে সি আর আইয়ের সংবাদদাতা দুদিনে বিশ তিরিশ বার কল করে লাইন পেলেন । ফোনের অপর প্রান্ত থেকে চিকিত্সক লির জোরালো কন্ঠস্বর ভেসে এলো ।
তিনি বলেছেন:অর্ধেক বছরের প্রচেষ্টায় লাইবেরিয়ায় চীনা শান্তি রক্ষী বাহিনীর আবাসিক অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে । এখন আমাদের বিদ্যুত উত্পাদনের জেনারেটার ও হাসপাতাল আছে । আমাদের বাহিনী ইঞ্জিনিয়ারিং ,চিকিত্সা ও পরিবহন এই তিনটি বিভাগে বিভক্ত । আমাদের সাড়ে পাঁচশো সৈন্য ও সামরিক অফিসার লাইবেরিয়ার শান্তিরক্ষায় গুরুত্বপুর্ণ ভুমিকা পালন করছেন ।
চীনের শান্তিরক্ষীবাহিনী লাইবেরিয়ায় চার বছর থাকবে । ২০০৪ সাল ছিল লাইবেরিয়ায় চীনের শান্তিরক্ষীবাহিনীর শান্তিরক্ষার দায়িত্ব পালনের প্রথম বছর । ২০০৪সালের প্রথমার্ধে চীনের শান্তিরক্ষীবাহিনী ছ শো ষাট কিলোমিটার দীর্ঘ সড়কপথ মেরামত করেছে, একুশটি সেতু ও হেলিকপটার ওঠানামার তিনটি হেলিপ্যাড নির্মান করেছে এবং গাড়ি বা বিমানযোগে ষাট হাজার মানুষ ও দশ হাজার টন উপকরণ পাঠিয়েছে । যেটা নিয়ে চিকিত্সক লিথানসির সান্ত্বনা হয়েছে, তা হলো এই যে , চীনের সামরিক চিকিত্সকরা প্রায় তিন হাজার শান্তিরক্ষী সৈন্য, অফিসার ও স্থানীয় অধিবাসীদের প্রাণ বাঁচিয়েছেন বা রোগ নিরাময় করেছেন । তাঁদের হাসপাতালের আশেপাশের অধিবাসীরা স্বতস্ফুর্তভাবে জাতি সংঘের কাছে পাঠানো চিঠিগুলোতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন। সার্থকভাবে শান্তিরক্ষার দায়িত্বপালনের জন্য চীনের শান্তিরক্ষীবাহিনী জাতিসংঘের সম্মানসুচক শান্তি- পদক পেয়েছে ।
লাইবেরিয়া অতীতে ছিল একটি অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধিশালী দেশ।তার মাথাপিছু জিডিপি একসময়ে ছিল তিন হাজার মার্কিন ডলার । কিন্তু দশাধিক বছরের যুদ্ধ-বিগ্রহের অভিশাপে লাইবেরিয়া হয়েছে জীর্ণশীর্ণ । সর্বত্রই যুদ্ধাগ্নিদগ্ধ লাইবেরিয়ার ক্ষতচিহ্ন দেখে চিকিত্সক লিথানসি মর্মহত । সেই সংগে তিনি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন যে চীনের জনসাধারনের সুখশান্তি অত্যন্ত মুল্যবান ।
তিনি বলেছেন :লাইবেরিয়া এখন খুব গরীব । সাধারন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কোনো নিশ্চয়তা নেই । যুদ্ধের বয়ে আনা বিপর্যয় ভীতিপ্রদ । লাইবেরিয়ায় না এলে আমি বুঝতে পারতাম না , চীনের মত একটি বড় দেশের উন্নয়নের অগ্রগতির ধারা ,স্থিতিশীলতা এবং সমৃদ্ধি বজায় রাখা মোটেই সহজসাধ্য নয় ।
তিনি আরো বলেছেন , তিনি মনে করেন , তাঁর স্ত্রী ছু লিন স্নেহশীলা ও অতি করিতকর্মা । পরিবারের সমস্তকাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন করতে পারেন ।
তিনি বলেছেন :আমার স্ত্রীর সামর্থ্যের উপরে আমার অগাধ বিশ্বাস রয়েছে । তাই বিদেশে থেকে পরিবার সম্বন্ধে আমি নিশ্চিন্ত ।
শান্তি রক্ষার এক বছর সময় শিগ্গিরই ফুরিয়ে যাবে । চিকিত্সক লি বলেছেন ,তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা মাতৃভুমি ও যার যার স্বপ্ন-মধুর বাড়িতে ফিরে যাওয়ার দিনক্ষনের প্রত্যাশা করছেন ।
|