সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আর্থ-বাণিজ্য ক্ষেত্রে চীন ও রাশিয়ার মধ্যে আদান প্রদান আর সহযোগিতা ক্রমাগতই জোরদার হচ্ছে । তার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ হলো শক্তিসম্পদ সহযোগিতা। গত মার্চ মাসে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী পুটিনের চীন সফরকালে দুদেশের মধ্যে শক্তিসম্পদ সংক্রান্ত কয়েকটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে । তা দুদেশের শক্তিসম্পদ সহযোগিতা আরও বাড়ানোর এক গুরুত্বপূর্ণ নিশ্চয়তা।
মার্চ মাসে পেইচিংয়ে অনুষ্ঠিত চীন-রাশিয়া শিল্প ও বাণিজ্য মহলের শীর্ষ ফোরামে রাশিয়ার প্রেসিডেণ্ট পুটিন শক্তিসম্পদ ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতার কিছু তথ্য ফাঁস করে বলেছেন, "রাশিয়া সরকার পূর্ব-সাইবেরিয়া থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত তেলের পাইপ লাইন নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন রাশিয়া পাইপ লাইন কোম্পানি এবং চীনের তেল ও গ্যাস কোম্পানির মধ্যে সংশ্লিষ্ট চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে । তাতে পাইপ লাইনের চীনা শাখা লাইন নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা হবে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে তা চীনের কাছে তেল সরবরাহ বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। প্রাকৃতিক গ্যাস ক্ষেত্রেও সহযোগিতার ভবিষ্যত্ সম্ভাবনা খুবই বিরাট। এ সম্পর্কে দুদেশের কোম্পানির মধ্যেই দলিলপত্র স্বাক্ষরিত হয়েছে। আমরা দুদেশের গ্যাস পাইপ লাইন নির্মাণ ও সংযোগ স্থাপনের কয়েকটি পদ্ধতি গবেষণা করছি। তার একটি হলো পশ্চিম সাইবেরিয়া লাইন , অন্যটি হলো পূর্ব সাইবেরিয়া লাইন।"
২০০৫ সালে রাশিয়া রেল পথে চীনের কাছে ৮০ লক্ষ টন তেল সরবরাহ করেছে । এই পরিমাণ চীনের মোট তেল আমদানীর খুব ছোট এক অংশ মাত্র। বর্তমানে রাশিয়ার তেল প্রধানত ইউরোপে রপ্তানী করা হয়, এশিয়ায় তার তেল ও গ্যাস সরবরাহের গতি খুবই মন্থর।
পুটিনের চীন সফরকালে দুদেশের স্বাক্ষরিত শক্তিসম্পদ সহযোগিতা চুক্তি প্রসংগে চীনের সমাজ বিজ্ঞান একাডেমির রাশিয়া সমস্যা বিশেষজ্ঞ মাদাম লি চিয়েনমিন বলেছেন, " চীনের অর্থনৈতিক উন্নয়ন খুবই দ্রুত, ফলে তেলের চাহিদা ক্রমাগতই বাড়ছে। দেশের তেলসম্পদ চাহিদার তুলনায় কম বলে আমদানি করা প্রয়োজন। পক্ষান্তরে রাশিয়ার প্রচুর শক্তিসম্পদ আছে। এ ক্ষেত্রে দুপক্ষের স্বার্থের অনেক মিল আছে । এবার স্বাক্ষরিত চুক্তি দুদেশের শক্তিসম্পদ সহযোগিতায় দিশা দেখিয়ে দিয়েছে এবং সেই দিকে এক বাস্তব ধাপ এগিয়েছে ।"
এই বিশেষজ্ঞ ব্যাখ্যা করেছেন, চুক্তি অনুযায়ী চীন-রাশিয়া গ্যাস পাইপ লাইন নির্মিত হবার পর রাশিয়া প্রতি বছর চীনের কাছে ৮০ বিলিয়ন কিউবিক মিটার গ্যাস রপ্তানী করবে । এই পরিমাণ ইউরোপে রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানীর ৫০ শতাংশেরও বেশি। দুদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত তেল পাইপ লাইনের শাখা লাইন প্রকল্পে পুঁজি বিনিয়োগ সংক্রান্ত বৈঠকের স্মারকলিপির ওপর দুদেশের সরকার উচ্চ পর্যায়ের গুরুত্ব আরোপ করেছে । চীনের তেল কোম্পানির জেনারেল ম্যানেজার ছেন কেং এ সম্পর্কে বলেছেন, "সম্প্রতি রাশিয়া সরকার পূর্ব সাইবেরিয়া থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত তেল পাইপ লাইন নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন করেছে, তাতে চীন-রাশিয়া তেল পাইপ লাইন নির্মাণের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে। আমরা এই শাখা লাইন প্রকল্প নির্মাণ ত্বরান্বিত করার জন্য রাশিয়ার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে পরামর্শ করতে চাই। আমাদের পরিকল্পনা রাশিয়ার প্রধান পাইপ লাইন নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গে চীনের জন্যেও শাখা লাইন চালু করা।"
তা'ছাড়া দুদেশের মধ্যে পরস্পরের ভূভাগে যৌথ শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন , রাশিয়ায় তেল অনুসন্ধান ও উন্নয়নে সহযোগিতা এবং চীনে তেল শোধন ও প্রক্রিয়াকরণ আর বিক্রয়ের একায়নে সহযোগিতার নীতিগত চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়েছে। দুদেশের তেল কোম্পানির যৌথ উদ্যোগে রাশিয়ার তেল ও গ্যাসসম্পদ উন্নয়ন করার ব্যাপারে রাশিয়া সম্মতি জানিয়েছে। তা'ছাড়া দুদেশের যৌথ উদ্যোগে চীনে তেল শোধন ও পেট্রোল বিক্রীর যৌথ শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে।"
চীনের রাষ্ট্রীয় উন্নয়ন ও সংস্কার কমিটির চেয়ারম্যান মা খাই এই সহযোগিতা চুক্তি সম্পর্কে বলেছেন, "আমরা আনন্দের সঙ্গে দেখেছি, তেল ও গ্যাস ক্ষেত্রে দুপক্ষের সহযোগিতা তেল বাণিজ্য থেকে তেল সম্পদ উন্নয়ন ও প্রক্রিয়াকরণ এবং বিক্রীর ক্ষেত্রে বিস্তার লাভ করেছে। এই প্রবনতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, চীন -রাশিয়া শক্তিসম্পদ সহযোগিতা বহুমুখী উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যাবে। দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিতে এই সহযোগিতার আওতা আরও প্রসারিত হওয়া, আরও বেশি পদ্ধতি গ্রহণ করা এবং আরও স্থিতিশীল ও ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার সম্পর্ক গড়ে তালা উচিত। দুপক্ষের মধ্যে প্রধানত তেল , গ্যাস ও বিদ্যুত্ ক্ষেত্রে সহযোগিতা করা ছাড়াও কয়লা, নতুন শক্তিসম্পদ উন্নয়ন এবং শক্তি সাশ্রয় ইত্যাদি ক্ষেত্রেও সার্বিকভাবে সহযোগিতা চালানো হবে।"
পুটিনের চীন সফরকালে আয়োজিত দুদেশের শিল্প ও বাণিজ্য মহলের শীর্ষফোরামে শক্তিসম্পদ, পুঁজি বিনিয়োগ , ব্যাংকিং , পরিবহণ ইত্যাদি অনেক ক্ষেত্রে সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। তা'ছাড়াও বৈদ্যুতিক যন্ত্রসরঞ্জাম রপ্তানী এবং বড় বড় প্রকল্পে পুঁজিবিনিয়োগ নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
ফোরামে ভাষণ দেয়ার সময়ে চীনের প্রেসিডেণ্ট হু চিনথাও বলেছেন, "চীন ও রাশিয়ার উচিত যথাশীঘ্র দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে বৈদ্যুতিক সামগ্রীর অনুপাত বাড়িয়ে দেয়া, ধাপে ধাপে শক্তিসম্পদ ধরনের দ্রব্যের বাণিজ্য বাড়ানো, ঘরোয়া বৈদ্যুতিক সামগ্রী, টেলিকমিউনিকেশন, অবকাঠামো নির্মাণ এবং তেল, গ্যাস , বনশিল্প, খনিজ সম্পদ উন্নয়ন ও প্রক্রিয়াকরণ ক্ষেত্রে দ্বিপাক্ষিক পুঁজি বিনিয়োগ বাড়িয়ে দেয়া, বিমান ও মহাকাশ যান , যন্ত্র নির্মাণ, পরমাণু শক্তি, নতুন উপকরণ, জীববিদ্যা প্রযুক্তি ইত্যাদি ক্ষেত্রে গবেষণার ফলাফলকে শিল্পে রূপান্তরের ক্ষেত্রে সহযোগিতা চালানো এবং প্রযুক্তিবিদ বিনিময় করা।"
গত বছর চীন ও রাশিয়ার বাণিজ্যের মোট পরিমাণ ৩০ শতাংশ বেড়ে ২৯.১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে । ২০১০ সালে তা ৬০ থেকে ৮০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হবার লক্ষ্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব।
|