উত্তর পুর্ব চীনের জি লিন প্রদেশে সিয়াং হাই নামে এক খন্ড জলাভুমি আছে । প্রতি বছরের গ্রীষ্মকালের শেষদিক ও শরত্কালের প্রথম দিকে সিয়াং হাই জলাভুমি পাখির আনন্দধামে পরিণত হয় । সেখানে পাখি সংরক্ষনে নিয়োজিত অধিবাসীদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে । লিন বাও ছিং তাঁদের মধ্যে একজন ।
পশ্চিম জিলিন প্রদেশের বিশাল কোরসিন তৃণভূমিতে অবস্থিত সিয়াং হাই জলাভূমি জাতীয় পর্যায়ে চীনের অন্যতম পাখি সংরক্ষণ এলাকা ।তার আয়তন প্রায় এক লক্ষ হেক্টর । সেখানকার ছোটো বড় অনেক হ্রদে কাশ জন্মে । বিলুপ্ত প্রায় সাদা প্রাচ্য বক ও লাল ঝুঁটি-বক সহ প্রায় তিনশো জাতের পাখি সেখানে থাকে ।
সুদর্শন লাল ঝুঁটি- বক নিয়ে ৩২ বছর বয়সী লিন বাও ছিংয়ের পাখি সংরক্ষনের সুত্রপাত । ১৯৯৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হওয়ার পর তিনি সিয়াংহাই প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকায় চাকরি করতে যান । যখন জানতে পেলেন , সারা পৃথিবীতে লাল ঝুঁটি- বকের সংখ্যা দেড় হাজারেরও কম , তখন এই সুন্দর প্রাণীর প্রতি তাঁর মমতা মুহূর্তেই আরো গভীর হলো ।
১৯৯৭ সালের বসন্তকালের একদিন ,তিনি আবিস্কার করলেন , দুটো লাল ঝুঁটি- বক ডিমে তা দিচ্ছে । তিনি দূর থেকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন ।
তিনি বলেছেন ,অবশেষে ডিম ফুটে বকের বাচ্চা বের হল । কিন্তু স্থানীয কৃষকের একটি গরু হঠাত শিং দিয়ে গুঁতিয়ে তাকে মেরে ফেলে। তা দেখে আমি মর্মাহত হলাম ।মনে মনে সংকল্প নিলাম ,আমি কৃত্রিম উপায়ে বকপাখি লালন করব এবং বিলুপ্তির কবল থেকে বকপাখি রক্ষা করব ।
লিন বাও ছিং সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , এক জোড়া বন্য লাল ঝুঁটি-বক বছরে শুধু দুটো ডিম পাড়ে । পরিবেশ নিরাপদ না হলে তাদের একটি বাচ্চাও বাঁচতে পারবে না । আমি স্থির করলাম , নিজের প্রচেষ্টায় লাল ঝুঁটি- বকের ডিমে তা দেয়া সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করব ।
লাল ঝুঁটি-বকের নীড় কাশবনে বা ঝোপে । বংশবিস্তারের সময়ে লাল ঝুঁটি-বক অতি সতর্ক । বিপদের সংকেত পাওয়া মাত্র নীড় ছেড়ে পালিয়ে যায় । লিন বাও ছিং অনেক কষ্টে একটি নীড়ের সন্ধান পেলেন এবং মা বকের অনুপস্থিতিতে নীড়ের শুকনো খড়ের নীচে থার্মোমিটার ও হাইড্রামিটার রেখে দিলেন । তারপর অদুরে গোপন ঝুপড়ি বেঁধে তাতে আশ্রয় নিলেন । এপ্রিল মাস লাল ঝুঁটি-বকের বংশবিস্তারের মওসুম । তখন সিয়াং হাইয়ের হ্রদের বরফও গলতে শুরু করে । বকপাখি যাতে ভয় না পায় তার জন্য তিনি রাতদিন ঝুপড়ির ভেতরে লুকিয়ে থাকেন ।
তিনি বলেছেন , ঝুপড়ির ভেতরে ভীষণ ঠান্ডা , পানিতে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে জল প্রতিরোধক প্যান্ট ছিঁড়ে গেল । তবু ভেতর থেকে বেরিয়ে আসি নি । শেষ পর্যন্ত মু্ল্যবান তথ্য পাওয়া গেল ।
লাল ঝুঁটি- বকের ডিমে তা দেয়ার উপযুক্ত তাপমাত্রা আর আর্দ্রতা জানার পর লিন বাও ছিং কৃত্রিম উপায়ে বকপাখির বংশবিস্তারের পরীক্ষা শুরু করলেন । তাঁর শুধু একটি ডিমে তা দেয়ার আধা-স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ছিল । একমাসের বেশী সময়ে ডীমে তা দিতে হবে বলে রোজ যন্ত্রটির পাশে তাঁকে থাকতে হয় ।দুই তিন দিন হঠাত বিদ্যুত সরবরাহ বন্ধ হয় ,তিনি অবিলম্বে ডিমগুলো তুলা গাদানো -লেপের নীচে নিয়ে যান এবং নিজের গায়ের তাপে ডিমে তা দেন ।
এক বছর ধরে পরীক্ষা চালানোর পর ১৯৯৯ সালের মে মাসে লিন বাও ছিংয়ের হাতে ডিম ফুটে লাল ঝুঁটির বকের একটা বাচ্চা বক বেরিয়ে এল । তার মিষ্টি ডাক শুনে লিন বাও ছিং আনন্দে নেচে উঠলেন । তাঁর সহকর্মীরা তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে ঠাট্টা করে বললেন ,তিনি বকপাখির বাবা হয়েছেন ।
"বকের বাবার" ভুমিকায় অবতীর্ণ হওয়ায় বাড়ির কর্তার ভুমিকা পালনের সময় তাঁর আর পাওয়া গেল না । বাড়ির সমস্ত কাজ সেরে নিতে হয় তাঁর স্ত্রীকে । এই জন্য তিনি লজ্জিত বোধ করেন । কিন্তু যেটা নিয়ে তিনি গর্বিত তা হলো এই যে ,তিনি কৃত্রিম উপায়ে ১৫ জাতের পাখির বংশবিস্তারের প্রযুক্তি আয়ত্ত করেছেন । গত পাঁচ বছরে তিনি সার্থকভাবে জাতীয় পর্যায়ে সংরক্ষিত প্রথম শ্রেণীর চুল্লিশাধিক লাল ঝুঁটি- বক ও সাদা প্রাচ্য বক এবং বাইজেন নামক দুশতাধিক বক ও বন্য হাঁস পালন করেছেন । পাখির বংশ বিস্তারের উপরে তাঁর লেখা প্রবন্ধগুলো প্রাণীবিদ্যা বিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়েছে।
জিলিন প্রদেশের সিয়াং হাই প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকার জলাভুমি শুধু যে নানা জাতের পাখির বাসস্থান তা নয় , প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের যাযাবর পাখিদের যাত্রাপথে বিশ্রাম নেয়ার একটি স্থানও বটে ।যাযাবর পাখি কখনো কখনো ভ্রম করে বিষাক্ত খাদ্য খায়, কখনো কখনো লক্ষ্যচ্যুত গুলিতে আহত হয় । এই কারণেই বছরখানেক আগে , সিয়াং হাই প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকায় পক্ষী চিকিত্সা কেন্দ্র খোলা হয়েছে । লিন বাও ছিং এই কেন্দ্রের প্রধান । বিষাক্ত খাদ্য খাওয়া পাখি ও আহত পাখি চিকিত্সা করানো এখন তাঁর আরেকটি কঠিন কর্তব্য । তারঁ সহকর্মী লিউ ই এই প্রসঙ্গে বলেছেন : মাসখানেক আগেকার কথা । সুয়াংলিউ শহরের একজন নাগরিক টেলিফোনে তাঁকে জানালেন যে , সেখানে একটি রুগ্ন লাল ঝুঁটি- বক আবিস্কৃত হয়েছে। এখান থেকে সুয়াংলিউ শহর তিনশো কিলোমিটার দূরে । লিন বাও ছিং গাড়িতে করে সেখানে গিয়ে দেখলেন , বকটি বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হয়েছে ।কালবিলম্ব না করে তিনি বকটির জন্য ইন্জেকশন দিলেন এবং জোর করে ঔষুধ খাওয়ালেন । এরপর এই বক নিরাপদে তাঁর সঙ্গে সিয়াং হাই প্রাকৃতিক সংরক্ষণ এলাকায় ফিরে যায় এবং সেখানে তার দুটো বাচ্চাও হয়। শরতকালে দুটো বাচ্চা নিয়ে বকটি দক্ষিণাঞ্চলে উড়ে যায় ।
লিন বাও ছিং রুগ্ন বক বাঁচানোর অনেকগুলো প্রকৌশল উদ্ভাবন করেছেন । তিনি ও তাঁর সহকর্মীরা এতদিনে পঞ্চাশটির বেশী রুগ্ন বক বাঁচিয়েছেন ।কেউ তাঁকে পাখি সংরক্ষনের বিশেষজ্ঞ বলে প্রশংসা করলে তিনি হাসতে হাসতে বলেন , পাখি আমাদের মানব জাতির ভালো বন্ধু , পাখি রক্ষার মানে মানব জাতির বাসস্থান রক্ষা করা।
|