চীনের বহু সংখ্যালঘু জাতির মধ্যে নাসি জাতির একটি শাখা -মু সু উপজাতির নারী -পুরুষের মধ্যে বিয়ে ছাড়াই সহবাস রীতিনীতি প্রচলিত বলে সুবিদিত । মু সু লোকেরা বংশপরম্পরায় দক্ষিণ-পশ্চিম চীনের লু কু হ্রদের ধারে বাস করেন । কিছু কিছু গ্রামে এখনো প্রাচীন মাতৃশাসিত পরিবার ব্যবস্থা চালু আছে । ছেলে মেয়েরা মায়ের সংগে এক সাথে থাকেন । মাতৃশাসিত পরিবার ব্যবস্থা অনুযায়ী , নারী ও পুরুষ বিয়ে করেন না , তাদের মধ্যে শুধু সহবাসের সম্পর্ক সংরক্ষিত আছে ।
সান ছু মু সু উপজাতির এমন একজন পুরুষ , যিনি ছোট বেলা থেকে লু হু হ্রদের ধারে থাকেন । তিনি ফিটফাট , উপজাতিতে তার পরিবারের সুনামও আছে । লোকেরা আন্তরিকতার সংগে তাকে 'মু সু রাজপুত্র' ডাকেন । তার অনন্য তারুণ্য স্থানীয় মেয়েদের আর লু কু হ্রদ ভ্রমণে আসা নারী পর্যটকদের আকৃষ্ট করেছে । তিন মাস আগে ৩০ বছর বয়স্ক সান ছু পেইচিংয়ে এসেছেন । তিনি বলেছেন ,
অভিনয়কে পেশা করার জন্য তিনি পেইচিংয়ে এসেছেন । কিন্তু তিনি এই পেশায় ঢুকতে পারেন নি । তিনি ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং এক সময় মদের দোকানে গায়ক হিসেবে চাকরি করেছেন ।
পেইচিংয়ে সংখ্যালঘু জাতির ঘোর বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন একটি মদের দোকানে তিনি আবেগের সংগে তার পেইচিং জীবনযাপন , নিজের জন্মস্থান আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা প্রসংগে বলেছেন । তিনি পেইচিংয়ে এসেছেন , শুধু তিন মাস হল , কিন্তু তিনি ভাল চীনা বলতে পারেন । তিনি পেইচিংয়ে গায়ক আর অভিনেতার চাকরি করতে চেয়েছেন । তবু এ পর্যন্ত তার এই দুই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয় নি ।
বর্তমানে সান ছু পেইচিং শহরাঞ্চলের উত্তর-পূর্বাংশের মাদামি নামে একটি মদের দোকানে থাকেন । তিনি দোকানের জন্য মু সু নাচ গান পরিবেশনের ব্যবস্থাপনা করেন । সন্ধ্যায় তিনি অতিথিদের জন্য গান পরিবেশন করেন । মদের দোকানের মালিক মু সু সংস্কৃতি খুব ভালবাসেন । তিনি বহুবার লু কু হ্রদ ভ্রমণে গিয়েছিলেন ।
অবশেষে তিনি পেইচিংয়ে মু সু রীতিনীতিসম্পন্ন এই মদের দোকান খুলেছেন ।
মাদামি মদের দোকানে মোট দশাধিক মু সু লোক আছেন । তারা প্রধানতঃ মু সু নাচ গান পরিবেশন করেন । সান ছু বলেছেন , আসলে অধিকাংশ মুসু লোক তাদের জন্মভূমি-লু কু হ্রদ ত্যাগ করতে চান না ।
মু সু উপজাতি অধ্যুষিত অঞ্চলেও এখনো মাতৃশাসিত পরিবার বিষয়ক ব্যবস্থা প্রচলিত । মু সু লোকদের প্রত্যেক পরিবারে কমপক্ষে সাত আট জন , বেশি পক্ষে বিশ তিরিশ জন আছেন । পরিবারিক কাজ আর দায়িত্ব সবাই বহন করেন । জীবনে তাদের বেশি চাপ এবং সবাই সম্প্রীতিতে থাকেন । যখন সপরিবারে উনুনের চার দিকে বসে থাকেন , তখন তারা আনন্দের সংগে কথাবার্তা বলেন , মদ খান আর গল্প করেন , তাদের বাসা খুবই ঘরোয়া পরিবেশে পরিপূর্ণ ।
সান ছু বলেছেন , সহবাস ব্যবস্থা চালু হবার কারণে পুরুষ আর নারী যার যার বাড়িতে থাকেন । তাদের বাচ্চারা ছোট বেলা থেকে নারী পক্ষের বাসায় জীবনযাপন করে । পরিবার লালন পালনের দায়িত্ব আর চাপ মু সু পুরুষদের নেই । মু সু পুরুষদের তাদের উষ্ণ উনুন , ঘরোয়া সম্প্রীতি খুব ভাল লাগে । ফলে বহু কৃতী মু সু পুরুষ অলস হয়েছেন । তারা বাইরে যেতে চান না ।
পেইচিংয়ে আসার আগে জন্মভূমি-লু কু হ্রদের ধারে সান ছুর জীবনযাপনও মন্দ ছিল না । তিনি নৃত্য শিখেছেন । মু সু নাচ গান অভিনয় করার জন্য তিনি একটি স্থানীয় নৃত্য শিল্পী দল গঠন করেছেন । জন্মভূমিতে তিনি মু সু উপজাতির বেশ কয়েকটি ঐতিহ্যিক কাঠের বাড়িঘরও নির্মাণ করেছেন । এই ধরণের বাড়িঘরের দেয়াল আর ছাদ সম্পূর্ণভাবে কাঠ দিয়ে তৈরী করা হয় । এই ধরণের বাড়িঘরে থাকলে মু সু লোকদের ঘরোয়া পরিবেশ অনুভব করা যায় । চলচ্চিত্র আর টেলিভিশন নাটক তোলার জন্য চীনের অভ্যন্তরভাগের বেশ কয়েকজন পরিচালক লুকু অঞ্চলে এসেছিলেন । তারা সান ছুকে পছন্দ করেছেন । চলচ্চিত্র আর টেলিভিশন নাটক পরিবেশন করার জন্য তাকে আমন্ত্রণ জানানো হয় । দু'বার অভিনয় করার পর গান গাওয়া আর অভিনয় করার ক্ষেত্রে সান ছুর আস্থা আর দক্ষতা আরো বেড়ে গেছে । নিজের শিল্প প্রতিভা আর ভবিষ্যত আরো সম্প্রসারিত করার জন্য তিনি রাজধানী পেইচিংয়ে এসেছেন ।
পেইচিংয়ে আসার পর তিনি লক্ষ্য করেছেন , আসলে পেইচিং একটি মহানগরী , এখানে শিল্পী বেশি , প্রতিদ্বন্দ্বিতাও প্রবল । একজন পেশাগত গায়ক বা অভিনেতা হওয়া খুব সহজ নয় । পেশাগত শিল্পীর চাকরি পাওয়ার জন্য তিনি অনেক প্রচেষ্টা চালিয়েছেন , কিন্তু তার সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে ।
এতক্ষণ আপনারা যা শুনেছেন , তা সান ছুর গাওয়া মু সু নারী ও পুরুষের প্রেমের কাহিনী সম্পর্কিত গান । গানের সুরে রাতে নারী ও পুরুষের মধ্যে আবেগ আর আনন্দময় অনুভূতি তুলে ধরা হয়েছে । মাদামি মদের দোকানে সান ছু প্রায় প্রত্যেক রাতে এই গান পরিবেশন করেন । তবু মু সু লোকদের সম্পর্কিত গান এত বেশি নেই বলে সান ছু ও তার সংগীরা অন্যান্য জাতির লোক সংগীত আর অন্য জনপ্রিয় গানও পরিবেশন করেন ।
পেইচিং অবস্থানকালে সান ছু কিছু সংখ্যক বন্ধু বান্ধবের সংগে পরিচিত হয়েছেন । এর মধ্যে ওয়া জাতির গায়ক আই মাং তার ওপর ব্যাপক প্রভান ফেলেছেন । আই মাং পেইচিংয়ে এসেছেন দশ বছর হল । তিনি এই মহানগরীতে সংখ্যালঘু জাতির লোক সংগীত জনপ্রিয় করতে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছেন । এ পর্যন্ত আই মাং যে সব গানের কথা ও সুর রচনা করেছেন আর সে সব গান গেয়েছেন , তা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের মধ্যে সমাদর পেয়েছে ।
সান ছু তো মু সু উপজাতির লোক । তিনি পেইচিংয়ে তিন মাসে অবস্থানের পর জন্মভূমিতে ফিরে যাবেন । তিনি বলেছেন , তিনি যদিও গায়ক ও অভিনেতা হন নি , কিন্তু তিনি নিজের দুর্বলতা জানতে পেরেছেন । লু কু হ্রদ অঞ্চলে ফিরে যাওয়ার পর তিনি অন্যদের সংগে একটি ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠা করবেন । এতে ৪০ হাজার জনেরও বেশি মু সু লোকের অতীত ও বর্তমান পরিচয় করে দেয়া হবে , যাতে আরো বেশি লোক এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মু সু লোক সম্পর্কে জানতে পারবেন । তিনি মু সু লোকদের নিছক বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন কিছু কিছু লোক সংগীত সংগ্রহ করে তাদের প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে আরো সুন্দর করে দেবেন । তখন তিনি পেইচিংয়ে ফিরে তার সংগীত ও ওয়েবসাইট জনপ্রিয় করে তুলেছেন ।
|