চীনের তিব্বত স্বায়ত্ত- শাসিত অঞ্চলের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিরামো জেলায় চুয়ানমু থানা নামে একটি সীমান্ত ছোট থানা পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত হয়েছে । থানাটি চীনের রাষ্ট্রীয় প্রথম পর্যায়ের স্থল বন্দর হিসেবে মনে করা হয় । এই থানা যেমন চীন-নেপাল সীমান্ত বাণিজ্য সজীব করে তোলার জন্য দেশ-বিদেশে সুবিদিত , তেমনি এই থানায় বসবাসকারী এক হাজারেরও বেশি শেরপা বহিরাগত লোকদের মনোযোগ আকৃষ্ট করছে ।
প্রতিদিন ভোরে ৭১ বছর বয়স্ক তোপোলার বাবা ঘুম থেকে উঠার পর নিকটবর্তী একটি মন্দিরে উপাসনা করতে যান । তিনি মন্দিরের মাখন প্রদীপের জন্য মাখন যুগিয়ে দেন । বাড়িতে ফিরে আসার পর বৃদ্ধ বাসার সামনের দিকে বসে মাখন চা খেতে পছন্দ করেন । চা খেতে খেতে তিনি এক মিটার দূরের পাহাড়ের দৃশ্য উপভোগ করতে পছন্দ করেন । ওখানে বসবাসকারী শেরপাদের মধ্যে অনেকে তার আত্মীয় স্বজন ও বন্ধু বান্ধব ।
বুড়ো তোপোলার বাড়ি চুয়ানমু থানার নবনির্মিত একটি গ্রামে অবস্থিত । চুয়ানমু থানার ১১২টি শেরপা পরিবার সমুদ্র-সমতলের চেয়ে ২৩০০ মিটার উঁচুতে বাস করে । তাদের সংখ্যা প্রায় ৫ শো । পাহাড়ের উপরে শেরপাদের ঐতিহ্যিক টিনের বাসা ছাড়া সিঁড়ির মতো আবাদী জমিতে আলু ইত্যাদি শস্য চাষ করা হয় । তার একজন প্রতিবেশীর নতুন বাড়ি নির্মাণ করা হচ্ছিল । তার বাসার সামনের সড়কপথ দেখিয়ে তিনি সংবাদদাতাকে বলেছেন ,
তিনি এখানেই জন্ম গ্রহণ করেছেন । আগে এখানে কোনো যানবাহন ছিল না । মানুষের শ্রম শক্তির উপর নির্ভর করে লবণ আর চা বহন করা হতো । লোকেরা ৩০ কিলোমিটার দূরে নিরামু থেকে এ সব প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য পিঠে করে নেপালে পাঠাতেন , তার পর তারা নেপাল থেকে চা তিব্বতে নিয়ে আসতেন । তারা তিব্বতী ষাঁড়ের মতো পরিশ্রম করতেন , একবার আসা যাওয়া আর পাহাড়ে আরোহণ করার জন্য তাদের ১০ দিনের মতো সময় লাগতো । এই অতীত তাদের মনে এখনো অবিস্মরণীয় ।
বুড়ো তোপোলা বলেছেন , তা অর্ধেক শতাব্দি আগের জীবনযাপনের পরিচায়ক । শেরপারা বংশপরম্পরায় চীন-নেপাল সীমান্তে বাস করেন । একটি উপজাতি হিসেবে তারা তিব্বতী কর্মকর্তাদের জন্য পিয়নের কাজ করতেন , মন্দিরের জন্য চাষাবাদ করতেন এবং মাল বহন করতেন । তারা খুব গরীব ছিলেন । ১৯৫৯ সালে তিব্বতে গণতান্ত্রিক সংস্কার প্রবর্তিত হবার পর সরকার যেমন তাদের জন্য নিরামু থেকে চুয়ানমু পর্যন্ত সড়কপথ নির্মাণ করেছে , তেমনি তাদের টিনের বাসার পরিবর্তে কাঠ ও প্রস্তর দিয়ে নতুন বাড়ি নির্মাণ করেছে । বুড়ো পুতোলা বলেছেন , তখন এটা তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ বাড়িঘর । গ্রামে এই ধরনের বাড়ি এখনো দেখা যায় ।
বুড়ো তোপোলা লি সিন গ্রামের প্রধান ছিলেন । গত শতাব্দির সত্তরের দশকে শেরপাদের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি পেইচিং আর শাংহাইও পরিদর্শন করতে গিয়েছিলেন । গ্রামের প্রবীণদের মধ্যে তিনি একজন অভিজ্ঞ ব্যক্তি । যদিও শেরপারা বংশপরম্পরায় পাহাড়ের উপরে বাস করতেন , কিন্তু তার বড় ও মেজো ছেলে পাহাড় ছেড়ে গেছেন । তাদের মধ্যে একজন নিরামু জেলার অভিশংসক বিভাগের উপ-পরিচালক পদে নিযুক্ত হন , অন্য একজন একটি মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক। তার কনিষ্ঠ ছেলে ছোট তোপোলা বাবার আশা-আকাংক্ষা সূত্রে উত্তরাধিকার গ্রহণ করে লি সিন গ্রামের গ্রামবাসী কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন । এ পর্যন্ত তিনি এই পদে অধিষ্ঠিত হয়েছেন ন' বছর হল ।
তোপোলা সংবাদদাতাকে বলেছেন , ৪০ শতাংশ গ্রামবাসী ব্যবসা করছেন ।
সংস্কার আর উন্মুক্ততা প্রবর্তিত হবার পর শেরপারা ব্যবসা করতে শুরু করলেন । দুদেশের সীমান্তের নিকটবর্তী একটি রাস্তায় শেরপারা বহু দোকান খুলেছে । সবাই সীমান্ত ব্যবসায় নিয়োজিত হয়েছেন ।
তোপোলা বলেছেন , এই রাস্তার নাম তেসিকাং । চুয়ানমু শুল্ক বিভাগ ছাড়া দুদেশের সংলগ্ন করা কয়েক কিলোমিটার দীর্ঘ মৈত্রী সেতুও আছে । যেহেতু শেরপাদের নিজেদের ভাষা আছে আর সীমান্তে বাস করে হান ভাষা , তিব্বতী ভাষা , হিন্দী ভাষা ও ইংরেজীতে ব্যবসা করতে পারেন , সেহেতু দুদেশের সীমান্ত বাণিজ্যে তাদের অনন্য প্রাধান্য আছে । তারা চীনের তৈরী বস্ত্র পণ্য , হার্ডওয়্যার , ক্ষুদ্র ইলেকট্রনিক্স , চামড়াজাত দ্রব্য বিপুল পরিমাণে নেপালে রফতানি করেন এবং নেপালের চাল আর হস্তশিল্প দ্রব্য তিব্বতে আমদানি করেন । চুয়ানমু থানায় শেরপাদের স্থাপিত দোকান , হোটেল আর বিরাটাকারের সুপারমার্কেট সর্বত্রই দেখা যায় । গত বছর লি সিন গ্রামে গ্রামবাসীদের বার্ষিক মাথাপিছু গড়পড়তা আয় তিব্বতীদের গড়পড়তা আয়ের চেয়ে তিন গুণ বেড়ে ৪৩৬০ ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে ।
অবশ্যই লি সিন গ্রামে কোনো কোনো শেরপা পরিবারের জীবনযাপন এখনো স্বচ্ছল হয় নি । গত বছর সীমান্ত অধিবাসীদের আবাসের অবস্থা উন্নত করতে সাহায্য করার জন্য চীন সরকার বেশ কিছু অর্থ বরাদ্দ করেছে । এতে গ্রামের ৪০টি কৃষক পরিবার উপকৃত হয়েছে । তাদের মধ্যে কারো কারো নতুন বাসা নির্মিত হয়েছে আর কারো কারো পুরানো বাড়িঘর মেরামত আর মজবুত করা হয়েছে । এবছর গ্রামে আরো ১০টি পরিবারের বাসার পুনর্গঠন করা হবে ।
তোপোলা বলেছেন , এখন লি সিন গ্রামে বেশ কয়েকটি বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠান শোনা যায় । টেলিফোন যোগাযোগ ব্যবস্থাও চালু হয়েছে । তার বাবা বলেন , তিনি আরো কয়েক বছর বেঁচে থাকতে চান ।
লি সিন গ্রামে সংবাদদাতা দশ বারো বছর আগে বিয়ে করার জন্য তিব্বতে আসা চুমার সংগে দেখা করেছেন । তাদের আজকের জীবনযাপন প্রসংগে তিনি বলেছেন ,
নেপালের চেয়ে এখানকার জীবনযাপন ভাল । তিনি কয়েক মাস করে দেশে একবার যান । ওখানে যাওয়ার জন্য শুধু কয়েক ঘন্টা সময় লাগে । তার বাবা মাও চীনে এসেছিলেন ।
চুমা বলেছেন , তার পরিবারে প্রীতিকর পরিবেশ বিরাজমান । বাড়ির কাজ ছাড়া তিনি কৃষিকর্ম করার জন্যও স্বামীকে সাহায্য করে থাকেন ।
পরিদর্শনকালে তোপোলা কিছু পুরানো বাড়িঘর দেখিয়ে বলেছেন , গ্রামের বেশির ভাগ লোক নতুন বাড়িতে থাকেন । অতীত ভুলে না যাওয়ার জন্য কিছু পুরানো বাড়িঘর এখনো সংরক্ষিত আছে ।
|