মাসখানেক আগে চীনের একটি টিভি কেন্দ্রের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক পেইচিং অপেরা অনুরাগীদের টিভি পুরস্কার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছে। পৃথিবীর ২৫ টি দেশ ও অঞ্চলের এক হাজারেরও বেশী পেইচিং অপেরা অনুরাগী এই প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়েছেন । প্রতিযোগিতায় তাঁরা যে অপুর্ব নৈপুন্যে পেইচিং অপেরার গান গেয়েছেন তা শুনে চীনের অপেরা অনুরাগীরা নিতান্ত বিস্মিত হয়েছেন ।
ডেনিস মার্কিন্ যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছেন । তিনি দীর্ঘকায় ,অভিনয় করেছেন পুরুষ জেনারেলের চরিত্রে । অভিনয়ের পোশাক পরিহিত ডেনিসকে দেখে মনে হয়ে তিনি পুরুষ , কিন্তু আসলে তিনি ষোলা আনা নারী । তিনি চীন আন্তর্জাতিক বেতারের পুরনো বন্ধু , ১৯৯৮ সালে তিনি প্রথমে চীনে এসে বিশেষজ্ঞ হিসেবে চীন আন্তর্জাতিক বেতারের ইংরাজী বিভাগে কাজ করেছিলেন । দশ বছর আগে পেইচিংয়ে আসার আগে তিনি জাপানের টোকিওতে জাপানের ঐতিহ্যিক নাচগান শিখছিলেন । তখন চীনের একটি পেইচিং অপেরা দল জাপানের নানা শহরে অনুষ্ঠান পরিবেশন করছিল । জাপানের ঐতিহ্যিক শিল্পের সংগে পেইচিং অপেরা তুলনা করার জন্য তিনি একদিন বিশেষভাবে টিকিট কেটে পেইচিং অপেরা উপভোগ করতে যান । প্রেক্ষাগৃহে অপেরা শিল্পীদের রংগীন পোশাক , অনন্য অভিনয় ও স্বতন্ত্র পদ্ধতিতে গীত সংগীত চুম্বকের মত তাঁকে আকর্ষন করে । অপেরা উপভোগ করতে করতে তিনি বিমোহিত হলেন , অপেরা দেখা শেষে তিনি চীনা গুরুর কাছে পেইচিং অপেরা শিখার সংকল্প গ্রহণ করেন । পেইচিং অপেরায় জেনারেলের ভুমিকায় সাধারনত: পুরুষ শিল্পী অভিনয় করেন । কিন্তু ডেনিস জেদ ধরেন , জেনারেল ছাড়া অপেরার অন্য কোনো ভুমিকায় অভিনয় করবেন না। তিনি সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , এই ব্যাপারে তাঁর চীনা গুরুও তাঁকে সমর্থন করেন ।কারন ,তিনি লম্বা, কিঞ্চিত মোটা , তাঁর কন্ঠস্বর জোরালো , জেনারেলের ভুমিকায় অভিনয়ের প্রাথমিক যোগত্য তাঁর আছে । গাওয়া, আবৃত্তি করা , স্থির হয়ে বসা ও কসরত পেইচিং অপেরার চারটে মৌলিক উপাদান । অপেরার গীতি নিয়ে ডেনিস মুশকিলে পড়েছেন ।
তিনি বলেছেন:প্রথমে আমি সঠিকভাবে গাইতে পারতাম না । তাই চীনা গুরুকে বলেছি, আমি গান শিখতে চাই না ,শুধু অভিনয় শিখব । প্রথম দু তিন মাসে অপেরার গীতি বাদ দিয়ে অভিনয়ে আত্মনিয়োগ করি । কিন্তু চীনা গুরু অবশেষে গুরুত্ব সহকারে আমাকে বলেছেন , পেইচিং অপেরা আয়ত্ত্ব করতে চাইলে তার গীতি শিখতেই হবে । চীনা গুরুর কঠোর শাসনে আমি একটু একটু শিখতে শুরু করি । আমার গুরুর কঠোর শাসন অবশেষে সফল হয়েছে , এবারের আন্তর্জাতিক পেইচিং অপেরা অনুরাগীদের প্রতিযোগিতায় 'সুকৌশলে ওয়ে হু পাহাড় দখল' নামে আধুনিক পেইচিং অপেরার একটি অংশ সার্থকভাবে পরিবেশনের জন্য ডেনিস দ্বিতীয় শ্রেণীর পুরস্কার পেয়েছেন ।
ক্যানাডা থেকে আসা ডোমিনিকের পেইচিং অপেরা শেখার ইতিবৃত্ত ডেনিসের চেয়ে একেবারে আলাদা । ডোমিনিকের জন্মস্থান ক্যানাডার মন্ট্রীলে। তিনি কখনো দীর্ঘ সময় চীনে থাকেন নি । কিন্তু সাবলীলভাবে চীনাভাষায় কথা বলতে পারেন ।১৯৯৬ সালে তাঁর আবাসিক এলাকায় যে একটি সমবেত সংগীত দল প্রতিষ্ঠিত হয় তার প্রধানকাজ হল চীনা গান শিখা । এই সমবেত সংগীত দলের সদস্য হিসেবে ডোমিনিক প্রথম পেইচিং অপেরা শুনতে পান এবং শিখার জন্য কৌতুহলী হন । কোনো চীনা নন , তারঁ বন্ধুদের উপহার দেয়া টেপ ও ভিডিও ক্যাসেটই তাঁর শিক্ষক । শিখতে শিখতে তাঁর নেশা ধরেছে । টেপ রেকর্ডারের শব্দ সর্বাধিক বাড়িয়ে তিনি যে বার বার শুনেন এবং অনুকরণ করেন ,তাতে তাঁর প্রতিবেশীরা মাঝেমাঝে বিরক্ত হয়ে প্রতিবাদ জানান ।
ডোমিনিক মধ্যবয়সী পন্ডিতের ভুমিকায় অভিনয় করতে পছন্দ করেন । তিনি সি আর আইয়ের সংবাদদাতার কাছে তার অভিনয়ের অভিজ্ঞতা বর্ননা করেছেন :প্রথম মঞ্চে উঠে পেইচিং অপেরা পরিবেশনের সময়ে,আমি যেন মাতাল হয়েছি ,কিছুতেই নিজেকে সামলাতে পারি না ।
ডোমিনিক শুধু বুদ্ধিমান নন ,তাঁর কন্ঠস্বরও গম্ভীর ও তেজীয়ান । তাই তিনি অনায়াসে এবারের প্রতিযোগিতার প্রথম শ্রেণীর পুরস্কার পেয়েছেন ।
বাংলাদেশ থেকে আসা মোহাম্মদ তৌফিক চীনের কেন্দ্রীয় চারুকলা বিশ্ববিদ্যায়ে মাস্টার্স করছেন । চুড়ান্ত প্রতিযোগিতায় তিনি যে সার্থকভাবে ভাঁড়ের ভুমিকায় অভিনয় করেছেন তার জন্য তিনি দ্বিতীয় শ্রেণীর পুরস্কার পেয়েছেন ।
তৌফিক ফ্যালফেলে চোখে কথা বলেন , মুখের ভাব অতিশয় সজীব, সামান্য দাড়িগুচ্ছ তাঁর রসিকতার পরিচায়ক । হাস্য রসাত্মক নাটক পরিবেশনের প্রতিভা তার সহজাত । তিনি যখন চুপচাপ হয়ে থাকেন তখনও তাঁর মুখের দিকে চোখ পড়লে না হেসে উপায় নেই ।
চার বছর হলো তৌফিক চীনে লেখাপড়া শিখছেন ।কিন্তু পেইচিং অপেরা শিখছেন মাত্র চার মাস ।তিনি সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , যেটা তাঁর সবচেয়ে কঠিন লাগে সেটি হলো পেইচিং অপেরার সংলাপ।
তিনি বলেছেন , আধানিক ভাষা নয় , প্রাচীন ভাষায়ই পেইচিং অপেরার সংলাপ লেখা হয়েছে । কখনো কখনো আমি যে কীভাবে গেয়েছি তা আমিও বুঝতে পারি না । তাছাড়া প্রতিটি চীনা শব্দের চারটে সুর পৃথক করতে পারি না আমি ।
তৌফিকের এই কথা বোধগম্য । পেইচিং অপেরায় ভাঁড়ের সংলাপ ও স্বগতোক্তি খুবই লম্বা , মুখস্থ করার পরে তালে তালে আবৃত্তি করতে হবে । আমরা চীনারা ছোটো বেলা থেকে চীনা ভাষায় কথা বলেছি , তবু পেইচিং অপেরার স্বগতোক্তি আমাদের পক্ষে সহজসাধ্য নয়, বিদেশীদের পক্ষে তো আরো দূরের কথা ।
আনন্দের ব্যপার এই যে তৌফিক এখন সাবলীলভাবে চীনা ভাষায় কথা বলতে পারেন , একটু কঠোরভাবে চর্চা করে পেইচিং অপেরার স্বগতোক্তি আয়ত্ত্ব করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব নয় ।বস্তুত: তিনি মোটামুটি চীনা পেইচিং অপেরা অনুরাগীদের মত আবৃত্তি করতে পেরেছেন ।
অপেরা শিল্প সম্বন্ধে চীনের একটি প্রবাদে বলা হয় , মঞ্চে এক মিনিট সুন্দরভাবে অপেরা পরিবেশন করতে চাইলে মঞ্চের নীচে দশ বছর ধরে চর্চা করতে হবে । বিদেশের এই তিনজন পেইচিং অপেরা অনুরাগী দশ বছর ধরে চর্চা করেন নি ,তবে অনেক সময়ে অধ্যবসায়ের সংগে শিখে মঞ্চে যে পেইচিং অপেরা পরিবেশন করেছেন তা প্রশংসনীয়
|