২০০৪ সালে মাদাম সি চুয়ান স্থির করেন , এই বছরের শরতকালে নতুন শিক্ষা বর্ষ শুরু হলে তিনি দক্ষিণ চীনের সেন জেন শহরের উকিল-অফিসের চাকরি ছেড়ে দেবেন এবং সাময়িকভাবে স্বামী ও ছেলের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে স্বেচ্ছাসেবিকা হিসেবে প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকায় গিয়ে শিক্ষকতা করবেন ।
সেন জেন শহরে মাদাম সি চুয়ানের চাকরি সন্তোষজনক ।স্বামী তাঁকে গভীরভাবে ভালোবাসেন , তাঁর ছেলে বড় আদুরে । অন্যদের চোখে একজন নারীর যা দরকার তার সবই হয়েছে তাঁর । তবে সুখের নীড় ছেড়ে তিনি কেন একা এক হাজার কিলোমিটার দূরের কুইচৌ প্রদেশে শিক্ষকতা করতে গেলেন । এ প্রশ্নের উত্তরে সহজ ভাষায় মাদাম সি চুয়ান বলেন :আমি পাহাড়ী অঞ্চলের ছাত্রছাত্রীদের সংগে থাকতে পছন্দ করি । এখানে এসে শিক্ষকতা করার মাধ্যম আমি তাদের কিছু ধ্যানধারনা বদলাতে চাই । ক্লাস নেয়ার সময়ে আমি যা বলি ,তারা বিপুল আগ্রহে তা শুনে । তারা আস্তে আস্তে বুঝতে পেরেছে যে , আধুনিক সমাজে মানুষের পক্ষে বিদ্যাই সবচেয়ে মু্ল্যবান ।
আজকের চীনে সি চুয়ানের মত যারা এই দৃষ্টিভংগি পোষন করেন তাঁদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে ।কাজেই সমাজের কল্যানকর কাজে অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যাও দ্রুত বাড়ছে । চীনের কোনো কোনো সরকারী ও বেসরকারী সংস্থা প্রতিবছরে নিয়মিতভাবে স্বেচ্ছাসেবকদের সংগঠিত করে এবং চীনের অনুন্নত অঞ্চলে শিক্ষা, চিকিত্সা , কৃষি , আইন ,প্রশাসন প্রভৃতি ক্ষেত্রে কাজ করতে তাঁদের পাঠায় । ২০০৪ সালের শেষ নাগাদ পশ্চিম চীনে কর্মরত স্বেচ্ছাসেবকদের সংখ্যা বিশ হাজারের কাছাকাছি হয়েছে ।
মাদাম সি চুয়ান তাঁদের মধ্যে একজন । তিনি বলেছেন , বহু অগ্রণীর প্রভাবে তিনি পশ্চিম চীনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ।তিনি ছোটো বেলা থেকে শহরে থাকেন , অন্নবস্ত্র নিয়ে তাঁর কোনো চিন্তা নেই । কিন্তু তাঁর চঞ্চল মন শান্ত জীবন যাপন করতে নারাজ । তিনি সর্বদাই মনে করেন , যাদের সাহায্য দরকার তাদের জন্য তাঁর কিছু করা উচিত । তাঁর স্বামী যে তাঁর মনস্কাম উপলব্ধি করেন আর এই ব্যাপারে তাঁকে যে সমর্থন করেন তা তাঁর পক্ষে অপরিমেয় অনুপ্রেরণা স্বরুপ।
মাদাম সি চুয়ানের স্বামীর নাম জাং ওয়েই সং । তিনি সেন জেনের উকিল-অফিসে কাজ করেন । তিনি পল্লীগ্রামে বড় হয়েছেন। কাজেই জনবিরল আর অনুন্নত গ্রামাঞ্চলের ছেলেমেয়েরা যে সহজে লেখাপড়ার সুযোগ পায় না , তা তিনি জানেন । সুতরাং তাঁর স্ত্রী পশ্চিম চীনে শিক্ষকতা করতে যাবেন জেনে তিনি পুর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন ।তিনি বলেছেন , আমার স্ত্রী নতুন কিছু যা করতে চান আমি সবসময় তাতে সায় দিই । বিশেষ করে তিনি যে শিক্ষকতা করতে যাবেন, তা অত্যন্ত তাত্পর্যপুর্ণ বলে আমি মনে করি ।তিনি তাঁর বিদ্যা ,দক্ষতা আর অভিজ্ঞতার সাহায্যে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের বদলাতে পারবেন , এমন কি কোনো কোনো ছেলেমেয়ের জীবন সম্পুর্ন পাল্টে দিতে পারবেন ।
সি চুয়ান কুইচৌ প্রদেশের পাহাড়ী অঞ্চলের যে একটি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন সমুদ্রের উপরিতলা থেকে তার উচ্চতা প্রায় দু হাজার মিটার । এই স্কুলের পাঁচটি সাধারন ক্লাসরুম ইট ও টালি দিয়ে তৈরী , একশো সত্তর জন ছাত্রছাত্রী এই স্কুলের নানা শ্রেণীতে পড়াশোনা করছে । ক্লাস আরম্ভ বা শেষ হলে ঘন্টার বদলে কুড়িয়ে আনা একটি লৌহ খন্ড বাজানো হয় ।
প্রতিদিন সি চুয়ান লোহার খন্ডের ধ্বনির মধ্য দিয়ে ক্লাসরুমে প্রবেশ করেন আর ক্লাসরুম থেকে বেরিয়ে আসেন । সি চুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন পড়েছেন । স্কুলের চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের চীনা ভাষা পড়ানো তাঁর পক্ষে মোটেই কঠিন নয় । পাঠ্যবইয়ের বিষয় ব্যাখ্যা করা ছাড়া তিনি যতদূর সম্ভব ছাত্রছাত্রীদের সামনে বহির্বিশ্বের নবচিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেন ।
শিক্ষিকা সি চুয়ান ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন প্রাচীন কালের কবি লি পাইয়ের লেখা একটি কবিতা যার নাম: লুসান পর্বতের জলপ্রপাত অবলোকন ।
এখন ছাত্রছাত্রীদের নিয়েই শিক্ষিকা সি চুয়ানের পুর্ণাংগ জীবন । স্বামী ও ছেলে নিয়ে তাঁর শান্ত জীবন হাজার কিলোমিটার দূরে মিলিয়ে গেছে । জনকোলাহলপুর্ণ শহরকে পিছনে রেখে তিনি একটি অপরিচিত পরিবেশে জীবন যাপন করছেন । সবকিছুই তাঁর নতুন লাগছে । তিনি আনন্দের সংগে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের পড়াচ্ছেন এবং পাহাড়ী জীবনের রস সংগ্রহ করছেন । পাহাড়ী এলাকার অতুলনীয় নির্জনতা , পাহাড়ের তলায় কলকল রবে বহমান ছোটো নদী এবং সরলপ্রাণ কৃষকদের আচার-ব্যবহার সবই তাঁর ভালোলাগে ।
শিক্ষিকা সি চুয়ানের আগমন প্রত্যন্ত পাহাড়ী গ্রামের জন্য বয়ে এনেছে বহির্বিশ্বের টাটকা হাওয়া ।তাই স্থানীয় গ্রামবাসীরা শহর থেকে আসা এই শিক্ষিকার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ।কৃষক ইয়াংছং খুয়ান বলেছন:সেন জেনের মত সুরম্য শহর থেকে তিনি আমাদের পাহাড়ী গ্রামে এসেছেন , শহুরে নারী হিসেবে তিনি যে আমাদের মত কষ্ট সহ্য করতে পারেন তা সত্যি প্রশংসনীয়
অবশ্য শিক্ষিকা সি চুয়ানকে পেয়ে সবচেয়ে আনন্দিত হয়েছে তাঁর ছাত্রছাত্রীরা ।তারা পাহাড়ী গ্রামের ছেলেমেয়েদের নিজস্ব উপায়ে সি চুয়ানের প্রতি তাদের ভালোবাসা ব্যক্ত করেছে ।
মাদাম সি চুয়ান বলেছেন , ক্লাস করার সময় একজন ছাত্র হঠাত একটি আলু বের করে আমার টেবিলে রেখে দিয়ে বলে , আপনার জন্য নিয়ে এসেছি , আপনি খান ! কখনো কখনো আমার জন্য তাঁরা নিয়ে আসে একটা কমলা বা একগুচ্ছ বন্য ফুল । তখন আমার মন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠে ।
পাহাড়ী গ্রামের সরলপ্রাণ ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত থাকা সত্ত্বেও ছ' বছর বয়সের ছেলে দুদুর কথা প্রায় মাদাম সি চুয়ানের মনে পড়ে । এখন দুদুকে দেখছেন তার নানা নানী । দুদুর কথা মনে পড়লে টেলিফোনে কিছু ক্ষণ তার সংগে কথা বলা ছাড়া তাঁর আর কোনো উপায় নেই । কিন্তু পাহাড়ী এলাকায় টেলি-সংকেত খুবই দুর্বল । টেলিফোন করার সময়ে তাঁকে ছাদের উপরে দাঁড়াতে হয় ।তাঁর ছেলের কৌতুহলের শেষ নেই , টেলিফোনে একটার পর একটা প্রশ্ন করে । পাহাড়ী অঞ্চলের ছেলেমেয়েদের চেয়ে সে অত্যধিক সৌভাগ্যবান ।ঝকঝকে তকতকে ক্লাসরুমে ক্লাস করতে পারে সে ।
স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে শিক্ষকতা করতে করতে পশ্চিম চীন সম্বন্ধে সি চুয়ানের জ্ঞান যথেষ্ট বেড়েছে । পাহাড়ী এলাকার ছেলেমেয়েদের জ্ঞানের পিপাসা দেখে তিনি গভীরভাবে অভিভূত হয়েছেন । এই কারণে পশ্চিম চীনে গিয়ে শিক্ষকতা করার সিদ্ধান্ত নেয়ায় কখনো অনুতাপ করেন নি তিনি ।
|