সম্প্রতি চীন সরকার পল্লী উন্নয়নের নতুন পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছে । তাতে কৃষকদের ফসলের জন্য ভর্তুকি প্রদান, কর মওকুফ এবং গ্রামের অবকাঠামো নির্মাণ জোরদার ইত্যাদি ব্যবস্থা নেয়ার মাধ্যমে অনুন্নত গ্রামাঞ্চলকে সমৃদ্ধিশালী , গণতান্ত্রিক এবং সভ্যতা-সম্পন্ন নতুন ধাঁচের গ্রামাঞ্চলে রূপান্তরিত করা হবে।
চীনের অনুন্নত পশ্চিম অংশের কুইচৌ প্রদেশ একটি কৃষিপ্রধান প্রদেশ। কৃষিজীবীদের সংখ্যা খুবই বেশি। কুইচৌ প্রদেশের ছিয়াওতি নামক একটি পাহাড়ী গ্রামে কয়েক বছর আগে আয় খুব কম এবং অবকাঠামো খুবই দুর্বল ছিল। এখানে জীবনযাত্রার পরিবেশ মোটেই সন্তোষজনক ছিল না। গ্রামবাসী চাং তেমিং বলেছেন, "২০০০ সালে আমাদের ছিয়াওতি গ্রামের অবস্থা খুব নাজুক এবং বিশৃংখল । বৃষ্টিতে গ্রামের রাস্তা কাদা কাদা হয়ে যায়। গ্রামের তরুণতরুণীদের সংখ্যা খুব বেশি। তাঁদের মতে স্থানীয় পরিবেশ ছিল খুবই খারাপ এবং দীর্ঘকাল পর্যন্ত তা সমাধান করতে চাইলেও সমাধান হয় নি। সরকারের উপদেশে এখন গ্রামবাসীরা সমৃদ্ধিশালী হতে খুব আগ্রহী ।"
ঐতিহাসিক কারণে গ্রামের অবস্থা শহরের চেয়ে অনেক অনুন্নত। অর্থের অভাবে অনেক গ্রামবাসীর চিকিত্সা ও লেখাপড়ার সুব্যবস্থা ছিল না ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীন সরকার বরাবরই পল্লী উন্নয়নের সমস্যা সমাধান করতে আগ্রহী। সেজন্যে পল্লী উন্নয়নের ধারাবাহিক নীতিমালাও প্রণয়ন করেছে ,যেমন কৃষকদের ভর্তুকি এবং করমুক্ত সুবিধা দেয়া ইত্যাদি। তাতে কৃষকদের উত্পাদনকর্মের উত্সাহ এবং আয় বেড়ে যায়। কিন্তু শহরের উন্নয়নের গতি আরও বেশি দ্রুত বলে শহর ও গ্রামের ব্যবধান অব্যাহতভাবেই বাড়ছে।
চীনের কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থবিষয়ক নেতৃগ্রুপের কার্যালয়ের উপপরিচালক ছেন সি'ওয়েন বলেছেন, " আমাদের শহর ও গ্রামের ব্যবধান এখনও বাড়ছে। গত বছর দেশের কৃষকদের মাথাপিছু নীট আয় ছিল ৪০৬ মার্কিন ডলার, পক্ষান্তরে শহরবাসীদের মাথা-পিছু নীট আয় ছিল ১৩১০ ডলার।অর্থাত্ ব্যবধান ৯০৪ ডলারের । অন্য দিকে সরকার দেশবাসীকে শিক্ষা, স্বাস্থ্যরক্ষা, সংস্কৃতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে সব সুবিধা দিয়েছে, তাতে শহরবাসীদের চেয়ে গ্রামবাসীরা আরও কম সুবিধা ভোগ করেন।"
এই সমস্যার মৌলিক সমাধানের জন্য সম্প্রতি সরকার পল্লী উন্নয়নের নতুন নীতি চালু করেছে। সরকার গ্রামাঞ্চলের উন্নয়নে বিরাট অংকের অর্থ বরাদ্দ করবে, যাতে শহরবাসীদের মতো গ্রামবাসীরাও এক সঙ্গে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে পারেন।
কয়েক বছর আগে স্থানীয় সরকার ছিয়াওতি গ্রামের সড়ক, আবাসন , গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যরক্ষা আর সংস্কৃতির ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কয়েক লক্ষ ইউয়ান অর্থ বিনিয়োগ করেছে এবং অর্থকরী ফসল চাষে উত্সাহ দেয়ার জন্য ভর্তুকি প্রদান করেছে। গত কয়েক বছরের প্রচেষ্টার বল্যাণে এই গরীব গ্রামে এখন মোটামুটি সব অবকাঠামোগত স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে এবং গ্রামের অবস্থা বেশ সচ্ছল হয়েছে। এখন এই পাহাড়ী গ্রামে বায়ু একদম টাটকা , রাস্তাঘাট পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন, কৃষকদের সারি সারি নতুন বাগানবাড়ি সংশৃংখল ও যুক্তিযুক্ত ব্যবধানে বিন্যস্ত ।
গত কয়েক বছরের পরিবর্তন সম্পর্কে গ্রামবাসী লি ফুমেই বলেছেন, " আগে রান্নার জন্য জ্বালানী হিসেবে কাঠ ব্যবহার করা হতো, পাহাড়ে গিয়ে কাঠ কেটে আনতে হতো। এখন কিন্তু গ্যাস এবং মিথেন গ্যাস বা ইলেক্ট্রম্যাগনেটিক চুল্লী ব্যবহার করা হয় ।"
লি ফুমেই জানিয়েছেন, অতীতে মানুষ আর গৃহপালিত পশু একই শৌচাগার ব্যবহার করতো । এখন মানুষের জন্য আলাদা বাথরুম নির্মাণ করা হয়েছে , যাতে শহরবাসীদের বাড়ির মতো ওয়াটার হিটারও লাগানো হয়েছে। ফলে যে কোনো সময়ে গরম পানিতে গোসল করা যায়।
গ্রামবাসীদের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে তাঁদের মানসিক অবস্থা এবং সামাজিক আচার ব্যবহারেরও উন্নতি হয়েছে। ছিয়াওতি গ্রামের দায়িত্বশীল ব্যক্তি লিউ সিয়েন বলেছেন, " অতীতে এখানে চুরিডাকাতি বেশি ছিল, এর প্রধান কারণ ছিল অন্নবস্ত্র এবং অর্থের অভাব। চুরি ডাকাতি রাহাজানি সম্পর্কে গ্রামবাসীদের মুখে মুখে একটি ছড়াও প্রচলিত আছে: 'দিনে বাড়ি থেকে দূরে যেতে ভয় পাই, পাছে বাড়িতে চুরি -ডাকাতি হয় ! রাতে বের হলে আবার রাহাজানির ভয়ে বুক দুরুদুরু কেঁপে উঠে।' এখন আমাদের গ্রামে রাস্তায় কারো কোনো জিনিস পড়ে থাকলে কেউ তা নিয়ে যাবে না, রাতে দরজা বন্ধ না করেও নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারি। এই চার বছরে এখানে নিরাপত্তা লংঘনের কোনো ফৌজদারী অপরাধের ঘটনা ঘটে নি।"
চলতি মাসে চীনের জাতীয় আর্থ- সমাজিক উন্নয়নের পাঁচসালা কর্মসূচি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে। তাতে গ্রামাঞ্চলের অবকাঠামো নির্মাণ খাতে সরকারের অর্থ বরাদ্দ বাড়ানো হবে , গ্রামের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিত্সা, শিক্ষা ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে গণ পরিসেবা উন্নয়নে পুঁজি বিনিয়োগ জোরদার করা হবে। চীনের পরিবহন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, আগামী ৫ বছরে গ্রামাঞ্চলের ১২ লক্ষ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ বা সংস্কার করা হবে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা: সারাদেশ জুড়ে গ্রামাঞ্চলে গণ স্বাস্থ্যরক্ষা ও মারাত্মক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের দেশব্যাপী নেট ওয়ার্ক গড়ে তোলা হবে।
আর্থ-বিষয়ক কর্মকর্তা ছেন সিওয়েন জানিয়েছেন যে, ২০ বছরের বেশি দ্রুত উন্নয়নের ফলে এখন কৃষি ও গ্রামের উন্নয়নে আর্থিক সমর্থনের মাত্রা বিপুলভাবে বাড়ানোর সামর্থ্য চীনের হয়েছে। শিল্পখাত থেকে অর্জিত অর্থ কৃষিকাজে ভর্তুকি হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। কৃষি উন্নয়নের ফলে চীনের ৯০ কোটি কৃষকের ক্রয়ক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে , ফলে চীনের অভ্যন্তরিণ বাজারে চাহিদা বেড়ে যাবে , তাতে অর্থনীতির দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের উপকার হবে।
|