চিয়াও পো চীনের একজন বিখ্যাত আলোক চিত্র শিল্পী । গত ৩০ বছরে তিনি তার বাবা মার জন্য প্রায় বারো হাজারটি ছবি তুলেছেন , এই সব ছবিতে তার বাবা মার জীবন চিত্রিত হয়েছে । ' আমার বাবা-মা ' নামে তার আলোকচিত্র প্রদশর্নী ও প্রামান্য চলচ্চিত্র সমাজে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল । তথ্যমাধ্যমগুলো এই বলে মূল্যায়ন করেছিল যে তার আলোকচিত্র পেইচিং তথা গোটা চীনকে মুগ্ধ করেছে । আজকের সংস্কৃতি সম্ভার আসরে আলোকচিত্র শিল্পী চিয়াও পো ও তার বাবা মার কাহিনী শ্রোতাবন্ধুদের বলবো ।
এ বছর চিয়াও পোর ' আমার বাবা মা ' নামে একটি আলোকচিত্র এলবাম প্রকাশিত হয়েছে । এই এলবামে তার তোলা হাজার হাজার ছবি থেকে বেছে নেয়া সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা সম্বলিত ১২০টি ছবি আছে । এই ১২০টি ছবিতে চীনের এক কৃষক দম্পত্তির ৩০ বছরের জীবন প্রতিফলিত হয়েছে । এগুলোর মধ্যে আছে তার বাবা মা ক্ষেতে কাজ করার ছবি , মা বাবার পিঠ আচঁড়ানোর ছবি , বাবা মায়ের জন্য হাতের নখ কাটার ছবি , মা নাতির হাত ধরে তাকে হাঁটা শিখানোর ছবি আর বাবা মার নাতিকে ভাত খাওয়ানোর ছবি আছে । ত্রিশ বছর পার হয়ে গেছে , বাবা মার মাথার চুল সব সাদা হয়েছে , মুখের ভাঁজগুলো ক্রমেই গভীরতর হয়েছে । বৃদ্ধবয়সে তারা আর সোজা হয়ে দাড়াতে পারেন না , তাদের পিঠ ও কোমর বাঁকা হয়েছে , কোনোরকমে হাঁটতে পারেন । কিন্তু তাদের চোখের সামনে বড় হওয়া নাতি বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশুনা শেষ করে স্নাতকোত্তরছাত্র হয়েছে । এই সব ছবিতে গ্রামীন বৃদ্ধ দম্পত্তির পারস্পরিক যত্ন নেয়া আর ছেলেমেয়ে ও বাবা মার মধ্যে পারস্পরিক ভালোবাসার দৃশ্য প্রত্যেক দর্শককে মুগ্ধ করেছে ।
এই আলোকচিত্র এলবাম ১৯৯৮ সালে চিয়াও পোর ' আমার বাবা মা ' নামে একটি আলোকচিত্র প্রদশর্নীর ধারাবাহিক রুপ বলা যায় । সেই বছর এই প্রদশর্নী চীনে দশ বারোটি প্রদেশ ও শহরে আর হাজারাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রদর্শিত হয়েছিল , দর্শকের সংখ্যা দশ লক্ষ ছাড়িয়েছিল । এই প্রদর্শনী দেখে বিমুগ্ধ দশর্ক চোখের পানি ফেলেছেন । দর্শকরা দর্শকেরখাতায় লিখেছেন , এই সব ছবি আমাদের মনে বাবা মার ভালোবাসার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছে । তাদের নিঃস্বার্থ যত্ন ও ভালোবাসা আমাদের শক্তির অফুরন্ত উত্স । অনেক দর্শক প্রদর্শনী দেখে হাতের কাজ রেখে বাবা মাকে দেখার জন্য দেশের বাড়ীতে যান । এই প্রদশর্নী যে এতো বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি করতে পারে , চিয়াও পো তা' কল্পনাও করতে পারেন নি । তিনি বলেছেন , আমার বাবা মার জীবন চীনের হাজার হাজার সাধারণ অধিবাসীর জীবন বলা যায় । আমার তোলা ছবি দেখে এবং আমার বাবা মার কাহিনী শুনে এতো বেশী দশর্কের মুগ্ধ হওয়ার কারণ এটাই । তারা আমাকে বলেছেন , আমার তোলা ছবি তাদের মনের সবচেয়ে দুর্বল অংশ স্পর্শ করেছে । চীনের হাজার হাজার ছেলেমেয়ে নিজের বাবা মাকে ভালোবাসেন এবং তাদের যত্ন নিতে চান , কিন্তু কাজে ব্যস্ত ইত্যাদি কারণে তারা করতে পারেন নি , সেজন্য তারা অনুতাপ করেন । আমি শুধু বাবা মার জন্য কিছু কাজ করতে চাই । আলোড়ন সৃষ্টি করে পুরস্কার পাওয়ার কথা কখনও ভাবি নি । আমি শুধু নিজের বাবা মার স্মৃতি স্থায়ীভাবে ধরে রাখার চেষ্টা করেছি।
চিয়াও পোর বয়স এ বছর প্রায় ৫০ বছর । তিনি পূর্ব চীনের সান তুং প্রদেশের চিপো শহরের উপকন্ঠের এক কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন । তার বাবা ছোটবেলায় মাত্র চার বছর লেখাপড়া করেছিলেন । টাকা পয়সা নেই বলে তিনি বাধ্য হয়ে পড়াশুনা বন্ধ করে গ্রামে ফিরে একজন কাঠমিস্ত্রী হন । তিনি আন্তরিকভাবে আশা করেন তার ছেলেমেয়ের মধ্যে অন্ততঃএকজন বেশী পড়াশুনা করতে পারবে । চিয়াও পো এই পরিবারের সবচেয়ে ছোট ছেলে । তার বড় ভাই ও বড় বোনরা বাবার এই আকাংখা বাস্তবায়ন করতে পারেন নি , তাই চিয়াও পো বাবার একমাত্র আশা হয়েছেন । ১৫ বছর বয়সে চিয়াও পো শিক্ষক হওয়ার একটি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অন্য গ্রামের একটি স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেওয়ার সুযোগ পান । এই খবর পেয়ে তার বাবা আনন্দে উচ্ছ্বসিত হন । তিনি বাড়ীর কাঠ বিক্রি করে পাওয়া তিন শ' ইউয়ান দিয়ে চিয়াও পোর জন্য সাইকেল ,হাতঘড়ি ও ওভারকোট কিনে দেন , সেই সময় বাবার মাসিক আয় মাত্র তিন ইউয়ান ছিল।
তার প্রতি বাবা মার আশা ও ভালোবাসা সম্বন্ধেচিয়াও পো ভালো করে জানেন। ১৯৭৪ সালে চিয়াও পো সহকর্মীর কাছ থেকে ক্যামেরা ধার নিয়ে বাবা মার জন্য তাদের জীবনের প্রথম ছবি তুলেছেন । চিয়াও পো বলেছেন , বাবা মা কখনও ক্যামেরা দেখেন নি , তাই তিনি ক্যামেরা তুলে তাদের জন্য ছবি তোলার সময় বাবা মা হতভম্ব হয়ে পড়েন । তারা মনে করেন তাদের সবচেয়ে ভালো পোশাক পরতে হবে , তাই মা উত্সবের সময় পরার জামা আর বাবা শহরের কাঠমিস্ত্রী হিসেবে কাজ করার সময় পাওয়া কারখানার ইউনিফর্ম পরেছেন ।
চিয়াও পো দেশের বাড়ী ফিরে যাওযার সুযোগ পেলেই বাবা মার জন্য ছবি তোলেন । ছবি তোলার নৈপুন্য উন্নত করার জন্য চিয়াও পো পেশাদার আলোকচিত্র শিল্পী হওয়ার চেষ্টা করেন । ১৯৮৩ সালে তিনি পরীক্ষার মাধ্যমে চিপো শহরের শিক্ষা ইন্সটিটিউটে ভর্তি হন । তিনি এই ইন্সটিটিউটে আলোকচিত্র গ্রুপ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সহপাঠীদের সঙ্গে ছবি তোলার কৌশল উন্নত করার চেষ্টা করেন । পড়াশুনা শেষ করে তিনি আশানুরুপ ভাবে একটি পত্রিকার আলোকচিত্র কর্মী হলেন । এই সময় চিয়াও পো মনে মনে নিজেকে বলেন , অবশ্যই বাবা মার জন্য বেশী ছবি তুলে তাদের স্মৃতি চিরকাল নিজের কাছে ধরে রাখতে হবে । আমি আমার বাবা মাকে ভালোবাসি। আমি তাদের হারাতে চাই না । কিন্তু একদিন না একদিন তারা আমাদের ছেড়ে চলে যাবেন।তাই আমি আমার ক্যামেরা দিয়ে তাদের আনন্দ ও দুঃখ বজায় রাখার চেষ্টা করেছি ।
তখনকার গ্রামে ছবি তোলা স্বাভাবিক ব্যাপার নয় ।বাবা মাও জানেন না নিজের ছেলে কেন বার বার তাদের জন্য ছবি তোলেন । কিন্তু তারা আপত্তি করেন না , তারা ছেলেকে ভালোবাসেন , যে সব কাজ ছেলে করতে পছন্দ করেন , তারা কখনও বাধা দেন না । এক বছরের শীতকালে চিয়াও পোর আশি বছর বয়সের মা গুরুতরভাবে অসুস্থ হন । ডাক্তার বলেন তার মা মাত্র দুই ঘন্টা বেঁচে থাকবেন । ডাক্তারের এই কথা শুনে চিয়াও পো বাবা মার জন্য শেষ ছবি তুলেন । আশ্চর্যের ব্যাপার হলো পর দিন তার মা সুস্থ হতে শুরু করেন । তিনি বলেছেন , আমি মনে করি আমার মা আমাদের ছেড়ে যেতে চান না । তিনি ছেলের হাতে তোলা আরো বেশী ছবি দেখতে চান । এ কথা বলা যায় আমি আমার ক্যামেরা দিয়ে মাকে ফিরিয়ে দিয়েছি । এর পর তিনি আরো পাঁচ বছর বেঁচে ছিলেন । ছেলের তোলা ছবিগুলো দেখে আমার বাবা মা তৃপ্ত বোধ করেন । আমার মা ৯২ বছর আর বাবা ৮৮ বছর পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন।
১৯৮৮ সালে চিয়াও পো মার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে চীনের জাতীয় চারুকলা ভবনে ' আমার বাবা মা ' নামে তার আলোকচিত্র প্রদর্শনী আয়োজন করেন । তার বাবা-মা দেশের বাড়ী থেকে আনা কয়েক ডজন বছর ব্যবহার করা একটি পুরনো কাঁচি দিয়ে চিয়াও পোর এই প্রদর্শনীর ফিতা কেটেছেন । ৩০ বছর ধরে চিয়াও পো বাবা মার জন্য মোট বারো হাজারটি ছবি ও ছয় শ' ঘন্টার ভিডিও ক্যাসেট রেকর্ড করেছেন ।
|