পেইচিংয়ের পুরনো গলিকে পেইচিংয়ের স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম নিদর্শন বলা যায় ।অতীতে একটা আঙ্গিনাকে মাঝখানে রেখে তার চার দিক ঘির থাকা চারটা একতলা ঘর নিয়ে এক একটা পরিবার থাকত । শহরবাসীদের এই ধরনের উঠানওয়ালা বাড়ীগুলোর সমাবেশে আবাসিক এলাকা গড়ে উঠত । আবাসিক এলাকার রাস্তাকে বলা হত "গলি " । পেইচিংয়ের গলি আট শো বছর পুরনো । গলি ও উঠানওয়ালা বাড়ী পুরনো পেইচিংবাসীদের জীবন যাপনের প্রধান স্থান।সেখানে পেইচিংয়ের আদিম অধিবাসীদের জীবনধারা ,রীতিনীতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের পরিচয় পাওয়া যায় ।
পেইচিংয়ের তংছেং ডিষ্ট্রিক্টে অবস্থিত জু-এর গলি চার শো মিটার দীর্ঘ । চার-পাচঁ শো বছর পুরনো এই গলির দুপাশের বাড়িতে থাকতেন অনেক রাজকর্মকর্তা ও অভিজাত লোক । এখন এই গলির দু পাশে যে বহু উঠানওয়ালা বাড়ী রয়েছে তার চীনা স্থাপত্যরীতির আকর্ষণে অনেক বিদেশী সেখানে থাকতে শুরু করেছেন।
এই গলির মুখে সি আর আইয়ের সংবাদদাতা জার্মানী থেকে আসা স্থাপত্য বিদ্যার প্রকৌশলী বেরনা হার্ডের দেখা পেয়েছেন । তিনি পেইচিংয়ের একটি স্থাপত্য গবেষণাগারের আমন্ত্রণে চাকরি করার জন্য সবেমাত্র বার্লিন থেকে পেইচিংয়ে এসেছেন । তিনি সি -আর -আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , তিনি বাড়ি ভাড়া করতে এই গলিতে এসেছেন । পেইচিংয়ের গলির পরিবেশ তাঁর খুব ভালো লাগে ।
তিনি বলেছেন , আমি মনে করি , এই জায়গা খুবই ভালো , বাইরে দেখলে মনে হয় , এগুলো পুরনো বাড়ি , কিন্তু ভেতরের সাজসরঞ্জাম সংস্কার করার পর জীবনযাপন করতে কোনো অসুবিধা নেই । নীরব আঙ্গিনায় ফুল ও গাছপালার বাহার । গাছের নীচে বসে পরিবারের সদস্যরা পাখা চালিয়ে গল্পগুজব করছেন । ছেলেমেয়েরা ছুটাছুটি করছে বা খেলা করছে । এমন দৃশ্য জার্মানীতে আর দেখা যায় না । আমার মতে , গলি পেইচিংয়ের স্থাপত্যের নিদর্শন এবং পেইচিংয়ের ইতিহাসের একটি অংশ ।
এখন জু-এর গলিতে যে দু শোরও বেশী পরিবার থাকে তাদের মধ্যে প্রায় চল্লিশটি পরিবার এসেছে ব্রিটেন , মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র , ফ্রান্স , জার্মানী ,ইস্রাইল প্রভৃতি দেশ থেকে । বিদেশী অধিবাসীদের মধ্যে যেমন বিদেশী পুঁজি বিনিয়োজিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও সাংবাদিক তেমনই ছাত্রছাত্রী ও স্বাধীন কর্মজীবীও রয়েছেন ।
মিং খং বাও রুই ইস্রাইলের সাংবাদিক। খং বাও রুই তার চীনা নাম। তাঁর আসল নাম বারুহ কোহেন । সাত মাস আগে তিনি পেইচিংয়ে এসেছেন ।এখন তিনি পেইচিংয়ের একটি ইংরেজী পত্রিকার জন্য নিয়মিত প্রবন্ধ লিখছেন ।
চীনা বন্ধুদের সাহায্যে তিনি জু-এর গলির বাড়ি ভাড়া নিয়েছেন । চীনে অবস্থানের সময় নাতিদীর্ঘ হলেও তিনি এখন ভাঙা ভাঙা চীনা ভাষায় প্রতিবেশীদের সংগে কথা বলতে পারেন । তিনি আনন্দের সঙ্গে সি -আর- আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন যে, তিনি এখন চীনা ভাষায় যথার্থভাবে মনোভাব প্রকাশ করতে পারছেন না , কিন্তু তাঁর প্রতিবেশীরা তাঁর সঙ্গে কথা বলতে আগ্রহী । তিনি মনে করেন, এখানকার মানুষ যেমন সরল তেমনই প্রাণোচ্ছল ।
তিনি বলেছেন , এখানকার চীনা নাগরিকরা অত্যন্ত বন্ধুভাবাপন্ন। তাঁদের মুখে লেগে আছে মৃদু হাসি । আমি অল্প চীনা ভাষা শিখেছি , সঠিকভাবে মনোভাব প্রকাশ করতে পারছি না। তাই তাঁরা প্রায় আমার কথা বোঝেন না , কিন্তু তাঁদের মুখে কখনো বিতৃষ্ণা ফোটে না । তাঁরা যে ধৈর্য্য সহকারে আমার কথা শুনেন এবং চীনা ভাষায় কথা বলতে আমাকে উত্সাহ দেন তাতে আমি গভীরভাবে মুগ্ধ হয়েছি । আমি যে এখানে থাকতে পছন্দ করি এটাই তার প্রধান কারণ ।
মিং খং বাও রুই সি-আর-আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , সময় পেলে তিনি সিয়াও সিন নামে জু-এর গলির একটি কফি-বারে কফি খেতে যান । তিনি বলেছেন , এই কফি-বারের তৈরী কফি একদম তাঁর দেশের কফির মত । সেখানে যে কেক বিক্রি হয় তাও খুবই সুস্বাদু । কফি-বারের আয়তন মাত্র বিশ-তিরিশ বর্গমিটার । সেই কোলাহাল-মুক্ত কফি-বারে বসলে তাঁর মনেহয়, তিনি যেন নিজের বাড়িতে ফিরে গিয়েছেন ।
জু-এর গলির চীনাদের সঙ্গে বিদেশীদের সম্পর্ক অতি মধুর । তিন চাকাওয়ালা গাড়ি ঠেলে মাদাম জেন ফেং ইং জু-এর গলিতে ফল বিক্রি করেন । তিনি সি-আর-আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , সেখানে থাকা বিদেশীরা রোজ তাঁর ফল কেনেন ।
তিনি বলেছেন,এই সব বিদেশী অত্যন্ত ভদ্র , আমাকে দেখা মাত্র আমার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন ।তাঁরা নানা বিষয়ে আমার সঙ্গে গল্প করতে আগ্রহী ।
অল্পসংখ্যাক বিদেশী পর্যটক পেইচিং পৌঁছে জু-এর গলির ব্যক্তিগত হোটেলে থাকেন ।ছিন জু ইউয়ান নামে একটি ব্যক্তিগত হোটেলের মালিক মাদাম জাও সু হুয়া সি-আর-আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , মাত্র এক মাস হলো তাঁর হোটেল খোলা হয়েছে । তাঁর হোটেলে ৩০টি বেড আছে। স্ট্যান্ডার্ড রুমের ভাড়া একদিন মাত্র২১০ ইউয়ান । প্রায় প্রতিদিন তাঁর হোটেলের সকল রুম ভাড়া হয়ে যায় । পরিচারক-পরিচারিকা সবাই ইংরেজি ভাষায় সাবলিলভাবে বিদেশী অতিথিদের নানা প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেন ।
সি আর আইয়ের সংবাদদাতা ছিন জু ইউয়ান হোটেলে ব্রিটিশ পর্যটক ক্রিস্টোফারের সাক্ষাত্কার নিয়েছেন । তিনি বলেছেন , তিন সপ্তাহ আগে তিনি ও তাঁর বান্ধবী চীনে এসেছেন । পেইচিং আসার আগে তাঁরা সাংহাই ও সি আনও ভ্রমণ করেছেন । বন্ধুদের সাহায্যে তাঁরা ছিন জু ইউয়ান হোটেলে উঠেছেন ।তাঁরা এই হোটেলের ভাড়া, পরিসেবা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশে সন্তুষ্ট ।
তিনি বলেছেন ,এই হোটেলের ব্যবস্থাপনা চমত্কার । বিভিন্ন দেশের অতিথিরা এখানে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে থাকেন , যেন একই পরিবারের সদস্য । এই হোটেলের রুমের ভাড়া যুক্তিসংগত ,পরিসেবা সন্তোষজনক ।
পেইচিংয়ের নগর-উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সময় গলির সংরক্ষণকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয় । পুরনো পেইচিংয়ে এখন রাস্তা প্রশস্ত করা নিষেধ।কোনো কোনো গলিতে বড় বড় গাড়ি প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না । একদিন ভ্রমনের পর ক্রিস্টোফার ও তাঁর বান্ধবী ছিন জু ইউয়ান হোটেলে ফিরে আসেন । নিরিবিলি পরিবেশে স্নানাহার সেরে তাঁদের ক্লান্ত দেহ সহজে হাল্কা হয়ে যায় ।
জু-এর গলির মত পেইচিংয়ের একহাজারেরও বেশী গলিকে রজনী যাপনের মনোহর স্থান বলা যায় ।ঠিক যেমন প্রকৌশলী বেরনা হার্ড বলেছেন, পেইচিংয়ের গলি পেইচিংয়ের ঐতিহ্যিক সংস্কৃতির একটি অংগ এবং বিদেশীদের পুরনো পেইচিং অবলোকনের একটি জানালা ।
|