সবেমাত্র সারা পৃথিবীর চীনারা চীনের ঐতিহ্যবাহী নববর্ষ তথা বসন্ত উত্সব উদযাপন করেছেন। প্রাচীণকাল থেকেই চীনের রেওয়াজ হচ্ছে, প্রতি বছরকে এক একটি জন্তুর সংগে যুক্ত করা হয়। সে অনুযায়ী ২০০৬ সাল হচ্ছে কুকুর বর্ষ।
এতক্ষন আপনারা যে ঘন্টার আওয়াজ শুনেছেন, তা কুকুর বর্ষকে স্বাগত জানানোর জন্যে সুই রি হুয়া নামক একজন লোকের নিজের মোবাইল ফোনের বিশেষ ব্যবস্থা। চীনের রীতি-প্রথানুযায়ী কোনো একটি চান্দ্রবর্ষে জন্ম নেয়া লোক এই বছরের প্রতীকী পশুকে নিজের রাশি হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন । সুই রি হুয়ার বয়স এখন ৩৬ বছর । এই বছর হলো তাঁর রাশির বছর - কুকুর বর্ষ ।
চলতি রাশির বছর সম্বন্ধে চীনাদের মধ্যে কিছু রেওয়াজ প্রচলিত রয়েছে । গত ২/৩ বছরে চীনের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির প্রতি স্বীকৃতি দেয়ার সংগে সংগে আত্মীয়স্বজনরা চলতি রাশির বছরে জন্ম নেয়া লোকদের কাছে বিশেষ বিশেষ উপহার দিয়ে থাকেন । যেমন লাল রংয়ের পোষাক আর মোজা ইত্যাদি । এই সব উপহার কল্যান ও নিরাপত্তার প্রতীক । সুই রি হুয়া আমাদের সংবাদদাতাকে বলেছেন ,
এই বছর হচ্ছেআমার রাশি বছর অর্থাত কুকুর বর্ষ । আমার বন্ধু ও পরিবারের সবাই আমার কল্যান কামনা করেছেন । তারা আমার জন্যে লাল রংয়ের গলাবন্ধ ও কোমরবন্ধ কিনে নিয়েছেন । তারা কামনা করেন , চলতি বছরে সব ব্যাপারেই আমি সার্থক হবে । আমি ভাবছি, যখন তাদের রাশি- বছর আসবে , তখন আমিও তাদের সবাইকে শুভেচ্ছা জানাবো।
চীনের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিতে কুকুর বর্ষ হলো একটি কল্যানমূলক বছর । উত্তর চীনের ব্যাপক অঞ্চলে কুকুর সম্পর্কে বহু প্রবাদ প্রচলিত আছে । যেমন কুকুর বর্ষের পরের বছরে খেতে খেতে লোকদেরপেট ফেটে যাবে । অর্থাত কুকুর বর্ষে জনসাধারণের জীবন সম্পন্ন হবে এবং প্রচুর ফলন হবে । চীনের জনগণের চোখে কুকুর বর্ষ একটি কল্যানমূলক বছর । বস্তুত কুকুর স্বয়ং একটি কল্যানের প্রতিনিধিত্বকারী পশু ।
তাহলে দেখতে খুবই সাধারণ কুকুর কেমন করে কল্যানের প্রতীক হিসেবে চীনাদের সংস্কৃতিতে দেখা দিয়েছে । এর পেছনে অনেক কারণ আছে । এটা কুকুরের শ্রেষ্ঠ চরিত্রের সংগে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত রয়েছে । এই সম্পর্কে পেইচিংয়ের রীতিপ্রথা সংক্রান্ত বিশেষজ্ঞ ওয়াং জো ই অনেক গবেষণামূলক কাজ চালিয়েছেন । তিনি গভীর আগ্রহের সংগে কুকুরের সদগুণ সম্বন্ধে বলেছেন ,
কুকুররা তাদের মালিকদের প্রতি সবসময় বিশ্বস্ত থাকে। একটা প্রবাদ আছে , কুকুরেরা কখনো পরিবারের দারিদ্র্যের পরোয়া করে না । তাদের যে কোনো খাবার দিক না কেন তারা সর্বদাই মালিকের পাশে থাকে ।
যেহেতু কুকুরের এই গুণ আছে , সেহেতু সারা চীনের লোকেরা এই ছোট পশুকে অত্যন্ত পছন্দ করেন । উত্তর -পুর্ব চীনে বসবাসকারী মান জাতির লোকেরা কুকুরকে বিশেষভাবে ভালোবাসেন । মান জাতির লোক লিউ ফেই আমাদের সংবাদদাতাকে বলেছেন , মান জাতির লোকদের মধ্যে কুকুরদের মর্যাদা খুব বেশি । তিনি বলেছেন ,
মান জাতির লোকদের মধ্যে সবচেয়ে প্রধান নিষেধাজ্ঞা হচ্ছে কুকুরকে মারার , মেরে ফেলার এবং কুকুরের মাংস খাওয়ার ওপর । এই রেওয়াজ অনেক বছর ধরে প্রচলিত হয়ে এসেছে । এখনো মান জাতির বহু বয়স্ক লোক কুকুরের মাংস খান না । মান জাতির লোকদের ঘরে ঢুকলে আপনার কুকুরের চামড়া দিয়ে তৈরি টুপি ও পোষাক পরলে চলবে না । এটাই তো নিয়ম । বস্তুত মান জাতির লোকেরা কেন কুকুরদের এত সম্মান প্রদর্শন করেন । তার পেছনে একটি রূপকথা প্রচলিত আছে । অনেক অনেক বছর আগে শত্রুরা মান জাতির একজন স্থপতিকে মেরে ফেলার জন্যে পিছু নিয়েছিল । পালিয়ে যেতে যেতে তিনি একটি কাশবনে আশ্রয় নিলেন । অতি ক্লান্তিতে তিনি বেঁহুশ হয়ে পড়লেন । শত্রুরা তাকে ধরে নেয়ার জন্যে কাশবনে আগুণ লাগিয়ে দিল । এমন সময় তার পাশের একটি হলুদ কুকুর নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে মালিকের গায় পানি ছিটিয়ে দিতে শুরু করল । অবশেষে মালিক বেঁচে গেলেন আর হলুদ কুকুর ক্লান্তিতে মারা গেল । এভাবে কুকুরটি নিজের প্রাণ দিয়ে তার মালিককে বাঁচিয়েছে । এই কাহিনী মান জাতির লোকদের বিমুগ্ধ করেছে । তাই তখন থেকে মান জাতির লোকেরা আর কুকুরের মাংস না খাওয়ার শপথ নিয়েছেন ।
চীনের সংস্কৃতিতে কুকুরদের প্রতি মানুষদের এ সব ধানণার প্রতি অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা জেমস ওয়েস্টও সায় জানিয়েছেন । চীনের রাশি গণনার হিসাব অনুসারে প্রতি ১২ বছরে একটি রাশিচক্র সম্পন্ন হয় । জেমসের বয়স এখন ২৪ বছর । চলতি বছর ঠিক তার রাশির অর্থাত কুকুর বর্ষ। প্রাণখোলা ও প্রাণচঞ্চল জেমস আমাদের সংবাদদাতাকে বলেছেন , তিনি নিজের রাশি অত্যন্ত পছন্দ করেন । তিনি আশা করেন যে , তিনিও কুকুরদের এই সব উত্কৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী হবেন । তিনি বলেছেন ,
আমি জানি চীনের রাশিচক্রে ১২টি পশু আছে । আমি নিজেও কুকুর রাশির জাতক । আমার জানা আছে ,কুকুর খুবই বিনয়ী ও বিশ্বস্ত প্রাণী । কখনো কখনো তারা খুব চঞ্চল । আমি আশা করি , আমি নিজেও এই সব সদ্গুণের অধিকারী হবো । আমি ধুমধামের সংগে কুকুর বর্ষ উদযাপন করতে চাই ।
জ্যাম্স আমাদের সংবাদদাতাকে বলেছেন , অস্ট্রেলিয়ায়ও অনেকেই কুকুর পছন্দ করেন । প্রকৃতপক্ষে এখন বিশ্বের বহু দেশ আর অঞ্চলে কুকুরেরা ধাপে ধাপে জনসাধারণের জীবনে প্রবেশ করেছে এবং তাদের ভালো বন্ধুতে পরিণত হয়েছে ।
চীনে অধিক থেকে অধিকতর লোক কুকুর পালন করছে পেইচিংবাসী ওয়াং পিং চুই তার বাসায় নিউ নিউ নামে একটি ছোট কুকুর পালন করছেন । সে মিসেস ওয়াং ও তার পরিবারের সংগে ৯ বছর ধরে বসবাস করছে । নিউ নিউর সারা শরীর সাদা লোমে ঢাকা । তার দুটো কান সামনের দিকে সোজা করে থাকে । মিসেস ওয়াং বলেছেন , তিনি নিউ নিউকে তার পরিবারের একটি সদস্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন । কুকুরটি তার জীবনের জন্যে বহু আনন্দ এনে দিয়েছে ।
এখন আমরা সবাই দালানকোঠায় থাকি বলে প্রতিবেশীদের সংগে আমাদের কোনো আলাপ নেই । কুকুরদের পালনের মাধ্যমে আমি অনেক প্রতিবেশীর সংগে আদান -প্রদান করতে পেরেছি । তাদের মধ্য থেকে আমি অনেক বন্ধু পেয়েছি । আমাদের মধ্যে নানা বিষয় নিয়ে কথাবার্তা হয় । কুকুর সত্যিই আমাদের জন্যে অনেক আনন্দ এনে দিয়েছে ।
|