গত বছরের শেষ দিকে বিরাট আকারের একটি সুন্দর বাস উত্তরচীনের থিয়েনচিন বন্দর থেক জাহাজযোগে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়েছে । এটা চীনের এক নতুন রেকর্ড, কারণ এর আগে চীনের যাত্রীবাহী গাড়ি ইউরোপ ও আমেরিকার উন্নত দেশের বাজারে প্রবেশ করতে পারে নি । ২০০৬ সালে চীনের এক শো অনুরূপ বাস যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানী করা হবে । এই বিরাট সৌখিন ধরনের বাস কারখানা হলো চীনের চেংচৌ উইথোং গাড়ি কোম্পানি (লিমিটেড)।
দশাধিক বছর আগে এই কোম্পানির এই গাড়ি কারখানার নাম খুব কম লোকই জানতো। সেই সময়ে এ-রকম গাড়ি কারখানা চীনে শত শত ,এমন-কি এক হাজারেরও বেশি ছিল। ইউথোং কোম্পানি শুধু কয়েকটি মামুলী ধরনের গাড়ি তৈরী করতে পারতো। তবে কোম্পানির লোকেরা কঠোর প্রয়াস চালিয়ে উত্কৃষ্ট ধরনের মাঝারী ও বড় আকারের বাস তৈরী করে রাশিয়া, মিসর, ইরান ও কিউবা প্রভৃতি প্রায় ৩০টি দেশ বা অঞ্চলে ,এমন -কি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে রফতানী করতে পেরেছেন ।
মার্কিন বাজারে বিদেশী গাড়ি প্রবেশের শর্ত খুব কড়া, মানদণ্ড খুবই উঁচু । এ পর্যন্ত ইউরোপ, জাপান বা দক্ষিণ কোরিয়ার তৈরী বাস খুব কমই মার্কিন বাজারে প্রবেশ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা হলো ইউথোং কোম্পানির জন্য একটি মহাকর্মকাণ্ড। যুক্তরাষ্ট্র থেকে অর্ডার পাওয়ার পর এই কোম্পানির প্রথম কাজ হলো যুক্তরাষ্ট্রের সড়ক পরিবহনের সংশ্লিষ্ট আইন ও নিয়মবিধি এবং প্রযুক্তিগত মানদণ্ড গবেষণা করা । ইউথোং কোম্পানির আমেরিকা বিভাগের পরিচালক চাং ইয়াও-উ বলেছেন, " এই নিয়মবিধির বইয়ের মোট ৭৬০ পৃষ্ঠা আছে, আমি এক মাস ধরে এই বই অনুবাদ করেছি। প্রথমে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্রিষ্ট নিয়মবিধি ও চাহিদা ভাল করে জানতে হবে, যাতে আমার রপ্তানীর জন্য নতুন বাসের ডিজাইন তৈরি করার সময়ে এই সব নিয়ম ও মানদণ্ডের কথা আগে থেকে বিবেচনা করতে পারি।"
মার্কিন বাজারে প্রবেশের অসুবিধা শুধু আইনের দিক থেকে নয়, উপরন্তু ভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি , অভ্যাস এবং উত্পাদন খরচ ইত্যাদি কথাও তো বিবেচনা করতে হয়। কোম্পানিটির প্রকৌশলী চু ইয়ংশেং মনে করেন, বাজারে প্রবেশের জন্য নতুন বাসের ডিজাইন ভাল হওয়া প্রয়োজন। তা মজবুত, টেকসই , নিরাপদ এবং উন্নত সরঞ্জামেসজ্জিত হওয়া চাই। তিনি বলেছেন, " যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তার দিক থেক খুব কড়াকড়ী দাবি জানায়। যেমন আমাদের সাধারণ বাসের পাশের জানালা কাঁচ দিয়ে পুরোপুরি বন্ধ করে রাখা হয়, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র মনে করে ,এটা নিরাপদ নয়। বরং জানালার কাঁচ সহজে উঠানামা-যোগ্য হওয়ার জন্য দাবি জানায়। বাসের ভেতরে যাত্রীদের চলাচলের করিডোর এবং চেয়ারের মধ্যকার ব্যবধান প্রশস্ত হওয়া চাই বলে ডিজাইনের বিরাট পরিবর্তন করতে হয় ।
কর্মীরা ১৬ মাস কঠোর প্রচেষ্টা চালানোর পর অবশেষে মার্কিন বাজারের চাহিদা মেটানোর মতো চমত্কার বাসের ডিজাইন সম্পন্ন করেছেন।২০০৫ সালে ইউথোং কোম্পানির তৈরী ৪০০ বাস কিউবায় রপ্তানী হয়েছে।২০০৫ সালের প্রথম ৬ মাসে এই কোম্পানির বিদেশে বাস বিক্রী থেকে অর্জিত আয় ৩.৭ কোটি মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। বর্তমানে ইউথোং কোম্পানি এশিয়ায় বাস উত্পাদনের বৃহত্তম ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে । হোনান প্রদেশের গাড়ি শিল্প সমিতির মহাসচিব লিউ সিয়াওমিং জানিয়েছেন, বিদেশের বাজারে এই কোম্পানির সাফল্যের মূলে রয়েছে তার উন্নত প্রযুক্তির প্রয়োগ। তিনি বলেছেন, "ইউথোং কোম্পানি বিদেশের নামকরা মার্কার বাস কোম্পানির উন্নত প্রযুক্তি ও ব্যবস্থাপনার অভিজ্ঞতা শিখেছে, এর সঙ্গে সঙ্গে খুব সফল ও কার্যকরভাবে নিজের মার্কার স্বকীয়তা ও প্রযুক্তির কতকগুলো স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে পেরেছে।চীনের গোটা গাড়ি শিল্পে এটা এক সফলতার আদর্শ।"
উপরোক্ত নামকরা মার্কার বিদেশী বাস কোম্পানি হলো জার্মানির ম্যান কোমের্সিয়াল ভিইকল কোম্পানি। ২০০২ সালে ইউথোং কোম্পানি জার্মানির এই গাড়ি কোম্পানির সঙ্গে যৌথভাবে ৩২ কোটি ইউয়ান পুঁজিবিনিয়োগ করে একটি যৌথ কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং জার্মানির মিউনিকে এই যৌথ কোম্পানির প্রযুক্তিকেন্দ্র স্থাপিত হয়েছে। এই যৌথ কোম্পানি প্রধানত উচ্চ মানের বড় বা মাঝারি আকারের বাসের চেসিস আর যন্ত্রাংশের উত্পাদন ও বিক্রয় করা।
ইউরোপের উন্নত প্রযুক্তি শেখার সঙ্গে সঙ্গে ইউথোং নিজের উদ্যোগে প্রযুক্তি গবেষণা ও উন্নয়নের উপর গুরুত্ব দেয়। কোম্পানিটি প্রতি বছর তার গাড়ি বিক্রয়জনিত আয়ের ৪ শতাংশ গবেষণার কাজে ব্যবহার করে থাকে । এটা বিদেশের উন্নত কোম্পানির প্রায় সমান। বর্তমানে ইউথোং কোম্পানির নতুন ধরনের দ্রব্যের মূল্য কোম্পানির মোট বার্ষিক উত্পাদনমূল্যের শতকরা ৪০ ভাগেরও বেশি। এ পর্যন্ত ইউথোং কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের ৯০টি মেধাস্বত্বের প্যাটেণ্ট পেয়েছে। এই কোম্পানির মধ্যপ্রাচ্য অঞ্চলের কমিশনার লি মুওয়াই জানিয়েছেন, গরম আবহাওয়া, তুফান আর মরুভূমির পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়ার ব্যাপারে ইউথোং কোম্পানির বাসের উত্কৃষ্টতার জন্য এই কোম্পানি মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে ইরানের বাজরে প্রবেশ করেছে। তিনি বলেছেন, " ইরানে ইউরোপের বেঞ্জ-এর মতো মার্কার বাস ও গাড়ি বেশি, কিন্তু গাড়িগুলো খুব পুরানো, ভাল করে মেরামত হয় নি। ইরান সরকার বিশ্বে নতুন বাস বেছে ক্রয় করার জন্য ২০০৫ সালে দুবার চীনে গাড়ি তদন্ত দল পাঠিয়েছে । অবশেষে ইউথোং কোম্পানির বাস গাড়ি বেছে নিয়েছে এবং এক হাজার বাস কেনার চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এটা শুধু ইরানের বাস নবায়নের বিরাট পরিকল্পনার প্রথম অর্ডার।"
বর্তমানে ইউথোং কোম্পানির বাস উত্পাদনের বার্ষিক ক্ষমতা ১৮ হাজারটি। এবং বছরে ৮০০০ বাসের চেসিস উত্পাদন করে। কোম্পানিটির লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৫ থেকে ৭ বছরের মধ্যে কোম্পানির আয় ৩০ বিলিয়ন রেমিনবিতে বাড়িয়ে দেবে এবং কোম্পানিটি বিশ্বের প্রথম পাঁচটি বৃহত্তম বাস কোম্পানির একটিতে পরিণত হবে।
|