তাঁর দেহ ছোট-খাটো, মুখে পরিষ্কার ও সরল হাসি, অনেক দূর থেকে আমাদের দিকে হাত মেলে দিয়েছেন, তাঁর চোখে উষ্ণ ও মমতা ভরা, এমন একজন খ্যাতিমান গ্রামীন বৃদ্ধ আধুনিক চীনের কৃষকদের মাঝে বিস্ময় সৃষ্টি করেছেন। তিনি একটানা ৪৮ বছর ধরে হুয়াশি গ্রামের কমিউনিস্ট পার্টি কমিটির সম্পাদক ছিলেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন হুয়াশি গ্রামের বাসিন্দারা অতীতে পেট ভরা খেতে পারতো না, বর্তমানে প্রত্যেক পরিবারের নিজস্ব বাগান বাড়ি এবং গাড়ি আছে। মাথাপিছু দশ লাখ ইউয়ানের বেশি আমানতের অধিকারী হুয়াশি "বিশ্বের প্রথম গ্রামে" পরিণত হয়েছে।
এই অসাধারণ গ্রামীন বৃদ্ধ হচ্ছেন ৯০ কোটি চীনা কৃষকের গৌরব কৃষক চিন্তাবিদ , চিয়াংসু প্রদেশের হুয়াশি গ্রামের প্রাক্তন সম্পাদক উ রেন বাও। তিনি বলেন, আমি কমিউনিস্ট পার্টিকে বিশ্বাস করি। যে কোন সময় আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, কমিউনিস্ট পার্টির উদ্দেশ্য হচ্ছে নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠ জনগণের জন্য সুখী জীবন বয়ে আনা। আগে আমি খুব গরীব ছিলাম, তাই আমি দরিদ্র লোককে দেখে মনে ব্যথা পাই। আমার বড় আশা-আকাঙ্খা হচ্ছে দরিদ্র লোকদের জন্য সুখী জীবন বয়ে আনা। এটা হচ্ছে আমার চালিকাশক্তি।
গত শতাব্দীর ৭০র দশকে তত্কালীন দশটি উত্পাদন দল নিয়ে গঠিত হুয়াশি গ্রাম উ রেন বাওয়ের নেতৃত্বে চীনের প্রত্যেক মু জমিতে এক টন খাদ্য ফরানোর প্রথম গ্রামে পরিণত হয়েছে।
আশি দশকের প্রথম দিকে চীনের গ্রামাঞ্চলে এক নতুন গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার চালু হয় । ১৯৮২ সালে প্রকাশিত চীনের কেন্দ্রীয় কমিটির এক নং দলিল অনুযায়ী, জমি কৃষক পরিবারগুলোকে ভাগাভাগি করা এবং উত্পাদনের পরিমাণ নির্ধারণ করার দায়িত্ব বহন করার ব্যবস্থা" দ্রুতই চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে সম্প্রসারিত হয়েছে।
কিন্তু গোষ্ঠী অর্থনীতির ভিত্তিতে শক্তিশালী হওয়া হুয়া শি গ্রাম কি করবে? উ রেন বাও মনে করেন, কেন্দ্রীয় কমিটির নীতির চূড়ান্ত উদ্দেশ্য হচ্ছে কৃষকদের সমৃদ্ধ করা। হুয়া শি গ্রামের মাথাপিছু জমি মাত্র অর্ধেক মু, সেখানের গোষ্ঠী অর্থনীতি বলিষ্ঠ হয়েছে, কৃষকদের জীবনযাত্রার মান দিন দিনে ভালো হচ্ছে, তাহলে গোষ্ঠীর জমি ভাগাভাগি করলে কি লাভ? সেই জন্য উ রেন বাও গ্রামের সম্মেলনে বলেছেন, "বর্তমান হুয়া শি গ্রামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য হচ্ছে আরো জোরালোভাবে গোষ্ঠী অর্থনীতি উন্নয়ন করা, সকলের জীবন আরো সমৃদ্ধ করা। এটা হচ্ছে সমাজতন্ত্রের মৌলিক উদ্দেশ্য। "তাঁর কথা শুনে হুয়া শি গ্রামের জমি ভাগাভাগি করা হয় নি, নিজের যুক্তিযুক্ত পথে এগিয়ে চলেছে। বিশ বছর পর প্রাচুর্য গোষ্ঠী অর্থনীতির ভিত্তিতে এই গ্রামের কৃষকরা চীনের সবচেয়ে ধনী কৃষক হয়েছেন।
১৯৯২ সালের ১ মার্চ চীনের মহান নেতা দেং সিয়াও পিং দক্ষিণ চীনে পর্যবেক্ষণ করার সময় দেয়া ভাষণ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। তা পড়ে উ রেন বাও মহা খুশি হন , একই দিন রাত ২টায় জরুরীভাবে গ্রামের সকল ক্যাডার নিয়ে এক অধিবেশন আয়োজন করেন। তিনি বলেছেন, চীনের নতুন দফা অর্থনৈতিক উন্নয়ন শীঘ্রই আসবে। আমরা এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ঋণ ধার করে অর্থনীতি উন্নয়ন করবো।"
এরপর অল্প কয়েক দিনের মধ্যে হুয়া শি গ্রাম সংগৃহীত কয়েক কোটি ইউয়ান রেনমিনপি দিয়ে হাজার হাজার টন ইস্পাত কিনে দ্রুত গ্রামে শিল্পপ্রতিষ্ঠা এবং উত্পাদন শুরু করে। অন্য লোক দেং সিয়াও পিংয়ের ভাষণের মর্ম শেখার সময় হুয়া শি গ্রাম অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্রোতে দৌঁড়ে সামনে চলে গেছে।
গ্রামটি পর পর টেলিফোন গ্রাম, রঙ্গিন টেলিভিশন গ্রাম, এয়ার-কান্ডিশন গ্রাম, গাড়ি গ্রাম এবং বাগান বাড়ি গ্রাম বাস্তবায়িত হয়েছে। একবিংশ শতাব্দী প্রবেশের পর কিছু গ্রামবাসী ৩০ লাখ ইউয়ান মূল্যের পঞ্চম প্রজন্মের বাড়ীতে স্থানান্তরিত হয়েছে।
কিন্তু আমাদের সংবাদদাতা উ রেন বাওয়ের বাসায় প্রবেশ করার সময় অবাক হতে কথা বলতে পারেন না। সেখানের সাধারণ কৃষকরা স্বর্গের মতো জীবনযাপন করছেন, কিন্তু এই স্বর্গের সৃষ্টিকারী আর তাঁর স্ত্রী এখনো বিংশ শতাব্দীর ৭০ দশকে নির্মিত পুরোনো ভবনে থাকেন, আসবাবপত্রও পুরাতন, কেবল দেওয়ালে বহু জাতীয় নেতা এবং বিশ্বের বিভিন্ন মহলের ব্যক্তিদের সঙ্গে ধরা গ্রুপ ছবি দেখে বুঝা যায় এই পুরাতন ঘরের অসাধারণ দিক।
গ্রামবাসীরা আমাদের বলেছেন, বিশাধিক বছর আগে, উ রেন বাও নিজেকে তিনটি নিয়ম প্রণয়ন করেছেন, তা হচ্ছে তিনি এই গ্রামের সবচেয়ে বেশি বেতন নেবেন না, সর্বোচ্চ বোনাস নেবেন না, এই গ্রামের শ্রেষ্ঠ বাড়ীতে থাকবেন না।
১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত হুয়া শি জেলার গণ সরকার উ রেন বাওকে মোট ৫ কোটি ইউয়ান পুরস্কার দিয়েছে। কিন্তু উ রেন বাও এক ইউয়ান পুরস্কারও নিজের ব্যাঙ্কে রাখেন নি, তিনি হেসে বলেছেন, আমি এতো বেশি টাকা নিয়ে কি করবো। আমি নিবো না, গ্রামের জন্য রেখে দেবো, জনসাধারণের জন্য রেখে দেবো।"
হুয়া শি গ্রামের প্রবেশ দ্বারের পাশে এক বড় বোর্ড আছে, সেখানে লেখা আছে উ রেন বাওয়ের কথা "বাসায় কয়েক টন স্বর্ণ থাকলেও দিনে মাত্র তিন বার ভাত খেতে পারে; বাড়ীঘর সবচেয়ে সুন্দর হলেও একজন মাত্র এক বিছানার জায়গায় থাকতে পারে।"
একজন জার্মান রাজনীতিবিদ হুয়া শি গ্রাম পরিদর্শন করার পর বলেছেন, "হুয়া শি গ্রামের সমৃদ্ধি দেখে আমার মনে হয়, আমার স্বচোখে এক শ বছর আগে মার্কসের পরিকল্পিত সাম্যবাদ এবং সমাজতন্ত্রের সত্যিকার সমৃদ্ধি দেখেছি।"
হুয়া শি গ্রামের নিয়ম অনুযায়ী, গ্রামের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রত্যেক কর্মচারী প্রতি মাসে মাত্র ৫০ শতাংশ বেতন নিতে পারেন, বাকী ৫০ শতাংশ শিল্পপ্রতিষ্ঠানের পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করা হয়, বছরের শেষ দিকে কর্মচারীরা তা নিতে পারেন। বোনাস সাধারণতঃ নিজ বেতনের তিন গুণ, এর ৮০ শতাংশ শেয়ার হিসেবে শিল্পপ্রতিষ্ঠানে দেয়া হয়, দ্বিতীয় বছর থেকে মুনাফা শেয়ার করে।
কেউ বলেন, হুয়া শি গ্রামে ব্যক্তিগত সম্পদ হলেও নিজে ব্যবহারের অধিকার নেই। কিন্তু এই বিষয়ে হুয়া শি গ্রামের কৃষকরা বলেন, "এই ব্যবস্থা খুব ভাল, না হলে আমরা কি ভাবে বাগান বাড়ীতে থাকতে পারবো, গাড়ি চালাতে পারবো। আমাদের টাকা গ্রামে আমানত করলে আমরা মুনাফা শেয়ার করতে পারি, তা দিয়ে নিজে ধনী হয়েছি, গোষ্ঠীও শক্তিশালী হয়েছে। "
সংবাদদাতা প্রশ্ন করেছেন, "টাকা দরকার হলে আপনারা কি করেন?"
গ্রামবাসীরা উত্তর দিলেন, "বিয়ে হওয়া বা বাসায় কেউ মারা গেলে এমন বড় ঘটনা ঘটলে গ্রামের কাছে একটি রিপোর্ট দিলে নিজের প্রয়োজনীয় পরিমাণ টাকা নিতে পারবো। দৈনন্দিন জীবনে টাকার অভাব হয় না। কারণ অসুস্থ হলে চিকিত্সার ফি গ্রাম বহন করে। চাউ, ময়দা, শাকসব্জি, তেল প্রভৃতি খাবার গ্রাম প্রতি পরিবারকে যথেষ্ঠ পরিমাণ দেয় এবং প্রতি বছরে গ্রামের রেস্তোরায় খাওয়ার জন্য ৩ হাজার ইউয়ান মূল্যের টিকিট দেয়া হয়। তা ছাড়া, পুরুষরা ৬০ বছর এবং নারীরা ৫৫ বছর বয়স থেকে প্রতি মাসে বয়স্ক ভাতা পান।
উ রেন বাও একটি অবিরত বীজ লাগানো যন্ত্রের মতো সমাজতান্ত্রিক সুখী জীবনের বীজ আরো বেশি কৃষকের মনে ছড়াতে চান, আরো বিস্তীর্ণ মাটি ফেলতে চান।
|