মিতব্যয় বা সাশ্রয় হলো হাজার হাজার বছর ধরে চীনা জাতির একটি সুষ্ঠু নীতি । চীনাদের অভ্যাস হলো " বেশি সঞ্চয় করা এবং কম খরচ করা"। কিন্তু তার একটি ব্যতিক্রম হলো বসন্ত উত্সব। এই আনন্দময় সময়পর্বে চীনারা আপাতত: এ-সব নীতিকথা ভুলে গিয়ে আমোদপ্রমোদ বা ভোগবিলাস করতে থাকেন। তাই চীনাদের ঐতিহ্যিক বসন্ত উত্সব হলো গোটা চীনা জাতির ভোগবিলাসের "কারনিভাল"।
চৈনিক চন্দ্রবর্ষের সর্বশেষ দিনে পরিবারের সকলে একসাথে নৈশভোজে মিলিত হওয়াই চীনাদের বসন্তউত্সবের ঐতিহ্য। অতীতে চীনারা সাধারণত নিজেদের বাড়ীতেই এই বার্ষিক নৈশভোজ উপভোগ করতেন। আজকাল চীনাদের আয় বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অধিক থেকে অধিকতর সংখ্যক লোক রেস্তোরাঁয় এই নৈশভোজ খেতে পছন্দ করছেন। ফলে বসন্ত উত্সবের সময়পর্বে রেস্তোরাঁ বন্ধ করে রাখার পরিবর্তে এখন তা খোলা রেখে বেশি বেশি লোককে আপ্যায়ন করা হচ্ছে । পেইচিং , সাংহাই ও ছোংছিং মহানগর এবং কুয়াংচৌ প্রভৃতি বড় বড় শহরের নামকরা রেস্তোরাঁর এই চৈনিক বর্ষের শেষ দিনের নৈশভোজের আসন বুকিং দু'মাস আগেই সম্পূর্ণভাবে শেষ হয়েছে । পিকিং ডাক রেস্তোরাঁর ছুয়েনচুতে গোষ্ঠির দায়িত্বশীল ব্যক্তি মাদাম লিউ কুইফাং বলেছেন, এ বছরের বসন্ত উত্সবের সময়পর্বে রেস্তোরাঁ ব্যবসা আবার রেকর্ড স্থাপন করবে। তিনি বলেছেন
"লোকেরা আগে আগেই রেস্তোরাঁর কক্ষ, টেবিল বা আসন বুকিং করে ফেলেছেন, চান্দ্রবর্ষের শেষ দিনের বার্ষিক ভোজের যাবতীয় আসন বুকিং আগে থেকেই শেষ হয়েছে। গত বছর ছূয়েনচুতে পিকিং ডাক রেস্তোরাঁ গোষ্ঠি একমাত্র পেইচিং শহরেই আয় অর্জন করেছে এক কোটি ইউয়ান। এবারকার বসন্ত উত্সবের সাত দিনের ছুটিতে আয় আরও ভাল হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।"
বসন্ত উত্সব উপলক্ষে চীনে বিভিন্ন বিদেশী রেস্তোরাঁর ব্যবসাও খুবই ভাল । ম্যাকডোনাল্ড এবং কেণ্টাকির মতো বিদেশী ফাস্ট ফুড রেস্তোরাঁ চীনা নববর্ষের জন্য বিশেষভাবে সাজানো হয়েছে। গোটা উত্সবের সময়পর্বে এখানে রেস্তোরাঁশিল্পের আয় ২০ কোটি ইউয়ান ছাড়িয়ে যাবে বলে অনুমাণ করা হচ্ছে।
এই উত্সব উপলক্ষে চীনে ওয়াল-মার্ট, ক্যারেফোর প্রভৃতি বিদেশী সুপারমার্কেটও চীনা শৈলীতে লণ্ঠন এবং চীনা নববর্ষের বিশেষ ছবি ইত্যাদি দিয়ে সাজানো হয়েছে।
বসন্ত উত্সবের সাত দিন ছুটির সুযোগ নিয়ে অনেকেই বিদেশ ভ্রমণ করতে চান। শেনইয়াং শহরের নতুন বিবাহিতা ছি রুই বলেছেন, " ছুটিতে আমি স্বামীর সঙ্গে হংকং ভ্রমণ করবো, দর্শনীয় স্থান এবং সেখানকার রীতিপ্রথা দেখতে চাই, তবে প্রধান উদ্দেশ্য নামকরা মার্কার জিনিস কেনা । শুনেছি, ওখানে উত্সবকালে জিনিস কেনার ডিস্কাউণ্ট বেশি হয়। তা'ছাড়া নতুন ডিজনি পার্কে তো ঘুরে আসতে হবেই। সেখানে আমি চার-পাঁচ হাজার মার্কিন ডলার খরচ করবো, আসলে এটা তো আমাদের হানিমুন ।"
চীনের আন্তর্জাতিক পর্যটন এজেন্সির বাজারায়ন বিষয়ক ম্যানেজার চাং শুও বসন্ত উত্সবকালে পর্যটনের ব্যবসা সম্পর্কে খুবই আশাবাদী। তিনি বলেছেন, "আগের বছরগুলোতে বসন্ত উত্সবের দীর্ঘ ছুটিতে লোকেরা বাড়িতে বসে বসে রাত জেগে নববর্ষকে স্বাগত জানাতেন। এই ঐতিহ্যিক ধারণার ক্রমেই পরিবর্তন ঘটছে । এখন অনেকেই বসন্ত উত্সবের সুযোগে , এমনকি পুরনো চান্দ্রবর্ষের শেষ দিনে দক্ষিণপুর্ব এশিয়া ভ্রমণ করতে যান। যেমন ফুকেত দ্বীপ আর বালি দ্বীপে ভ্রমণের লক্ষ্যে পর্যটন এজেন্সির সংগঠিত দলগুলোতে যোগ দেয়ার জন্য এতো বেশি লোক নিবন্ধিত হয়েছেন যে, এর চেয়ে বেশি লোক গ্রহণ করা আর সম্ভব হবে না। এই উত্সব আমাদের পর্যটনশিল্পের এক অতি ব্যস্ত মউসুমে পরিণত হয়েছে, আমাদের মুনাফা বেড়েছে।
গত বছরের বসন্ত উত্সবে পেইচিং থেকে ৩২ হাজার লোক এবং সাংহাই থেকে ২৮ হাজার লোক বিদেশ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। এবছর বিদেশভ্রমণকারীদের সংখ্যা নতুন রেকর্ড স্থাপন করবে।
বসন্ত উত্সবে চীনা জাতির সংস্কৃতির ঐতিহ্য প্রতিফলিত হয়। এখন বসন্ত উত্সবের অর্থনৈতিক তাত্পর্য বাড়ছে । চীনের রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি-বিষয়ক প্রফেসার কাও পুতে বলেছেন, " উত্সব -চলাকালে পণ্যবিক্রী বাড়ছে এবং পরিসেবা শিল্পের ফলপ্রসূতাও অনেক বাড়বে।এখন পণ্যভোগ থেকে পরিসেবামূলক ভোগের পদ্ধতিতে রূপান্তর ঘটছে। তাতে প্রতিফলিত হয়েছে যে, জনগণের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন হয়েছে ।"
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের অর্থনীতি বছরে গড়পড়তা ৯ শতাংশেরও বেশি হারে বেড়ে চলেছে। এমন-কি আপেক্ষিক অনুন্নত গ্রামাঞ্চলেও এই উত্সবের সময়পর্বে ভোগবিলাস-খাতে মাথাপিছু ব্যয় অনেক বাড়বে। উত্তরচীনের শানসি প্রদেশের গ্রামীণ মহিলা সিং হুয়া বলেছেন, "আমি ভেষজ গাছগাছড়া চাষ করেছি , তাতে উপার্জন করেছি ৫০০০ ইউয়ান। ছেলেমেয়েদের জন্য নতুন পোষাক কেনা ছাড়াও একটি নতুন মটরসাইকেল কিনতে চাই। পয়সা পুরোপুরি খরচ করতে চাই।"
এই বসন্ত উত্সবের ৭ দিনের ছুটিতে চীনের পণ্য ও পরিসেবা বাজারে চীনারা বহু বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচ করবেন।
রেনমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসার কাও পুতে উল্লেখ করেছেন, শহরবাসী ও গ্রামবাসীদের মধ্যে আয়ের বেশ ব্যবধান থাকার ফলে পয়সা খরচের পদ্ধতি ভিন্ন হয়। শহরবাসীরা পণ্যখাতে খরচের পরিবর্তে এখন পরিসেবাখাতে বেশি পয়সা খরচ করছেন। আর গ্রামবাসীরা প্রধানত পণ্যদ্রব্য কেনার ব্যাপারে খরচ করছেন। চীনে কৃষকদের মোট লোকসংখ্যা ৯০ কোটির উপরে বলে পরবর্তী কালেও চীনের বসন্ত উত্সব উপলক্ষে পণ্য বাজারে মাল বিক্রীর বিরাট সম্ভাবনা থাকবে।
|