কিছু দিন আগে ইউনেস্কো চীনের উইগুর জাতির প্রাচীন লোক -সংগীত "মুকামকে" মানব জাতির একটি মৌখিক সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার নির্বাচিত করেছে । মুকামে উইগুর জাতির নাচ , গান আর সংগীত অন্তর্ভুক্ত । গত কয়েক শো বছর ধরে তিনি উইগুর জাতির সংগীতের জননী বলে আখ্যায়িত করা হয় । উইগুর জাতি - অধ্যুষিত এলাকা- সিনচিয়াং স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলে বহু লোক এই ধরণের সংগীত সম্পর্কিত গবেষণার কাজে নিয়োজিত হন । প্রফেসার সুলেইমান ইমিন তাদের মধ্যে একজন । তিনি উইগুর জাতির বহু সংগীত রচনা করেছেন এবং বেহালা , পিয়ানো প্রভৃতি পাশ্চাত্ত্য বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে এই সব সংগীতের সুর বাজান । তিনি সংগীত মহলের প্রশংসা পেয়েছেন ।
ষাটোর্ধ বছর বয়সী সুলেইমান ইমিন সিনচিয়াং শিল্পকলা ইনস্টিটিউটের একজন প্রফেসার । আপনারা একটু আগে যা শুনলেন , তা তার রচিত একটি বিখ্যাত পিয়ানো সংগীতের সুর । এই সংগীতে স্বচ্ছ আর স্ফুর্তিপূর্ণ সুরের মাধ্যমে কুলাইলাই নামে এক অল্পবয়সী মেয়ের প্রতি তরুণদের প্রশংসা আর ভালবাসা তুলে ধরা হয়েছে । এই সংগীত এখন একটি আদর্শ সংগীত হিসেবে অনেকের কাছে সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষিত আছে । সুলেইমানের রচিত বেহালায় বাজানো সংগীত "শ্রদ্ধাঞ্জলী" আর পিয়ানো সংগীত " তোমার কথা আমার মনে আছে" প্রভৃতি সংগীত চীনের বহু সংগীত ইনস্টিটিউটে ছাত্রছাত্রীদের পড়ানোর সময়ে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয় । কিছুসংখ্যক বেহালা বাদক অস্ট্রেলিয়া , রাশিয়া প্রভৃতি দেশেও এই সব সংগীত বাজিয়েছেন আর শিখিয়েছেন ।
উইগুর জাতির একটি সাধারণ কৃষক পরিবারে প্রফেসার সুলেইমানের জন্ম । তার বাবা নাচ গান পরিবেশনায় পারদর্শী । তার সংগীত প্রতিভা আর নৈপুণ্য সুলেইমানকে খুব প্রভাবিত করতো । বাবার প্রভাবে তিনি ছোট বেলা থেকেই সংখ্যালঘুজাতির সংগীত অত্যন্ত পছন্দ করেন ।
তিনি ছোট বেলা থেকে বাবার গাওয়া লোক সংগীত শুনতে পছন্দ করেন । প্রাথমিক স্কুলে পড়াশুনার সময়ে বাবা আমাকে ইটওয়াফু নামে উইগুর জাতির বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বেহালার মতো এক ধরণের বাদ্যযন্ত্র কিনলেন । তিনি আমাকে এই বাদ্যযন্ত্র বাজাতে শেখাতেন । নিম্ন মাধ্যমিক স্কুলে পড়াশুনার সময়ে আমি ইটওয়াফু ও বেহালা বাজাতে আর গান গাইতে পারদর্শী হলাম ।
ইটওয়াফু উইগুর জাতির এক ধরণের ঐতিহ্যিক বাদ্যযন্ত্র । বেহালা তো পাশ্চাত্ত্যের বাদ্যযন্ত্র । সুলেইমান অল্প বয়সে নিপুণভাবে এই দুটো বাদ্যযন্ত্র বাজাতে সক্ষম হন । উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল থেকে স্নাতক হবার সময়ে সিনচিয়াং শিল্পকলা ইনস্টিটিউটের নতুন ছাত্রছাত্রীর প্রয়োজন । সুলেইমানের বেহালা সুর শোনার পর ইনস্টিটিউটের শিক্ষকরা খুব সন্তুষ্ট হয়েছেন এবং তত্ক্ষনাত্ তাকে ইনস্টিটিউটে ভর্তি করেছেন ।
সিনচিয়াং শিল্পকলা ইনস্টিটিউট সিনচিয়াংয়ে শিল্পীদের প্রশিক্ষণদানকারী সর্বোচ্চ শিক্ষা- প্রতিষ্ঠান । ১৯৬১ সালে ১৭ বছর বয়স্ক সুলেইমান এই ইনস্টিটিউটের বেহালা ক্লাসের একজন ছাত্র হন । ছাত্র জীবনে তিনি একাগ্রচিত্তে বেহালা বাজানোর কলা-কৌশল শেখার সংগে সংগে সংগীত রচনার কাজও শুরু করলেন । স্নাতক হবার জন্য তার রচিত ইটওয়াফু বাদ্যযন্ত্রে বাজানো চারটি সুর সংগীত শিক্ষকদের উচ্চ মূল্যায়ন পেয়েছে ।
লেখাপড়ায় কৃতিত্বের জন্য সুলেইমান স্নাতক হবার পর ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনা করেন । তিনি বলেছেন , সংগীত চর্চার বিষয়ে তিনি যে এত সুফল অর্জন করেছেন , তাতে তিনি অধ্যাপনার সুযোগের ওপর আরো গুরুত্ব দেন ।
একজন শিক্ষক হিসেবে সংগীত চর্চা আর পড়ানোর বিষয়ে পারদর্শী হওয়া উচিত । আমি বহু সময় ব্যবহার করে অন্যান্য সংখ্যালঘুজাতি ও বিদেশী লোক সংগীত অধ্যয়ন করেছি । অনুশীলনে আমি আবিষ্কার করেছি যে , উইগুর জাতির লোক সংগীত আরো বেশি অধ্যয়ন করতে হবে । আমাদের মুকাম সংগীত সংগীতের ঐশ্বর্য ভান্ডার ।
মুকামে ৩৪০টি গান আর সংগীত আছে । এটা একটা বিরাট সংগীত ব্যবস্থা । সুলেইমান বলেছেন , মুকাম সংগীত শুনতে খুবই মিষ্টি । তবে রপ্ত করা খুব কঠিন । কারণ তার সুর অত্যন্ত জটিল । তার নিয়ম আয়ত্ত করার জন্য সুলেইমান দিন রাত শুনতেন এবং তার সুর অনুসরণ করে বাজাতেন আর গাইতেন । বেশি শ্রবন করলে আর গাইলে এই ধরণের সুর আয়ত্ত করা সহজ হবে । সুলেইমানের বহু মুকাম সংগীত শেখার জন্য পাঁচ বছর সময় লেগেছে । তিনি বাজাতে বাজাতে গান গাইতেন । ধীরে ধীরে তার সংগীত রচনার ইচ্ছা অধিক থেকে অধিকতর হয়ে উঠেছে । তিনি বলেছেন ,
আমি পাশ্চাত্ত্যের বাদ্যযন্ত্রের মাধ্যমে উইগুর জাতির সংগীত বাজাতে চেয়েছি , যাতে এই প্রণালীর মাধ্যমে আরো বেশি লোক , বিশেষ করে বিদেশীরা আমাদের সিনচিয়াংয়ের সংগীত সম্পর্কে জানতে পারেন । তবু পাশ্চাত্ত্যের বাদ্যযন্ত্রের সংগে সংখ্যালঘুজাতির সংগীত যোগ করা খুব কঠিন । এই ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করতে হলে বেশি সময় আর পরিশ্রম লাগবে ।
সংগীত রচনার সময়ে আবেগ আর সুর রচনার অনুভূতি আসলে সুলেইমান দিন -রাত উপেক্ষা করে কাজ করতেন । তার সহকর্মী , সিনচিয়াং শিল্পকলা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মিঃ কুয়েন ওয়েন হুই বলেছেন , ইনস্টিটিউটে সুলেইমানের পরিশ্রম সর্বজনবিদিত । পথে হেঁটে চলার সময়েও তিনি গুনগুন করে গলায় সুর ভাজতেন । কুয়েন ওয়েন হুই সংবাদদাতাকে বলেছেন ,
প্রফেসার সুলেইমান বহু মূল্যবান গ্রন্থ প্রকাশ করেছেন । এর মধ্যে সংখ্যালঘুজাতির লোক সংগীত সম্পর্কে তার লেখা বহু গ্রন্থ আন্তর্জাতিক পুরস্কার জয় করেছে । তিনি পাশ্চাত্ত্য বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করে বেশ কিছু লোক- সংগীত রচনা করেছেন ।
এ পর্যন্ত সুলেইমান দু' শতাধিক সংগীত রচনা করেছেন । এর মধ্যে সিমফোনি , পিয়ানো সংগীত আর বেহালা সংগীতও অন্তর্ভুক্ত । বহু দেশী-বিদেশী বাদ্যযন্ত্রী তার এই সব সংগীত বাজান ।
সিনচিয়াংয়ের সংখ্যালঘুজাতির লোক সংগীতের প্রতি সুলেইমানের ভালবাসা আর অধ্যবসায় তার অধ্যাপনাতেও দেখা দিয়েছে । তার রচিত সংগীত সংকলন এখন সংগীত সম্পর্কিত পাঠ্যপুস্তকে পরিণত হয়েছে ।
|