শিশু বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাদাম উ বলেছেন , অনেক লোক মনে করেন যে ,নেতিবাচক মনোভাব ভাল নয়,এ প্রবণতা এড়াতে হবে ।কিন্তু আমি মনে করি ,এধরনের মনোভাব আমাদের বড় হওয়া ও পরিপক্ক হওয়ার প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় প্রভাবক । কিছু কিছু অভিভাবক নিজের সন্তানকে নেতিবাচক মনোভাবের মধ্য দিয়ে উত্তীর্ণ হতে দিতে চান না এবং তাদের আগলে রাখার চেষ্টা করেন । যার ফলে মনোভাবের দিক থেকে ভারসাম্যহীনভাবে বেড়ে ওঠে ছেলেমেয়রা ।
ছুটির দিনে এক সকালে আমার ছেলে স্যামশিক্ষিকা থুংয়ের সঙ্গে পার্কে নৌ-বিহার ও মাছশিকার করতে যায়। সন্ধ্যার দিকে সে বাসায় ফিরে আসে । সে হাতে একটি বোতল ধরে অত্যন্ত সাবধানে ঘরে প্রবেশ করে । বোতলে তিনটা সুন্দর সোনালী রঙের মাছ । এর মধ্যে লালটা সে নিজে ধরেছে। অন্য দুটো কালো ও সাদা-লাল মেশানো মাছ অন্য লোক তাকে উপহার দিয়েছে । স্যামলাল ও কালো মাছদুটি বেশী পছন্দ করে । তাই লাল ও কালো রঙের মাছ দুটোকে সে নিজের নামে অর্থাত স্যামএবং সাদা-লালটাকে ফ্রেড বলে ডাকে ।
স্যাম মাছ তিনটিকে অত্যন্ত পছন্দ করে । বাইরে থেকে বাসায় ফেরার সঙ্গেসঙ্গে সে চিত্কার করে বলে , "আমার মাছ তিনটাকে খাবার দেব"।তার অনুরোধে আমি মাছ তিনটাকে বড় একোয়ারিয়ামে রেখে দেই ।তার পর সে নিজের রুমের মাটিতে বসে মাছগুলোর সঙ্গে খেলতে শুরু করে ।কিছু ক্ষন হতে না হতেই আমার স্বামী তাড়াহুড়া করে বৈঠকখানায় এসে আমাকে বলেন ,মাছগুলো হয়ত কাল পর্যন্ত জীবিত থাকবে না । স্যাম সেগুলোকে হাত দিয়ে ধরছে । একোয়ারিয়ামমাছের আঁশে ভরপুর । আমি বলি, তাকে স্বেচ্ছায় খেলতে দাও । সে এই প্রথমবার সোনালী মাছ পেয়েছে , নিশ্চয় এগুলোকেহাত ছাড়া করতে চায় না সে । কোনো কুফল হলেও এটা একটা চমত্কার শিক্ষার সুযোগ ।
আমার কথা শেষ হতে না হতেই নিজের রুম থেকে স্যামের কান্নাকাটিরআওয়াজ শোনা গেলোঃ লাল মাছটা মরে গেছে । সে চিত্কার করে উঠলো যে সে আর-একটা মাছ শিকার করতে চায় । কিন্তু রাতের সময়ে মাছ শিকার করা সম্ভব নয় বলে স্যাম আরও উচ্চস্বরে কেঁদে উঠে । স্বামী এসে বলেন, তোমার নিজের দোষ , আমি তোমাকে বলেছিলাম ,এভাবে মাছগুলো মরে যাবে ,কিন্তু তুমি শোনো নি । আমি স্বামীকে বললাম, তাকে সমালোচনা করো না । এতো সুন্দর মাছের মৃত্যু সত্যি দুঃখজনক ব্যাপার । তাকে ভাল করে কান্নাকাটি করতে দাও ।
স্যামঅনেক ক্ষণ ধরে কেঁদেছে । রাতের খাবার খাওয়ার পর আবার কেঁদে উঠে । আমি তাকে বলি , ফোন করে শিক্ষিকা থুংকে এ দুঃসংবাদ জানিয়ে দাও । সে কেঁদেকেঁদে মাদাম থুংয়ের সঙ্গে এই দুঃখটা ভোগ করলো ।
এক আলোচনা সভায় আমি গল্পটি বললাম । অনেক বাবামা বলেছেন , যদি নিজের সন্তান এমনি করে কাঁদে ,তাহলে আমি নিশ্চয় তাড়াহুড়া করে বাজারে গিয়ে আর একটা সোনালী মাছ কিনে দিতাম ।
সত্যি সব বাবামা নিজের সন্তানের কষ্ট সইতে পারেন না । আমরা সন্তানের আনন্দকে নিজের আনন্দ হিসেবে গ্রহন করি । স্বাভাবিকভাবে সন্তানদের দুঃখ আমাদের দুঃখে পরিণত হয় ।তাই অধিকাংশ বাবামা যে কোনো সময়ে নিজের হাতের যাদুর লাঠি অর্থাত সমস্যা সমাধানের উপায়—শক্তি, পুঁজি ও সম্পদ ব্যবহার করে দুঃখ থেকে বাচ্চাকে মুক্তকরতে প্রস্তুত ।
এ উপায়ের অর্থ হল, দুঃখ এবং দায়িত্ব এড়াতে গিয়ে সন্তানকে প্ররোচিতকরা । আসলে দুঃখ বাচ্চাদের বড় হওয়ার পথে সবচেয়ে মূল্যবান এক সম্পদ ।একজন মনস্তত্ত্ববিদপন্ডিত তার বইতে লিখেছেন , জীবনযাপনের তাত্পর্যদুঃখভোগ এড়িয়ে যাওয়া নয় । ছোটো বেলায় দুঃখ থেকে এড়িয়ে যেতে শিক্ষাগ্রহনকারীছেলেমেয়ে বড় হওয়ার পর আরও বেশী দুঃখের সম্মুখীন হতে পারে ।প্রয়োজনীয়জিনিস হারালে আর নিজের আশা-আকাঙক্ষা শিগ্গিরই বাস্তবায়িত হতে না পারলে আমরা দুঃখ প্রকাশ করতে এবং অসুবিধা থেকে সৃষ্ট শর্তের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হতে শিখতে পারি । তাহলে আনন্দ ও সাফল্য একটার পর একটা আসবে । এ থেকে বোঝা যায় যে , বাচ্চাদের শিক্ষা দেয়ার চার নীতি হল এই ,দেরীতে আনন্দউপভোগ করা , দায়িত্ব বহন করা , বাস্তব অবস্থার সম্মুখীন হওয়া এবং নিজের ভারসাম্য বজায় রাখা ।
স্যামের কথা ধরা যাক, সর্বপ্রথমে তাকে নিজের দায়িত্ব বহন করতে হবে যে ,বাবার কথা না শোনার ফলেএবং তার নিজের কারণে মাছটা মারা গেছে ।
মাছ মরে যাবার পর তার প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, আর-একটা মাছ লাভের আনন্দ দিয়ে হারানোর দুঃখ ভোলার চেষ্টা করা । কিন্তু হারানোর দুঃখ ভোগ না করে কিভাবে পাওয়র আনন্দ বুঝবে ? দেরীতে আনন্দ উপভোগ করার উদ্দেশ্য হল প্রথমে দুঃখ ভোগ করে তাকে পরাভূত করে আনন্দ ভোগ করার অনূভূতি বাড়িয় নেওয়া এবং উপভোগ করার তাত্পর্যউন্নত করা ।
তাকে এই বাস্তবতামানতে হবে যে ,মাছ মরে গেছে , দিন গড়িয়ে রাত হয়েছে ,কোথাওনতুন সোনালী মাছ পাওয়া যাবে না ।
তাকে নিজেকে ভারসাম্যপূর্ণকরার উপায় খুঁজে বের করতে হবে যে, পাওয়ার আশা পরিত্যাগ করে বাস্তব অবস্থা মেনে চলা ।আনন্দের বিষয় হল,স্যামনিজের মনের বেদনা প্রকাশ করার পর রাগ করেনি,বরং তাড়াতাড়ি শান্ত হয়েছে ।
দ্বিতীয় দিন,আমি স্যামেরসঙ্গে বাকি দুটো মাছ দেখি ।আমি তাকে বলেছি,আমি জানি,তুমি এ দুটো পছন্দ করো এবং মাছ দুটোরসঙ্গে খেলা করতে চাও,কিন্তু তাদের জোরকরে ধরা তোমার উচিত নয় ।স্যাম বলেছে,আমি জানি আমি শুধু দেখি,আমি আর তাদের ধরব না ।
স্যামেরবয়স মাত্র চার,ঘটনাটি থেকে সে প্রাথমিকভাবে দুটি বিষয় বুঝেছে । এক ,যাকে ভালবাসে,তার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করতে হবে এবং তাকে বেচে থাকার অবকাশ দিতে হবে ।দুই,যাকে ভালবাসে তাকে হারানোর ঝুঁকি নিতে হবে এবং ভালবাসার লোক বা জিনিস হারানোর দুঃখ ভোগ করার প্রস্তুতি নিতে হবে ।
বাচ্চাকে শিক্ষা দেওয়ার সময় বাবামাদের মনে রাখতে হবে যে,আমি আগেই তোমাকে বলেছিলাম ,তুমি কেন শোনো না ?এমন কথা বলে বাচ্চাকে তিরস্কার করা উচিত নয় ।বাচ্চাকে নিজের দুঃখ প্রকাশ করতে অনুমতি দিন এবং তাদের প্রতি নিজের সহানুভূতি জানান । যেমন ,ওঃ নিজের পছন্দনীয় জিনিস হারানো সত্যি এক দুঃখের ব্যাপার । বাচ্চা যত কাঁদুক না কেন অভিভাবকদের শান্ত মনোভাব বজায় রাখতে হবে ।বাচ্চাকে যুক্তি দিয়ে কথা বলতে হবে । তাকে পরিহাস করবেন না । যেমন,ছোট্টোএকটা ব্যাপার,কান্নাকাটিকরার কি দরকার ।
|