চীন অন্যতম প্রধান কৃষি অর্থনীতির দেশ, ১৩০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে ৮০ কোটিরও বেশি কৃষক । শহরবাসীদের তুলনায় অধিকাংশ কৃষকদের জীবনযাপনের অবস্থা একটু অনুন্নত । সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই অবস্থা বদলানো চীনের বিভিন্ন স্তরের সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কাজ এবং গোটা সমাজের দৃষ্টি-আকর্ষী সমস্যায় পরিণত হয়েছে। ২০০৫ সালে চীনের বিভিন্ন অঞ্চল এই ক্ষেত্রে কি কি ব্যবস্থা চালিয়েছে, কি কি সাফল্য অর্জিত হয়েছে? আপনারা হোনান প্রদেশের কয়েক জন কৃষকের অভিজ্ঞতা থেকে কিছু ধারণা পাবেন।
উত্তর-পূর্ব চীনের লিয়াও নিং প্রদেশের তালিয়েন শহর একটি মনোরম উপকুলীয় শহর। কয়েক বছর আগে, মধ্য চীনের হোনান প্রদেশের কৃষক লো ছুয়েন ইউয়ান তালিয়েনে এসে কাজ করেন। ২০০৫ সালের প্রথম দিকে কাজের সময়ে দুর্ভাগ্য ক্রমে ইস্পাতের বার তাঁর বাম পা ভেঙ্গে দিয়েছে, তিনি পায়ে অস্ত্রোপচার করিয়েছেন। নিয়োগকর্তা তাঁর চিকিত্সার ফী প্রভৃতি ক্ষতিপূরণ ফী দিতে চায় না। রো ছুয়েন ইউয়ানের দরিদ্র পরিবার এই আকস্মিক আঘাত পেয়ে প্রায় হতাশ পরিস্থিতিতে পড়েছে। পরে রো ছুয়েনের ইউয়ানের শ্রমিক ইউনিয়নের কথা মনে পড়েছে। তিনি স্মরণ করে বলেছেন, "এই সমস্যা আমি নিজেই সমাধান করতে পারবো না। সংস্থার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান করলে আমার জন্যে ভালো। সেই জন্য আমি শ্রমিক ইউনিয়নে গিয়ে এই সমস্যা সমাধানের অনুরোধ করেছি। এই দুর্ঘটনার ঘটন থেকে সমস্যার পুরোপুরি সমাধান পর্যন্ত মাত্র এক মাসেরও কম সময় লেগেছে। চিকিত্সা ফী সহ কাজের সংস্থা আমাকে মোট ৬০ হাজার ইউয়ানের বেশি রেনমিনপি পরিশোধ করেছে। "
সম্প্রতি আমাদের সংবাদদাতা রো ছুয়েন ইউয়ানের দেশের বাড়ীতে গিয়েছেন। তার দেহে কৃত্রিম পা লাগানো হয়েছে , বাড়িঘর মেরামত করেছেন, নতুন জীবনযাপন শুরু করেছেন। এখন চাষাবাদ, ফলের গাছ লাগানো এবং গাইস্থ্যপশু লালন করার আয় ছাড়াও তিনি প্রতি মাসে কয় ডজন ইউয়ান রেনমিনপির বিশেষ দারিদ্র ভাতা পান।
যে শ্রমিক ইউনিয়ন রো ছুয়েন ইউয়ানের সমস্যা সমাধান করেছে, তা হচ্ছে তাঁর আদি নিবাস হোনান প্রদেশের সিন জেলা সরকার বিশেষ করে বাইরে চাকুরি করা কৃষকদের অধিকার রক্ষা করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেছে। গত এক বছরে কেবল তালিয়েন শহরে এই শ্রমিক ইউনিয়ন ত্রিশাধিক বার আহত শ্রমিকের বিবাদ সমাধান করেছে, আহত কৃষকদের জন্য যথাযথ স্বার্থ অর্জন করেছে।
চীনের নগরায়ন প্রক্রিয়া দ্রুততর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রো ছুয়েন ইউয়ানের মতো গ্রাম থেকে শহরে গিয়ে শ্রমিকের কাজ করা কৃষকের সংখ্যা ১২ কোটিতে পৌঁছেছে। শহরে তাঁদের কর্মকালীন আহত হবার দুর্ঘটনার সম্মুখীন হবার সম্ভাবনা আছে, তা ছাড়া মাঝে মাঝে বকেয়া বেতনের সমস্যাও হয়। এই সমস্যা সমাধানের জন্য সাম্প্রতিক দু'বছরে চীনের রাষ্ট্রীয় পরিষদ বিশেষ দলিল প্রকাশ করেছে, বিভিন্ন প্রদেশেও বকেয়া বেতন পরিশোধ সংক্রান্ত নেতৃ-গ্রুপ গঠিত হয়েছে এবং এই কাজ সম্পর্কিত বিশেষ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রো ছুয়েন ইউয়ানের স্বদেশী ইন চিয়া ছি নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। "আমার মতো বাড়ীঘর ভাঙ্গার কাজ করলে প্রতি মাসে ১৮০০ ইউয়ান বেতন পাওয়ার কথা। গত বছরের প্রথমার্দ্ধে আমি তালিয়ানের একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানিতে কাজ করেছি, কিন্তু শেষের দিকে আমার বেতন বকেয়া পড়েছে। আমি কেন্দ্রীয় কমিটির কৃষক শ্রমিকের বেতন বকেয়া নিষেধাজ্ঞার নিয়ম পড়ার পর শ্রম আর সামাজিক নিশ্চয়তা বিধান বিভাগকে অবহিত করেছি। তাঁদের সাহায্যে আমি বেতন পেয়েছি। "
জানা গেছে, কেবল ২০০৫ সালের প্রথমার্দ্ধে বিভিন্ন শ্রেণীর শ্রম আর সামাজিক নিশ্চয়তা বিধান সংস্থা প্রায় ৭০ হাজার শহরে কর্মরত কৃষকদের বেতন বকেয়ার সমস্যা সমাধান করেছে, ৩০০ কোটিরও বেশি ইউয়ান রেনমিনপি বকেয়া বেতন কৃষকদের জন্যে আদায় করে দিয়েছে।
গত বছরে ইন চিয়া ছির আরেকটি আনন্দদায়ক ব্যাপার হলো তাঁর মেয়ে তালিয়ানে প্রাথমিক স্কুলে পড়ার জন্য আর বছরে ৬০০ ইউয়ান বিশেষ ফী জমা দেয়া লাগবে না। তখন থেকে তাঁর মেয়ে তালিয়ানের শহরবাসীদের ছেলেমেয়ের মতো সমান ফী দিয়ে স্কুলে ভর্তি হতে পারে। এটা হচ্ছে চীন সরকার শহরে কর্মরত কৃষকদের স্বার্থ ও অধিকার রক্ষা করার আরেকটি সুবিধাজনক ব্যবস্থা।
শহরে কর্মরত কৃষকদের নানা স্বার্থ ও অধিকার অব্যাহতভাবে সুনিশ্চিত হবার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের কৃষকদের জীবনযাপনের মানও দিনে দিনে সমৃদ্ধ হয়েছে। আমাদের সংবাদদাতা ছেন শান জুন নামে এক জন কৃষকের বাড়ীতে দেখেছেন, চওড়া প্রাঙ্গণ পরিস্কার পরিচ্ছন্ন , উত্তর দিকে দু'তলা একটি বাড়ী আছে, তা দেখে বুঝা যায়, এই পরিবারের জীবন অপেক্ষাকৃত ভালো। চল্লিশাধিক বছর বয়স্ক চেন শান জুন সংবাদদাতাকে বলেছেন, তাঁর পরিবারের পাঁচ জন সদস্যের মোট ০.৪ হেক্টর জমি আছে, তা দিয়ে শাকশব্জি এবং গম ও ধান চাষ করা হয়। ২০০৫ সালে কেবল জমি চাষের আয় ৫ থেকে ৬ হাজার ইউয়ান পেয়েছে। কৃষি কাজের বাইরে তিনি এবং তাঁর ছোট ভাই বাইরে গিয়ে কাজ করার আয়ও কম নয়। তা ছাড়া, তিনি সংবাদদাতাকে বলেছেন, ২০০৫ সাল হোনান প্রদেশের সকল কৃষকদের জন্য আরেকটি বড় আনন্দদায়ক কাজ আছে।
২০০৫ সালের প্রথম দিক থেকে প্রদেশব্যাপী গ্রামের কৃষিকর মওকুফ হয়েছে। অতীতে প্রত্যেক কৃষকের বার্ষিক কর আদায় দু'শতাধিক ইউয়ান ছিল। এখন আমার পরিবারের ৫ জন সদস্যের মোট ১৪০০ ইউয়ান কর বেঁচেছে।
এখন চীনের ত্রিশটি প্রদেশের মধ্যে ২৬টি প্রদেশ কৃষি কর মওকুফ ঘোষণা করেছে। ফলে অধিকাংশ কৃষকের অর্জিত খাদ্যশস্য সবই তাঁদের নিজের অধিকারে এসেছে। কৃষকদের জমি চাষ করার সক্রিয়তা অনেক বেড়েছে। ২০০৬ সালে চীনের সকল অঞ্চলে কৃষি কর বাতিল হয়েছে। কৃষকদের জীবনযাত্রা আরো উন্নত হবে।
বোঝা কমানো ছাড়াও আরো অনেক ক্ষেত্রে কৃষকদের জীবনযাত্রার অবস্থার উন্নয়ন প্রতিফলিত হয়। যেমন, এখন চীনের প্রায় ২০ শতাংশ জেলা পর্যায়ের প্রশাসনিক অঞ্চলে নতুন ধরনের গ্রাম সহযোগিতা চিকিত্সা ব্যবস্থার কাজ পরিক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে, যাতে কৃষকদের চিকিত্সার নিশ্চয়তার অভাব দূর করা যায়। এই সহযোগিতামূলক চিকিত্সা ব্যবস্থায় প্রত্যেক কৃষককে মাত্র দশ ইউয়ান জমা দিতে হয়, তারপর স্থানীয় সরকার এবং কেন্দ্রীয় অর্থ থেকে আংশিক ফি ভর্তুকি দেয়া হয়। ফলে কৃষকরা অসুস্থ হলে প্রায় ৮০ শতাংশ চিকিত্সার ফী পেতে পারেন। হোনান প্রদেশের সিন জেলার ছয়টি থানায় এই রকম চিকিত্সা ব্যবস্থা পরিক্ষামূলকভাবে চালু হয়েছে, কৃষকরা খুব আনন্দিত।
জানা গেছে, ভবিষ্যতে চীন অব্যাহতভাবে নতুন ধরনের গ্রামীন সহযোগিতামূলক চিকিত্সা ব্যবস্থার আওতা সম্প্রসারণ করবে। ২০১০ সাল পর্যন্ত এই ব্যবস্থা সমস্ত গ্রামাঞ্চলে চালু হবে।
চীনের কৃষকদের জীবনযাত্রা দিন দিন ভালো হচ্ছে, আরো সুখ-বোধ বেড়েছে। সবেমাত্র সমাপ্ত চীনের বার্ষিক অর্থনৈতিক কাজকর্ম সম্মেলনে চীন সরকার কৃষির প্রতি সমর্থনের মাত্রা অব্যাহতভাবে জোরদার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে কৃষকদের আয় বৃদ্ধির প্রবণতা বজায় রাখা যায় এবং কৃষকদের নানা স্বার্থ ও অধিকার আরো ফলপ্রসূভাবে রক্ষা করা যায়।
|