আফগানিস্তানের সংসদ নির্বাচন গত অক্টোবর মাসে শেষ হয়েছে । নির্বাচনে নারীরা সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন । সাদাত গেরানি ও মালেরা হোয়া তাদের মধ্যে দু'জন , তারা সংসদ-সদস্যা নির্বাচিত হয়েছেন । ভিন্ন পরিবারে জন্মগ্রহণএবং ভিন্ন ভাগ্য সত্ত্বেও তারা নারী সমাজ ও রাষ্ট্র্রের ভবিষ্যতের জন্যে নিজেদের যৌবন বিসর্জনকরছেন ।
সাদাত গেরানি আফগানিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের হেরাট প্রদেশের নাগরিক । সেপ্টেম্বর মাসে তিনি আকস্মিকভাবে প্রাদেশিক নির্বাচনে জয় লাভ করেছেন । ৬ সন্তানের মা গেরানি ১৭ হাজার ভোট পেয়ে প্রাদেশিক নির্বাচনটিতে প্রথম স্থান অধিকার করেছেন । গেরানির জয়ের কারণ সম্পর্কে মন্তব্য করার সময় স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বলেছে , নারীদের চোখে তিনি নারীদের জন্যে ন্যায়পরতা অবলম্বনকরতে পারেন আর পুরুষের চোখে তিনি সৌন্দয্যের নিদর্শন , তাঁর সৌন্দর্যেতারা মোহিত ।
হেরাট প্রদেশের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী নারীদের মধ্যে গেরানি সবচেয়ে আগর্ষনীয়া নারী । নির্বাচনী প্রচারণায় গেরানি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন । তাঁর বিজ্ঞাপন দেখে পথিক পুরুষরা অজান্তেই থেমে পড়েন ।আমাদ নামে এক পুলিশ গেরানিকে খুব পছন্দ করেন । তিনি বলেছেন ,আমি এই নারীকে ভালবাসি , আমি তাঁকে ভোট দেবই । এইভাবে এক সুন্দর সংসদ সৃষ্টি হতে পারে ।
সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত সরকারের আমলে গেরানির পরিবার ইরানে পালিয়ে আশ্রয় নিয়েছে এবং সেখানে প্রায় ১৬ বছর ধরে জীবনযাপন করেছে । সেই সময়পর্বে গেরানি এক শরিরচর্চা ক্লাবে কাজ করতেন । তিনি ক্লাবের নারী সদস্যদের শরিরচর্চা পরিচালনা করেন ।২০০১ সালে তালিবান প্রশাসনের পতনের পর গেরানি হেরাটে প্রত্যাবর্তন করেছেন এবং সেখান থেকে দুই ট্রাকভরা শরিরচর্চারযন্ত্রপাতি এনেছেন । তিনি নিজের বাড়িঘরের বেসমেন্টে নারীদের জন্যে এক শরিরচর্চা ক্লাব খুলেছেন ।
কিন্তু এই ভাল অবস্থা স্থায়ীভাবে টিকতে পারেনি । রক্ষণশীল হেরাট প্রদেশের গভর্নর ইসমাইল খাঁন ২০০৪ সালের গ্রীষ্মকালে গেরানির শরিরচর্চা ক্লাব বন্ধ করার আদেশ জারি করেন । ইসমাইল খাঁনের পতনের পর শরিরচর্চা ক্লাব আবার খোলা হয়েছে । তার পর তাঁর সাহায্যে আরও দুটি নারী শরিরচর্চা ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।
গেরানির বৃহত্তম আশা হল আফগানিস্তানে নারী পুরুষ সমতা বাস্তবায়িত করা । সুতরাং ,আফগান ইতিহাসের প্রথমটি নারী রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে নারীদের জন্যে আরও বেশী কল্যাণ ও অধিকার অর্জন করা যাবে বলে তিনি আশা করেন । একই সময় তিনি আফগানিস্তানে বিদ্যমান বাল্যবিবাহ ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন । কারণ স্বয়ং তিনিই বাল্য বিবাহের দুঃখ-দুর্দশার শিকার হয়েছিলেন । তিনি বলেছেন , বারো বছর বয়সে আমার বিয়ে হয় আর তেরো বছর বয়সে আমার প্রথম সন্তানের জন্ম হয় , তাই আমি বাল্য বিবাহ খুব ঘৃণা করি ।
গেরানি আফগান নারীদের জন্যে কিছু কল্যানকর কাজ করতে চান ।পক্ষান্তরে পশ্চিম আফগানিস্তানের ফালাহ প্রদেশে বসবাসকারী মালেরা হোয়া এর চেয়ে বেশী চিন্তাভাবনা করেছেন । আফগান সংসদ নির্বাচনের আগে ২৫ বছর বয়সী হোয়া আফগানিস্তানে এক অত্যন্ত সাধারণ মানুষ ছিলেন,কেউই তাঁকে চিনতেন না । তা সত্ত্বেও আফগানিস্তানের যুদ্ধবাজরা তাঁকে চোখের কাঁটা হিসেবে দেখতেন বলে তিনি অসংখ্যবার মৃত্যুর হুমকীর সম্মুখীন হয়েছিলেন । তাঁকে রক্ষার জন্যে জাতিসংঘ চারজন দেহরক্ষী পাঠিয়েছে। সম্ভাব্য বিপদ এড়ানোর জন্যে প্রত্যেক রাতে তাঁকে ভিন্ন ঘরে থাকতে হয় ।
২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে আফগানিস্তানের বড় বিধান কমিটির সভায় অংশ নেয়ার সময়ে হোয়া আবেগপূর্ণ ভাষণ দিয়েছেন । তিনি তাঁর ভাষণে তীব্রভাষায় সেই সব ক্ষমতাধর ও শক্তিশালী যুদ্ধবাজদের নিন্দা করেছেন । এই ভাষণ দেয়ার পর হোয়ার নাম চার দিকে ছড়িয়ে পড়ে । এখন হোয়ার নাম জানেন না এমন লোক অত্যন্ত কম । এর পর থেকে হোয়া বক্তৃতা দেয়াকে নিজের সংগ্রামের হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করছেন । তিনি বহুবার প্রকাশ্যে বলেছেন যে , ঐ সব পাপী যুদ্ধবাজদেরকে বিচার করতে আফগান আদালত বা আন্তর্জাতিক আদালতে পাঠাতে হবে । তিনি এ কথাও বলেছেন যে , তিনি সমমনা সংসদ সদস্যদের সঙ্গে মিলে সংসদে যুদ্ধবাজদের অন্তর্ভূক্তিপ্রতিরোধ করার চেষ্টা চালাবেন । তাঁর তীব্র বক্তৃতা আফগানিস্তানের ভেতরে বিরাট প্রতিক্রিয়া জাগিয়ে তুলেছে ।এমনকি কোনো কোনো সামরিক লোক স্বেচ্ছায়দাঁড়িয়ে তাঁকে রক্ষা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন ।
লক্ষ লক্ষ গৃহহারা আফগানীদের মতো হোয়া ৪ বছর বয়সে পরিবারপরিজনদের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলকৃত আফগানিস্তান ত্যাগ করেছিলেন । তিনি পরপর ইরান ও পাকিস্তানের শরনার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং পাকিস্তানে তাঁর লেখাপড়া সম্পন্ন করেছেন । ১৯৯৯ সালে হোয়া আফগানিস্তানে প্রত্যাবর্তন করেছেন এবং পশ্চিম আফগানিস্তানের হেরাট শহরে প্রথম গোপন বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছেন । সেই সময় তালিবান প্রশাসন প্রকাশ্যে নারীদের লেখাপড়া বা কাজ করা নিষিদ্ধ করেছিলো। হোয়া বলেছেন, এটা সেই সময় নারীদের জন্যে তাঁর সৃষ্ট বৃহত্তম অবদান ।
তালিবান প্রশাসনেরপতনের পর হোয়া সক্রিয়ভাবে দেশের পুনর্গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং নারীদের সামাজিক অবস্থান উন্নত করার এক এন-জি-ও সংস্থায় অংশ নিয়েছেন । ২০০৪ সালে তিনি আফগানিস্তানের ৫০ উপজাতির প্রবীনদের সঙ্গে আফগান প্রেসিডেন্ট কারজাইয়ের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং প্রেসিডেন্ট কারজাইকে ফালা প্রদেশের গভর্নর—তালিবানের এক সাবেক কমান্ডারকে প্রতিহত করতে পরামর্শ দিয়েছেন । হোয়া বলেছেন , যদি যুদ্ধবাজকে সংসদে প্রবেশ করতে অনুমোদন দেয়া হয় , তাহলে দেশ অবশ্যই আবার সেই শ্বাসরুদ্ধকর বায়ু ও রক্তাক্ত বৃষ্টির লড়াইর মধ্যে নিমজ্জিত হবে । সুতরাং সরকারকে এ অবস্থা রোধ করতে বলিষ্ঠ ব্যবস্থা নিতে হবে ।
|