আধুনিক যুগে সাধারণ মানুষের চেয়ে লম্বা লোকের প্রাধান্য বেশি । পেশা ও চাকরি বাছাইয়ের ক্ষেত্রেও তাদের সংগে সাধারণ মানুষের তুলনা করা যায় না । যেমন বাস্কেটবল খেলোয়াড় , মডেল আর বিমানবালা নিয়োগের জন্য দেহের নির্দিষ্ট উচ্চতা প্রয়োজন । অধিকাংশ মেয়ে লম্বা আর স্বাস্থ্যবা ছেলে বন্ধু চান । কিন্তু এমন একজন মানুষ আছেন , যিনি অধিক লম্বা বলে কখনো মেয়েদের সমাদর ও ভালবাসা পান নি । তার বয়স পঞ্চাশাধিক , এখনো অবিবাহিত । তিনি বেশির ভাগ সময়ে বাসায় থাকেন , বাইরের লোকদের সংগে যোগাযোগ রাখেন না । এবছর তার উচ্চতা গিনিস বিশ্ব রেকর্ডে স্থাপন পেয়েছে আর বিশ্বের সবচেয়ে লম্বা লোকের মর্যাদা জয় করেছেন । তার পর তার জীবনধারার পরিবর্তন হয়েছে । আজ এই অনুষ্ঠানে ২.৩৬১ মিটার উঁচু মঙ্গোলিয় জাতির পশুপালক পাও সি স্যুন সম্বন্ধে আপনাদের কিছু বলছি আমি…
উত্তর চীনের অন্তঃমঙ্গোলিয় তৃণ ভূমির একটি পশুপালকের পরিবারে পাও সি স্যুনের জন্ম । ১৫ বছর বয়সে তার দেহের উচ্চতা দ্রুত বাড়তে শুরু করে । ২০ বছর বয়সে তার উচ্চতা ২.১ মিটারে দাঁড়ায় । কিন্তু অল্পবয়সী পাও সি স্যুন তার লম্বা দেহের জন্য খুশি হন নি । উপরন্তু তিনি যেখানে-সেখানে অসুবিধা বোধ করতেন । সাধারণ মানুষের চেয়ে তাকে বেশি খেতে হয় , পোষাক বানালে বেশি কাপড় লাগে এবং তিনি কোথাও গেলে তার উপযোগী বিছানাও পাওয়া যায় না । মাত্রাতিরিক্ত লম্বা বলে বাইরে গেলে পথচারীরা তার দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকেন ।
সাধারণ মানুষের চেয়ে অনেক লম্বা বলে বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা লোকেরা আমাকে দেখতে খুব পছন্দ করতেন । এতে আমি কোনো আনন্দ বোধ করতাম না । যখন তার বয়স বিশাধিক, তখন তিনি অন্য লোকদের সংগে দেখা করতে মোটেই পছন্দ করতেন না । তিনি বলেন , আমি অধিক লম্বা বলে চাপ অনুভব করতাম , হয়তো এটা এক ধরণের রোগের লক্ষণ ।
যখন তার বয়স বিশাধিক , তখন তিনিও চিকিত্সা গ্রহণ করেছিলেন । স্বাস্থ্য পরীক্ষার ফলাফল অনুযায়ী , তিনি বাত রোগে সামান্য একটু আক্রান্ত হন , তা ছাড়া তার অন্য কোনো অসুখ ছিল না । ঠিক এই সময় দীর্ঘাঙ্গী পাও সি স্যুন া একজন বাস্কেটবল প্রশিক্ষকের মনোযোগ আকর্ষণ করল । তিনি তাকে তার বাস্কেট বল দলে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানালেন । নিজের লম্বা শরীঢর কাজে লাগবে বলে পাও সি স্যুন খুব আনন্দিত হলেন । তিনি শিগ্গিরই প্রশিক্ষণেযোগ দিলেন । কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে , তিনি যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালালেও খেলার মাঠে তীব্র প্রতিযোগিতার সংগে তাল মেলাতে পারছিলেন না । দু' বছর পর তিনি বাধ্য হয়ে জন্মস্থলে ফিরে এলেন ।
বাড়িতে ফিরে আসার পর পাও সি স্যুন তৃণ ভূমিতে পশু পালন করতেন । বিশাধিক বছর বয়স্ক যুবকের প্রেম ও বিয়ে করার কথা । তিনি পর পর নিকটবর্তী গ্রামের কয়েক জন মেয়ের সংগে পরিচিত হলেন । কিন্তু তার দু' মিটারেরও বেশি লম্বা দেহ দেখে মেয়েরা চিন্তিত হলেন এবং তার কাছ থেকে সরে গেলেন । ফলে শান্ত পাও সি স্যুন ভয় পেলেন । তিনি বাইরে কম যেতেন । তিনি চিন্তা করতেন বাইরে গেলে গ্রামবাসীরা তাকে চিড়িয়াখানার অদ্ভূত প্রাণীর মতো অবাক হয়ে দেখবেন ।
বাড়িতে ৫জন ভাই বোন আছেন । তাদের মধ্যে পাও সু স্যুন কনিষ্ঠ । পরিবারে সবাই তাকে ভালবাসেন । বাইরে চাকরি করতে অস্বীকার করার জন্য পরিবার পরিজন তাকে বাড়ির কাজ ব্যবস্থাপনা করতে দেন । ফলে তার প্রকৃতি আরো আন্তমুর্খী হয়ে পড়ল । তার ভাইঝি পাও কুই লান বলেছেন ,
ছোট বেলা থেকেই আমার মনে হল আমার চাচা তো এই রকম লম্বা ছিলেন । অন্যদের চেয়ে লম্বা বলে তিনি নিজেকে অসুস্থ বলে ভাবতেন । তার মনের বেশি চাপ ছিল , স্বভাব আরো অন্তর্মুখী হল । তিনি বাইরের লোকদের সংগে দেখা করতে চাইতেন না , সারা বছর বাইরে যেতেন না ।
যখন পাও সি স্যুনের বয়স ৪০ বছর ছিল , তখন মা মারা গেছেন । এটা তার মনের ওপর গুরুতরভাবে আঘাত হেনেছে । মা তাকে সবচেয়ে আদর করতেন । তার দেহ অধিক লম্বা বলে মা সহস্তে তার জন্য পোষাক ও জুতা বানাতেন । মৃত্যুর আগেও মা তার জন্য তাড়াহুড়া করে কয়েক জোড়া তুলোর জুতা বানালেন , যাতে পরর্বতীতে তার ছেলে ধীরে ধীরে ব্যবহার করতে পারেন ।
পাও সি স্যুন তৃণ ভূমিতে আজীবন দিন কাটাতে পছন্দ করতেন । তবে ২০০৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে একজন ব্যবসায়ী তার লম্বা দেহের কথা শুনে খুব খুশি হলেন । তিনি কয়েকবার তার বাড়িতে যান । ব্যবসায়ী অন্তঃমঙ্গলিয়া স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের পূর্বাংশের ছি ফুং শহরে একটি রেস্তরাঁ স্থাপন করলেন । অতিথিদের কৌতূহল আকর্ষণ করার জন্য তিনি তাকে এই রেস্তরাঁয় অতিথিদের স্বাগত জানানো ও পরিসেবার কাজ করতে আমন্ত্রণ করলেন । বাইরের জীবনযাপনের সংগে খাপ না খাওয়ার ভয়ে প্রথমে পরিবার পরিজন তাকে বাইরে চাকরি করতে দিতে রাজী হন নি । তবু পাও সি স্যুন বার বার বিবেচনা করে বাইরে ঘুরে দেখা আর চাকরি করার সিদ্ধান্ত নেন ।
এই ভাবে রেস্তরাঁর ব্যবসা শীঘ্রই ভাল হয়ে উঠলো । লম্বা লোককে দেখার জন্য বহু শহরবাসী রেস্তরাঁয় যান । তখনকার দৃশ্য স্মরণ করে পাও সি স্যুন হেসে উঠলেন । তিনি বলেছেন ,
আমি প্রতিদিন সকাল ও বিকেলে রেস্তোরাঁর নীচে ও উপরে এক ঘন্টা করে ঘুরে বেড়াই । বহু লোক রেস্তোরাঁয় আসেন আর খান । রেস্তোরাঁ প্রতিদিনই অতিথিতে ভরপুর ছিল ।
এই ভাবে পাও সি স্যুন শহুরে জীবনযাপনে প্রবেশ করলেন । তিনি এই শহরের একজন নামকরা লোকে পরিণত হন । তিনি প্রথম বারের মতো তার জন্য বানানো বিশেষ চামড়ার জুতা পরেন , প্রথম বারের মতো তার জন্য বন্দোবস্ত রুমে থাকেন এবং প্রথম বারের মতো বিমানযোগে স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের রাজধানী হুহোহার্টে গিয়ে ভ্রমণ করেন ।
পাও সি স্যুনের জীবনধারা আর প্রকৃতির পরিবর্তন হয়েছে । তিনি এখন মুক্তমনা এবং অন্যদের সংগে গল্প করতে পছন্দ করেন ।
গত বছরের শেষ নাগাদ সংবাদ মাধ্যমের সাহায্যে পাও সি স্যুন গিনিস বিশ্ব রেকর্ডে অন্তর্ভুক্ত হবার আবেদন জানিয়েছেন । ২০০৫ সালের জুলাই মাসে গিনিস বিশ্ব রেকর্ড সংস্থার সদর দফতর মনে করে যে , পাও সি স্যুন সুস্থ । তারা তাকে বিশ্বের প্রথম লম্বা লোকের সাটিফিকেট প্রদান করেছেন ।
|