৬০ বছর আগে অর্থাত্ ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর জাপান সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ পত্রে স্বাক্ষর করে । এই দিন চীনা জনগণের জাপানী আগ্রাসন প্রতিরোধ যুদ্ধ আর বিশ্ব ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধের সাফল্যজনক সমাপ্তির দিন । এই স্মরণীয়দিনের স্মৃতিচারণের জন্য ২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় চীনের রাজধানী পেইচিংয়ে ' ন্যায় ও শান্তির জন্য ' নামে একটি বিরাটাকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে ।
ন্যায় ও শান্তির জন্য নামে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানটি পেইচিংয়ের মহা গণ ভবনে অনুষ্ঠিত হয়েছে । ভূমিকা ও পরিশেষ ছাড়া অনুষ্ঠানের পাঁচটি প্রধান অংশের নাম চীনের জাতীয় সংগীতের একটি বাক্য দিয়ে নামকরণ করা হয়েছে । এই পাঁচটি অংশের নাম হলোঃ জেগে উঠো , যারা দাস হতে চায় না , আমরা নতুন মহাপ্রাচীর তৈরী করি , আমরা ঘনিষ্ঠভাবে ঐক্যবদ্ধ হই , প্রত্যেক মানুষই বাধ্য হয়ে শেষ বারের গর্জন করছে আর শত্রুর গোলাবর্ষনে নির্ভীকভাবে এগিয়ে যাও ।
এই অনুষ্ঠানের ভূমিকায় ' সুন হুয়া নদীতে ' নামে একটি গান পরিবেশন করা হয়েছে । গান পরিবেশনের সঙ্গে সঙ্গে মঞ্চে জাপানের দখলকৃত অঞ্চল থেকে আসা শরনার্থীরা বের হন । এই দুঃখময় দৃশ্য দর্শকদেরকে ১৯৩১ সালে জাপানী আগ্রাসী বাহিনীর উত্তর-পূর্ব চীনের তিনটি প্রদেশে আক্রমনের সময় নিয়ে যায় ।
এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাকারী চেন ছিং হুয়াই বলেছেন , চীন সরকার এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানকে বেশী গুরুত্ব দেয় । সরকারের নির্দেশে চীনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কর্মীরা মার্চ মাস থেকেই এই অনুষ্ঠানের পান্ডুলিপি লিখতে শুরু করেন । তারা পেইচিংয়ের লুকোছিয়াও জাপানী আগ্রাসন প্রতিরোধ যুদ্ধের প্রদর্শনী , নাংচিংয়ের হত্যাযজ্ঞ প্রদর্শনী পরিদর্শন করেন এবং প্রচুর ঐতিহাসিক তথ্য সংগ্রহ করেন । তিন মাসের মধ্যে তাদের পাণ্ডুলিপি দশ বার সংশোধন করা হয়েছিল । তিনি বলেছেন , বর্তমান জটিল আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে চীনের শিল্পীরা সবচেয়ে উপযুক্ত ভাষা দিয়ে চীনাদের মনের কথা প্রকাশ করতে চান । চেন ছিং হুয়াই বলেছেন , এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা সহজ ব্যাপার নয় । কারণ আমরা এখন এক নতুন ঐতিহাসিক সময়পর্বে প্রবেশ করেছি । নতুন সময়পর্বে প্রবেশের পরও চীনা জাতির ইতিহাস প্রচার করা উচিত । আমাদের নাচ ও গানের মাধ্যমে ইতিহাসের দৃশ্যগুলো মঞ্চস্থ করে আমাদের উত্তরসুরী , বিশেষ করে আমাদের ছেলেমেয়েকে বলতে চাই , অতীতের কথা ভুলবে না ।
চীনের ৫০টিরও বেশী শিল্পী দলের দেড় হাজার শিল্পী এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন । শিল্পীরা জাপানী আগ্রাসন প্রতিরোধ যুদ্ধের সময়ের জনপ্রিয় গান গেয়েছেন । চীনের বিখ্যাত কণ্ঠশিল্পী ফেন লি ইউয়ান ' হলুদ নদীর দুঃখ ' নামে একটি গান গেয়েছেন । তার আবেগময় গান শুনে দর্শকরা যেন সাধারণ অধিবাসীর দুঃখদুর্দশার কান্না শুনতে পান এবং নানচিংয়ে জাপানী আগ্রাসী বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের প্রতি চীনাদের ক্ষোভ ও দুঃখ অনুভব করতে পারেন । ' তরয়ারের জয়যাত্রা' নামে একটি গানের সুরে সুরে হাতে তরবারি নিয়ে মঞ্চে এক দল সৈনিক জাপানী আক্রমণকারীদের সঙ্গে লড়াই করেন । এই অনুষ্ঠানে শিল্পীদের পরিবেশন করা ' অষ্টম রুট বাহিনীর জয়যাত্রার গান ' ' নতুন চতুর্থ বাহিনীর গান ' আর উত্তর-পূর্ব চীনের জাপ- আগ্রাসন প্রতিরোধ যৌথবাহিনীর গান ' আর ' সুড়ং পথে যুদ্ধ ' ইত্যাদি গান থেকে জাপানী আগ্রাসন প্রতিরোধ যুদ্ধে চীনা জনগণের বীরত্ব ও দেশপ্রেম প্রতিফলিত হয়েছে । অনুষ্ঠান শেষে দু শ'রও বেশী প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রী ও শিল্পীরা এক সঙ্গে ' আমরা শান্তি ভালোবাসি ' নামে একটি গান গেয়েছেন ।
এই অনুষ্ঠানের পরিচালক চাং চি কাং বলেছেন , এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান প্রস্তুতির ছয়মাসে তিনি প্রচুর ঐতিহাসিক তথ্য পড়েছেন । তিনি মনে করেন , এই অনুষ্ঠানে চীন দেশ ও চীনা জাতির মর্যাদা সম্মুন্নত করা উচিত । তাই এই অনুষ্ঠানে চাং চি কাং নানা ধরনের শিল্প রুপের মাধ্যমে ইতিহাসের অনেক দৃশ্য রুপায়ন করার মাধ্যমে বিশ্ব ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধে চীনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছেন । তিনি বলেছেন , তার এই প্রচেষ্টার একটি উদ্দেশ্য হলো পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগণ বাস্তব মনোভাব পোষণ করে চীনের এই সময়পর্বের ইতিহাস দেখতে পারেন এবং এই সময়পর্বের ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করবেন । তিনি বলেছেন , আমাদের এই বিরাট সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চীনের ১৩০ কোটি লোকসংখ্যাসম্পন্ন চীনা জাতির মর্যাদা প্রতিনিধিত্বকারী এক অনুষ্ঠান । তাই এই অনুষ্ঠানের ভাষা , নাচ , শিল্পীদের পোশাক ও আলোক ব্যবস্থা সবই উন্নত মানের হওয়া উচিত । এই অনুষ্ঠানে অংশ নেয়া শিল্পীরা সবই চীনের নামকরা শিল্পী । চীনের নামকরা কণ্ঠশিল্পী লিয়াও ছাং ইয়োং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় একাধিকবার পুরস্কার করেছিলেন । তিনি আমাদের সংবাদদাতাকে বলেছেন , চীনের একজন শিল্পী হিসেবে আমি এই ধরনের অনুষ্ঠানে অংশ নিতে আগ্রহী । আমি আশা করি , এই অনুষ্ঠান দেখে দর্শকরা জাপানী আগ্রাসন প্রতিরোধ যুদ্ধের কথা স্মরন করবেন এবং এই যুদ্ধে নিজের জীবন বিসর্জনকারী শহিদ ও বীরদের কথা স্মরণ করবেন । আমি বিশ্বাস করি , এই অনুষ্ঠান দেখে সবাই এটাও আরো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন যে , দেশ শক্তিশালী হলেই শুধু অন্য দেশের আগ্রাসন ও অত্যাচারের শিকার হবে না ।
অনুষ্ঠান শেষে পেইচিং প্রাথমিক স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে ' আমরা শান্তি ভালোবাসি' নামে একটি গান গেয়েছে । স্কুলের হেডমাস্টার ওয়াং সিউ ফেন বলেছেন , এই অনুষ্ঠান দেখে ছেলেমেয়েরা অতীতের ইতিহাস সম্বন্ধে জানতে পেরেছে । তারা এটা উপলব্ধি করতে পেরেছে যে আজকের সুখী জীবন হাজার হাজার শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে ।
|