প্রতিদিন ভোর বেলায় কৃষিতে ব্যবহার্য গাড়ি অর্থাত্ ট্রাক্টর চালিয়ে মাল পরিবহনের জন্য মধ্য চীনের হোনান প্রদেশের ৩৫ বছর বয়স্ক কৃষক হো ইয়েন মেই তার স্বামীকে ঘুম থেকে উঠান । ২০০৩ সালে তিনি দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগ থেকে ২ হাজার ইউয়ান ঋণ নিয়ে এই ট্রাক্টর কিনেছেন । তিনি বলেছেন , ট্রাক্টর এই গাড়ি কেনার পর তারা গ্রামবাসীদের জন্য মাল ও যাত্রী পরিবহণের ব্যবসা শুরু করেছেন । ফলে পরিবারের আয় অনেক বেড়েছে ।
এখন দিনে আমাদের আয় ৫০ ইউয়ানেরও বেশি । কখনো কখনো তা ১ থেকে ২ শো ইউয়ানে পৌঁছায় । গ্রামাঞ্চলে এই অংকের আয় উল্লেখযোগ্য উপার্জন বলা যায় ।
২ হাজার ইউয়ান চীনের বড় শহরের বেশির ভাগ অধিবাসীদের জন্য খুব বড় এক অংকের অর্থ বলা যায় না । কিন্ত হো ইয়েন মেইয়ের মতো গরীব গ্রামবাসীর দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য তা বেশ ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছে । তার জন্মস্থল-নান চাও জেলা দূরদূরান্তে অবস্থিত । অনুন্নত এই জেলায় আধুনিক পরিবেশের অভাব ছিল । তবে গত কয়েক বছর ধরে বহু স্থানীয় গ্রামবাসী হো ইয়েন মেইয়ের মতো সরকারের ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবহার করার মাধ্যমে মাল পরিবহণের ব্যবসা করেন , মত্স চাষ করেন আর বনাঞ্চল গড়ে তুলেন । ফলে তাদের জীবনযাত্রার মান দিন দিন উন্নত হয়েছে ।
নান চাও জেলার দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের প্রধান মিঃ কৌ ছাং ইউয়ান দরিদ্র কৃষকদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণ দানের দায়িত্ব বহন করেন ।নান চাও জেলায় জামানত-বিহীন ক্ষুদ্র ঋণ ব্যবস্থা শুরু হয় ১৯৯৫ সাল থেকে । এই ব্যবস্থার উদ্দেশ্য সরকারের কাছ থেকে কৃষকদের দারিদ্র্য বিমোচনের পুঁজি সরাসরি না পাওয়ার ক্ষতি পূরণ করা । চীনের সমাজ বিজ্ঞান একাডেমী বাংলাদেশের গ্রামীণ ট্রাস্ট থেকে পুঁজি ও প্রযুক্তি আমদানি করে সমগ্র দেশে ক্ষুদ্র ঋণ দেয়ার চারটি পরীক্ষামূলক ঘাঁটি গড়ে তুলেছে । নান চাও জেলা তাদের মধ্যে একটি । গত দশ বছরে প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতা কৃষক পরিবারের সংখ্যা ৭৭১৫ হয়েছে । ঋণ দানের মোট মূল্য সাড়ে ছ' কোটি ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে ।
চীনের সমাজ বিজ্ঞান একাডেমীর উদ্যোগে নান চাও জেলা সহ ক্ষুদ্র ঋণ কেন্দ্রীক যে দারিদ্র্য বিমোচন এলাকাগুলো প্রতিষ্ঠা করেছে , তাদের অর্থের উত্স হচ্ছে বাংলাদেশের গ্রামীণ ট্রাস্ট , সিটি ব্যাংক প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থার অল্প সুদযুক্ত ঋণ বা অনুদান । গত শতাব্দির মাঝামাঝি সময় থেকে চীনের সমাজ বিজ্ঞান একাডেমীর গ্রামীণ উন্নয়ন গবেষণাগার এই সব অনুদান ক্ষুদ্র ঋণের উপায়ে কৃষক পরিবারের কাছে বিতরণ করে থাকে । এতে প্রযুক্তি শিখা , উত্পাদন উন্নয়ন আর আয় বৃদ্ধির জন্য তাদেরকে সাহায্য করা হয়েছে । যেহেতু এই ক্ষুদ্র ঋণ পরিশোধের জন্য সহজ কিস্তি পদ্ধতি প্রবর্তন করা হয় , সেহেতু কৃষকরা এই ধরণের ঋণ গ্রহণ করতে খুব ইচ্ছুক । তারাও সময় মতো ঋণ পরিশোধ করেন । হোনান প্রদেশের নান চাও জেলায় কৃষকদের সময় মতো ঋণ পরিশোধের হার ৯৯.৯৯ শতাংশে পৌঁছেছে ।
কৃষক মাদাম হো ইয়েন মেই বলেছেন , গ্রামবাসীরা এই ধরণের ঋণ দানের পদ্ধতির খুব প্রশংসা করেন ।সহজ কিস্তিতে ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা গ্রামবাসীদের জন্য খুব সুবিধাজনক । এতে আমরা খুব সন্তুষ্ট ।
চীনের বিভিন্ন অঞ্চলে নান চাও জেলার দারিদ্র্য বিমোচন বিভাগের মতো মোট ১ শোরও বেশি সংস্থা গরীব কৃষকদের জন্য ক্ষুদ্র ঋণের পরিসেবা দিচ্ছে। এই সব সংস্থার পুঁজির মোট মূল্য ১ বিলিয়ন ইউয়ান রেন মিন পি । এই সব পুঁজির মধ্যে বেশির ভাগ বিদেশ থেকে এসেছে । এর মধ্যে কোনো কোনো অনুদান আর কোনো কোনোটা অতি নিম্নসুদের ঋণ । বিভিন্ন ক্ষুদ্র ঋণ দান প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মীরা বিশ্ব সমাজের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীলভাবে যার যার প্রতিষ্ঠানের পুঁজি ব্যবস্থাপনা করেন , যাতে যথোচিত ফলপ্রসূতা পাওয়া যায় ।
জাতি সংঘের উন্নয়ন কর্মসূচী সংস্থা, অর্থাত্ ইউ এন ডি পির ক্ষুদ্র ঋন দান প্রকল্প প্রত্যক্ষভাবে তত্ত্বাবধান আর পরিচালনা করার জন্য চীনের বাণিজ্য মন্ত্রনালয়ে একটি বিশেষ কার্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ।চীনে গ্রামীণ উন্নয়ন সমিতি নামে একটি পূর্ণাংগ পরিচালনা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে । ৪৮টি জেলার ক্ষুদ্র ঋণ দান প্রতিষ্ঠানে আমাদের ঋণ পরিচালনার মানদন্ড প্রণয়ন করা হয়েছে । আমাদের কড়া হিসাবরক্ষণ ব্যবস্থা আর তথ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা আছে । প্রতি বছর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাজ যাচাই আর তত্ত্বাবধান করতে হয় । যাতে চীন সরকার আর আন্তর্জাতিক সংস্থার মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী এই সব পুঁজির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা যায় ।
চীনে ক্ষুদ্র ঋণ আর পুঁজির সুষ্ঠু ব্যবহার বিশ্ব ব্যাংক , ইউ এন ডি পি , সিটি ব্যাংক প্রভৃতি আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রশংসা পেয়েছে । বহু আন্তর্জাতিক সংস্থা চীনকে আরো বেশি ক্ষুদ্র ঋণও দিয়েছে । যেমন ২০০১ সালে সিটি ব্যাংক ১৩ লক্ষ মার্কিন ডলার অনুদান দেয়ার পর কিছু দিন আগে আরো ১৫ লক্ষ মার্কিন ডলার অনুদান দিয়েছে । চীনে প্রশিক্ষণের কাজ বিকশিত করার জন্য এই সব ক্ষুদ্র ঋন প্রকল্প ব্যবহার করা হবে ।আমাদের কাজের লক্ষ্য হচ্ছে ক্ষুদ্র ঋণের ফলপ্রসূতা সর্বাধিকভাবে সম্প্রসারিত করা । ঋণ দান প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার মাধ্যমে ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহারের কৌশল ও সামর্থ্য আরো উন্নত হবে , যাতে ব্যাপকভাবে তার ইতিবাচক ভূমিকা পালন করা যায় আর চীনের দরিদ্র অঞ্চলগুলোতে অর্থনীতির বিকাশ ত্বরান্বিত করা যায় ।
চীনের গ্রামীণ সমস্যা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা বলেছেন , চীনে বিশ্ব সমাজের অনুদানে প্রতিষ্ঠিত ক্ষুদ্র ঋণ দান প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠা প্রত্যন্ত অঞ্চলের কৃষকদের জন্য খুব সুবিধাজনক । এর সংগে সংগে তারা আশা করেন যে , ক্ষুদ্র ঋণ বিষয়ক সরকারী প্রতিষ্ঠানের কাজ নিরন্তর উন্নত হবে এবং কৃষকদের জন্য আরো বেশি পরিসেবা যোগানো যাবে ।
|