এখন সারা চীনদেশে চলছে অগ্নি-ঝরা গ্রীষ্মকাল। কিন্তু বড় বড় শহরের হোটেলগুলোর এয়ার কনডিশনারের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা রাখা হয়েছে ২৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঊর্ধ্বে । অফিস ভবনে বিদ্যুত বাঁচানোর জন্য অব্যবহৃত কম্পিউটার , প্রিন্টার , ফটোকপিয়ারকে সুপ্ত অবস্থায় রাখা হয় । লিফ্টের ঘনঘন উঠানামায় যে প্রচুর বিদ্যুত দরকার তা কমানোর জন্য সিড়ি ভেংগে উঠতে নামতেও নাগরিকরা ক্রমেই অভ্যস্ত হয়েছেন । "শক্তি বাঁচান " হয়েছে চীনের একটি জনপ্রিয় শ্লোগান । আজকের সমাজ দর্পন আসরে আসুন , চীনের মিতব্যয় অভিযানের সঙ্গে আপনাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া যাক ।
চা খাওয়া অধিকাংশ চীনার অভ্যাস । চা তৈরীর জন্য চীনের প্রায় সব সরকারী অফিসে গরম পানি সরবরাহ করা হয় ।অতীতে ফ্ল্যাস্ক দিয়ে গরম পানি আনতে অফিসের কর্মচারীরা কখনো ভেবে দেখতেন না যে কত গরম পানি দরকার । সিদ্ধ পানি অপচয় ছিল এক নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার । কিন্তু এখন কর্মচারীরা চাহিদা অনুযায়ী গরম পানি আনতে যান ।মি:ছেং ছিয়াং দক্ষিণ পশ্চিম পেইচিংয়ের উপকণ্ঠের ছাংকৌ মফ:স্বলের একটি সরকারী সংস্থার কর্মচারী । রোজ অফিসে গিয়ে তিনি প্রথম অফিসঘর পরিস্কার করেন এবং গরম পানি আনতে যান ।তাঁর সহকর্মীরা সংখ্যায় অল্প ।কাজেই তিনি প্রতিদিন শুধু আধা ফ্ল্যাস্ক গরম পানি আনেন ।
তিনি বলেছেন , আমি যে আধা ফ্ল্যাস্ক গরম পানি আনি,তার কারণ, রোজ সকালে পানি আনতে গিয়ে টের পাই , অর্ধেক ফ্ল্যাস্ক পানি ঠান্ডা হয়েছে এবং তা সাধারণত: ফেলে দেওয়া হয় ।
গরম পানি যতখানি দরকার ততইখানি আনা, কাগজের দু'পৃষ্ঠায় লেখা এবং বাড়ি থেকে অফিস যেতে ও অফিস থেকে বাড়ি ফিরে যেতে ব্যক্তিগত গাড়ি না চালিয়ে অফিসের বাসে চড়ার মত মিতব্যয়ী পদক্ষেপ নেওয়ায় গত এক মাসেই ছাংকৌ মফ:স্বলের স্থানীয় সরকারের প্রায় ৫০ হাজার ইউয়ান বেঁচেছে ।
শক্তি সম্পদ বাঁচানো ও সদ্ব্যবহার সম্পর্কে চীনারা এখন অধিক সচেতন হয়েছেন । তাই মিতব্যয়ের উদ্যোগ সর্বত্রই পরিলক্ষিত ।পেইচিংয়ের একটি অফিসভবনে সি আর আইয়ের সংবাদদাতা লক্ষ্য করেন যে , বারান্দায় প্রতি তিনটা বাতির শুধু একটি বাতি এবং অফিসরুমে প্রতি দুটো ডেলাইট ল্যাম্পের শুধু একটি ডেলাইট ল্যাম্প জ্বলছে । পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক আলো পাওয়া যায় ,এমন অফিসরুমে দিনেরবেলায় বাতি জ্বলে না ।জিজ্ঞেস করে জানা গিয়েছে , অতীতে এই অফিসভবনে প্রতিদিন আট শো কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুত ব্যয় হত , কিন্তু এখন তা তিনশো কিলোওয়াট ঘন্টায় নেমে এসেছে। বেঁচে গিয়েছে ৬০ শতাংশ বিদ্যুত । তবে কর্মচারীদের কোনো অসুবিধা হয় নি । কর্মচারী ওয়াঙ হুই এই প্রসঙ্গে বলেছেন : প্রথম যখন মিতব্যয়ের পদপেক্ষে নেওয়া হয় তখন একটু অনভ্যস্ত ছিলাম । মনে হয় , অফিস রুম অত উজ্জ্বল নয় । কিন্তু আসলে আমাদের কাজের কোনো ক্ষতি হয় নি । অত বেশী বাতি না জ্বালায় বেশ ঠান্ডা বোধ হয়েছে ।
চীনে বিদ্যুত বাঁচানো হচ্ছে নানা উপায়ে । সাংহাইয়ের লু ওয়াং ডিষ্ট্রিক্ট- সরকারের অফিস-ভবনে বিদ্যুতের বদলে গ্যাস জ্বালিয়ে এয়ার কনডিশনার চালানোর জন্য বিদ্যুত বাঁচানোর সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশেরও উন্নতি হয়েছে । এয়ার কনডিশনার সংস্কার করার সঙ্গে সঙ্গে চীনের বিভিন্ন স্থানের হোটেল , অফিসভবন , সরকারী ভবন ও বাণিজ্য-ভবনের এয়ার কনডিশনারের সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৬ ডিগ্রীর ঊর্ধ্বে রাখা হয়েছে ।
অতীতে সন্ধ্যা নামলে রংবেরংয়ের আলোক-সজ্জায় চীনের বড় বড় শহর ঝলমলে হয়ে উঠত এবং প্রচুর বিদ্যুত ব্যয় হত । বিদ্যুত বাঁচানোর জন্য চলতি বছর পেইচিংয়ের একশোটি রাস্তায় কম বিদ্যুত দরকার এমন বাতি ব্যবহার করা হয়েছে । পেইচিংয়ের ইমারতগুলোর আলোক-সজ্জার বিদ্যুত কমানোর ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে । পেইচিং শহরের প্রশাসন বিভাগের অধীনস্থ রাতের আলোক-সজ্জা সেকমশনের কর্মকর্তা জিয়া চিয়ান পিং এই প্রসঙ্গে বলেছেন: অতীতে শুধু আলোর উজ্জ্বলতার উপর নজর দেয়া হত । আলো যত উজ্জ্বল হয় তত ভালো মনে করা হত । কিন্তু এখন বিদ্যুত বাঁচানোর উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে । ইয়ুথান সেতুর বাতিগুলোর মোট শক্তি অতীতে ছিল ২০০ কিলোওয়াট । বিদ্যুত বাঁচানোর নতুন প্রযুক্তি প্রয়োগ করায় এখন মাত্র একশো কিলোওয়াট খরচ হচ্ছে ।
শক্তিসম্পদ বাঁচানোর তাত্পর্য শহরের নাগরিকরা ক্রমশই বুঝতে পেরেছেন এবং শক্তি বাঁচানোর ব্যবস্থা নিচ্ছেন । পেইচিংয়ের তংছেং ডিষ্ট্রিক্টে বসবাসকারী মি:ইউয়ান সিন তাদের মধ্যে একজন । তিনি বলেছেন , এয়ার কনডিশনার আধঘন্টা ব্যবহার করতে না করতে ঘরের তাপমাত্রা নেমে আসে ।তখন এয়ার কনডিশনার বন্ধ করে বৈদ্যুতিক পাখা ব্যবহার করি আমি। এইভাবে প্রতিদিন অন্তত চার কিলোওয়াট ঘন্টা বিদ্যুত বেঁচে যায় ।
চীন সরকার দর-ব্যবস্থার সাহায্যে শক্তিসম্পদ বাঁচানোর নতুন উপায় খুঁজে পেয়েছে ।উত্তর পশ্চিম চীনের ইন ছুয়ান শহরে পানির দাম নির্ধারনের নতুন পদ্ধতি চালু হয়েছে । প্রতিমাসে নাগরিকদের যত বেশী পানি ব্যবহৃত হয় প্রতিঘন মিটার পানির দাম ততই বেড়ে যায় । পানির দাম নির্ধারনের এই নতুন পদ্ধতি চালু হওয়ার পর ইন ছুয়ান শহরের নাগরিকরা পানি বাঁচানোর ব্যাপারে আরো বেশী সচেতন হয়েছেন । চলতি বছরের প্রথমার্ধে ইন ছুয়ান শহরে গরমের দিন গত বছরের অনুরূপ সময়ের চেয়ে বেশী এবং লোকসংখ্যা বেড়েছে বিশ হাজার , কিন্তু পানির নতুন দর-ব্যবস্থার কল্যানে পানি বেঁচেছে ১২ লক্ষ টন ।
চীনের স্থাপত্য কোম্পানিগুলো বাড়িনির্মানে শক্তি - বাঁচানো - উপকরণ ব্যবহারের চেষ্টা করছে , গত দু বছরে চীনের ছিন হুয়াং তাও শহরের বহু সংখ্যক নাগরিক শক্তি - বাঁচানো - উপকরণ দিয়ে নির্মিত আবাসিক ভবনে উঠেছেন । সাধারণ আবাসিক ভবনের তুলনায় এই ধরনের আবাসিক ভবনে শক্তি বেঁচে যায় সত্তর শতাংশ । নাগরিক লি সিয়াও নং এই প্রসঙ্গে বলেছেন :শীতকালে আমাদের ফ্লাটরুমে বেশ উষ্ণতা এবং গ্রীষ্মকালে বেশ ঠান্ডা অনুভূত হয় ।
ছিন হুয়াং তাও শহরের নগর উন্নয়ন -পরিকল্পনা অনুযায়ী পরে নতুন উপকরণ ব্যবহার করে নতুন প্রযুক্তিতে এইশহরের বেসামরিক ভবন নির্মান করলে ৫০শতাংশেরও বেশী শক্তি বেঁচে যাবে ।
|