মধ্য চীনের হুনান প্রদেশের উ লিং পাহাড় একটানা কয়েক শত কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত, সেখানে উচুঁ উচুঁ পাহাড়ে নিবিড় বনে ছাওয়া, গাছগাছালিতে ভরপুর। হু ইং সিয়াংয়ের পরিবার বংশপরম্পরায় এই পাহাড়ে জীবন কাটাচ্ছেন। এখন ৫২ বছর বয়স্ক হু ইং সিয়াং যদিও কেবল প্রাথমিক স্কুল পাশ করেছেন, তবে তাঁর মাথায় ভালো বুদ্ধি আছে। কৃষি কাজের আয় বেশি না হলেও তিনি টাকাপয়সা জমিয়ে একটি ছোট দোকান খুলেছিলেন, সেখানে গ্রামবাসীদের দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিসপত্র পাওয়া যেতো। এই দোকান খুব ভালো আয় করতো। তবে এটা প্রায় দশ বারো বছর আগেকার কথা।
১৯৯৬ সালে উ লিং পাহাড়ে প্রচন্ড বন্যা ঘটে। বন্যায় গ্রামের বাড়িঘর এবং রাস্তাঘাট সব বিধ্বস্ত হয়। হু ইং সিয়াংয়ের বাড়ী এবং দোকানও রেহাই পায় নি।
বন্যার দরুন হু ইং সিয়াংয়ের জীবনের পথও বদলে গেছে। বন্যা বাড়ীঘর আর জমি সবই ধ্বংস করেছে। কেবল পাহাড়ের গাছগুলো আগের মতো প্রাণবন্ত রয়েছে। যদিও সরকার সময়োচিতভাবে ত্রাণের টাকা দিয়েছে, তবে এই টাকা দিয়ে জীবনযাত্রার মূল পরিবর্তন ঘটবে না। কি দিয়ে জন্মস্থানের পূর্ণর্গঠন করা যায়? এই কথা ভাবতে ভাবতে পাহাড়ের এক রকম বন্য চা গাছের কথা হু ইং সিয়াংয়ের মাথায় আসে।
তিনি সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন, "আমাদের এখানের আবহাওয়া এবং মাটির বৈশিষ্ট্য এই গাছটি চাষের জন্যে খুবই উপযুক্ত। এই গাছের টাটকা পাতা খেলে শরীর শীতল হয় এবং তেষ্টা মেটে।"
উপত্যকায় উত্পন্ন বন্য মিষ্টি চা গাছ হচ্ছে এক রকম চিরশ্যামল বৃক্ষ, প্রায় দুই মিটার উচু। তার পাতা মিঠা পানির মতোসুস্বাদু। স্থানীয় গ্রামবাসীরা পাহাড়ে গিয়ে কাজ করার সময় কখনো পানি আনে না। তেষ্টা পেলেই কেবল কয়েকটি পাতা মুখে দেন, আর সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
যদিও এই বন্য চা গাছ গ্রামবাসীদের বংশপরম্পরাগত সঙ্গী হয়ে আছে, তবে স্থানীয় লোকেরা এই গাছ সম্বন্ধে খুবই কম জানেন, তার আসল নামও জানেন না। হু ইং সিয়াং সংশ্লিষ্ট বই থেকে জানতে পেরেছেন, এই গাছের পাতার রক্তচাপ কমানো, মানুষের রোগ-প্রতিরোধের সামর্থ্য বাড়ানো এবং কলিজা সুস্থ রাখা, চেহারা সুন্দর করা এবং বার্ধক্য প্রতিরোধ করা ইত্যাদি গুণ আছে। হু ইং সিয়াং মনে করেন, এই পাতা দিয়ে বন্য মিষ্টি চা উত্পাদন করলে অবশ্যই তা জনপ্রিয় হবে।
তিনি ৮০ হাজার ইউয়েন রেনমিনপি ধার করে চা পাতা প্রক্রিয়াকরণের সাজসরজ্জাম কিনে এক বন্য মিষ্টি চা কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। চা পাতার গুনমান নিশ্চিত করার জন্য তিনি গ্রামের পাঁচ কিলোমিটার দূরে এক জনশুণ্য পাহাড়ে কারখানা প্রতিষ্ঠা করেছেন। সেখানে তিনি তাঁর স্ত্রী ও ছেলে মেয়ের সঙ্গে সারা দিন ব্যস্ত থাকেন। সারা পরিবারের প্রচেষ্টায় "তাশুআও " নামে বন্য মিষ্টি চা উত্পাদিত হয়েছে।
বন্য মিষ্টি চা বাজারে পৌঁছার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। অনেকে এসে তা কিনেন। এক বছরের মধ্যেই তিনি ঋণ পরিশোধ করেছেন। চীনের চা মহলের বিখ্যাত বিশেষজ্ঞ ছেন লিয়াং বিন এই চা নিয়ে গবেষণা করার পর আনন্দচিত্তে বলেছেন, এই চা রোগ-প্রতিরোধের সামর্থ্য বাড়ানো এবং ব্লাড-সুগার রক্তচিনি কমানোর ক্ষেত্রে বিশেষভাবে কার্যকর। তা ছাড়া অভ্যন্তরীণ তাপ দূর করা এবং দাঁতের বেদনাও উপশম করা যায়। আমি খুব খুশি যে তাঁরা এই পণ্য উত্পাদন করেছেন।
উত্পাদনের প্রক্রিয়ায় হু ইং সিয়াং বহু কঠিন সমস্যা অতিক্রম করেছেন। প্রথমে চা পাতার রং লাল, তার সঙ্গে পানি মেশালেও লাল হয়, দেখতে ভালো লাগে না। হু ইং সিয়াং অন্য অঞ্চলের কারখানায় গিয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয় শিখেন এবং চা পাতা তৈরির বইগুলো কিনে নিজে লেখাপড়া করেন। দু'বছরের অধ্যবসায়ের পর তিনি কৌশল আয়ত্ত করেছেন। তাঁর তৈরি চা পাতা পানির সঙ্গে মিশার পর সবুজ রং বজায় রাখে, খেতেও খুব মজা।
চা গাছ লাগানোর ক্ষেত্রেও হু ইং সিয়াং বহু চেষ্টা করেছেন। এখন তিনি প্রায় ছয় হেক্টর আয়তনের বীজতলা প্রতিষ্ঠা করেছেন। তিন বছর পর এখন থেকে চা পাতা পাওয়া যায়। হু ইং সিয়াং বলেছেন, ভবিষ্যতে বন্য মিষ্টি চা গাছ লাগানোর আয়তন আরো বাড়বে। এমন করলে নিজের কারখানার জন্য চা পাতা সরবরাহের পাশাপাশি সবুজায়নের মাত্রাও বাড়বে , পানি আর জমির ক্ষয়রোধ করা যায়, বন্যাও এড়ানো যায়।
হু ইং সিয়াংয়ের চা কারখানা স্থানীয় গ্রামবাসীদের জন্য কল্যাণ বয়ে এনেছে। হু ইং সিয়াং প্রতি বছর ২০ হাজার কেজি মিষ্টি চা পাতা প্রক্রিয়াকরণ করেন। এর অধিকাংশ চা পাতা কৃষকদের কাছ থেকে কেনা হয়। এখন বন্য মিষ্টি চা শিল্প স্থানীয় কৃষকদের আয় বাড়ানোর একটি নতুন হিটপয়েন্টে পরিণত হয়েছে। বন্য মিষ্টি চার মূল্য উপলব্ধিকারী কৃষকরা স্বতঃস্ফুর্তভাবে বন্য মিষ্টি চা গাছের নিবিড় যত্ন নেন।
হু ইং সিয়াংয়ের একই গ্রামের কৃষক ইয়াং চিয়াং ছেন বিশেষ করে হু ইং সিয়াংয়ের উত্পাদিত বন্য মিষ্টি চায়ের ব্যবসা করেন। তিনি শহরে একটি বন্য মিষ্টি চা বিক্রির কেন্দ্র খুলেছেন। তিনি বলেছেন, অনেকে বন্য মিষ্টি চার প্রাকৃতিক মিষ্টি গন্ধ পছন্দ করেন। তা খেয়ে ব্লাড সুগার কমানো যায় এবং তা স্বাস্থ্যের জন্য ভালো বলে আমার ব্যবসাও খুব ভালো । জেলা শহরের লোকেরা বন্য মিষ্টি চা খুব পছন্দ করেন। অনেকে দীর্ঘকাল ধরে খান। অনেকে তা কিনে এক বিশেষ পণ্য হিসেবে আত্মীয়স্বজন এবং বন্ধুবান্ধবকে উপহার দেন। আমার দোকানে প্রতি বছরে তিন চার শ কেজি বন্য মিষ্টি চা পাতা বিক্রি হয়। "
এখন হু ইং সিয়াং তাঁর বন্য মিষ্টি চায়ের জন্য "তাশুআও" ট্রেড মার্কা নিবন্ধিত করেছেন। গত বছরের মে মাসে তাঁর বন্য মিষ্টি চা হুনান প্রদেশের বৈজ্ঞানিক সাফল্য প্রদর্শনীতে স্বর্ণ পুরস্কার পেয়েছে। তাঁর চা পাতা জাপান , যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে রপ্তানি হয়।
|