৪৬ বছর বয়সী আন্ড্রি চাভাজুটির জন্ম ইটালির মিলান শহরে । প্রাচ্যের সংস্কৃতির প্রতি তাঁর কৌতুহল গভীর । মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করে তিনি ইটালির একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগে ভর্তি হন । ১৯৮১ সালে যখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করছিলেন তখন কাকতালীঁয়ভাবে পুর্বচীনের নানচিং শহর ভ্রমণের সুযোগ তাঁর মিলে। তরুণ আন্ড্রির চোখে ইটালির সঙ্গে সংস্কারের পথে অগ্রসরমান চীন একেবারে পৃথক । চীনের অনেক কিছুই তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে । পরের বছর চীনা ভাষা শিখতে তিনি চীনের সাংহাইয়ের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। দু বছর পর তিনি হংকংয়ে গিয়ে একটি ইটালিয়ান কোম্পানিতে চাকরি করেন । ১৯৯০ সালে পেইচিংয়ে এই কোম্পানির কার্যালয় খোলা হলে তিনি তার প্রধান প্রতিনিধি নিযুক্ত হন এবং পেইচিংয়ে তাঁর চাকরি জীবন শুরু হয় ।
১৯৯৯ সালে তিনি প্রধান প্রতিনিধির পদ থেকে ইস্তফা দেন এবং তাঁর স্বাধীন ভিডিও ক্যামেরাম্যান- জীবনের সুত্রপাত ঘটে । নতুন পেশা প্রসঙ্গে তিনি চীনাভাষায় সাবলীলভাবে বলেছেন: ছোটোবেলা থেকেই ছবি তোলা আমার শখ । গত শতাব্দির নববইয়ের দশকে আমি ভিডিও রেকর্ডিংয়ের কাজে হাত দিই । কাজটা আমার ভীষণ ভালোলাগে । ১৯৯৯সালে আমার কিছু টাকা জমা হলো । মনে মনে স্থির করলাম , ছবি সুটিংকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করব ।
আন্ড্রি মনে করেন , প্রাচীন মন্দির, জাদুঘর , পুরনো গলিতে আদিম পেইচিংবাসীদের জীবন , বড় বড় কোম্পানির তরুণ কর্মচারীদের জীবনসংগ্রাম সহ পেইচিংয়ের অফুরন্ত জিনিষই সুটিং করবার মত , ক্যামেরা ও ভিডিও ক্যামেরায় সেগুলোর সব নেওয়া কখনো সম্ভব নয় । আন্ড্রি ভিডিও ক্যামেরা ব্যবহার করে পেইচিংয়ের ইতিহাসের নিদর্শন বা পেইচিংয়ের উন্নয়নের পদচিহ্ন সংগ্রহ করেছেন । পেইচিংয়ে তাঁর চিত্র প্রদর্শনী ইতিমধ্যে আয়োজন করা হয়েছে ।
পেইচিং ছাড়া চীনের অনেক স্থান আন্ড্রি ভ্রমণ করেছেন । যেখানে তিনি যান সেখানকার সুটিংয়ের প্রচুর মালমসলা সংগ্রহ করছেন তিনি । মালমসলা বেশী জমা হলে তিনি সংগীতযোগে প্রামান্য চলচ্চিত্র তৈরী করেন ।তাঁর তৈরী প্রামান্য চলচ্চিত্রে দেখা যায় তাঁর জানা চীনের রুপরেখা ।
আন্ড্রির তৈরী যে একাধিক প্রামান্য চলচ্চিত্র ফ্রান্স ,ইটালি , সুইজর্ল্যান্ড, জার্মানী প্রভৃতি দেশের টিভি কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত হয়েছে তা চীনকে জেনে নিতে সেই সব দেশের জনসাধারণকে সাহায্য করেছে । তাঁর সংগৃহীত কিছু কিছূ মাল মসলা চীনের টিভিকেন্দ্রে ব্যবহৃত হয়েছে ।তাঁর তৈরী প্রামান্য চলচ্চিত্রে ঐতিহ্য ও আধুনিক যুগ এবং প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের চিন্তাভাবনার মিলনে চীনা সমাজের প্রকৃত ও প্রাণবন্ত চেহারা চিত্রিত হয়েছে ।
আন্ড্রি বলেছেন , আমি ক্যামেরা লেনস ব্যবহার করে নিজের অনুভুতি প্রকাশ করতে পছন্দ করি।যেটা আমি গভীরভাবে অনুভব করেছি এবং হৃদয়ংগম করেছি , তা অন্যদের দেখানোই আমার কর্তব্য । আগে আমি সবচেয়ে বেশী শুনেছি চীন সম্বন্ধে বহু পুরনো ও ভুল মন্তব্য । সেগুলো নিতান্তই অনিষ্টকর বলে আমি মনে করি । সেই ধরনের ভুল বোঝাবুঝি অনেক অবাঞ্ছিত ব্যাপারের কারণ হতে পারে ।আমার প্রত্যাশা, আমার রচনা সঠিকভাবে চীনকে জানতে পাশ্চাত্য দেশের মানুষদের সাহায্য করতে পারবে ।চীন সম্বন্ধে কারো পর্যাপ্তজানা থাকলে সে নিশ্চয় চীনকে ভালাবাসবে ।
আন্ড্রির স্বতন্ত্র মুল্যবোধ চীনের নাটকের পরিচালকদের ভালোলেগেছে । তাঁরা একের পর এক চীনা নাটকের মালটিমিডিয়া ডিস্ক তৈরীর কাজে অংশ নিতে আন্ড্রিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন । তিনি ইতিমধ্যে "তৃতীয় রিচার্ড" , " নতুন পেইচিংবাসী" প্রভৃতি চীনের সর্বাধিক বিখ্যাত নাট্যদল-- পেইচিং গণ শিল্প নাট্যদলের পরিবেশিত অনেক নাটকের জন্য মালটিমিডিয়া প্রতিকৃতি তৈরী করেছেন । পেইচিং গণ শিল্প নাট্যদলের মি: লি লিউ ই তাঁর অন্যতম সহযোগী । মি: লি লিউ ই তাঁর কর্মোদ্যমের প্রসংশায় পঞ্চমুখ ।তিনি বলেছেন , আমাদের সম্পর্ক অত্যন্ত মধুর , তাঁর সঙ্গে কাজ করে আমাদের মনে হয় না যে , তিনি একজন বিদেশী ।আমাদের দ্বিপাক্ষিক সহযোগিতা ফলপ্রসু , কখনো কখনো চীনা সহযোগীর চেয়ে তিনি অধিক কর্মনিষ্ঠ , আগ্রহী ও যত্নশীল ।
আন্ড্রির ভিডিও সুটিংয়ের নেশার পরিচয় সবচেয়ে বেশী পেয়েছেন তাঁর স্ত্রী চিন সিয়াও পেই । চিন সিয়াও পেই পেইচিংয়ের একটি বিদেশী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের একজন চীনা কর্মী। তিনি সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , ভিডিও সুটিং এখন তাঁর স্বামীর জীবনের প্রধান অঙ্গ ।সময় পেলেই তিনি হাতে ভিডিও ক্যামেরা নিয়ে বাইরে ভিডিও সুটিং করতে যান যেটা মজার বলে মনে হয় সঙ্গেসঙ্গে তা সুটিং করেন ।চীনে খুব কম জায়গা আছে যেখানে তাঁর পদাঙ্ক পড়ে নি ।
চিন সিয়াও পেইয়ের চোখে যেটা নেহায়েত মামুলি ব্যাপার ,তা আন্ড্রির ক্যামেরায় ধরা পড়তেই বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠে । আন্ড্রির তোলা ছবি মাঝেমাঝে চিন সিয়াও পেইকে বিস্ময়ানন্দ দেয় । তাই চিন সিয়াও পেই সর্বান্তকরণে তাঁর স্বামীর কাজকে সমর্থন করেন ।তাঁদের বাড়িতে বৃহত পর্দার প্রজেক্টর , কম্পিউটার , ইমেজ এডিট -যন্ত্র পরিপাটিভাবে সাজানো , এক মিটারেরও বেশী উচু আলমারি সংগৃহীত মালমসলায় পরিপূর্ণ ।
মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য আন্ড্রী প্রতিবছর সময় করে ইটালিতে ফিরে যান । তিনি মনে করেন , তিনি যে দীর্ঘসময়ে চীনে কাজ করতে ও জীবন যাপন করতে পারেন তার মূলে রয়েছে তার মায়ের অকুন্ঠ সমর্থন ।
তিনি বলেছেন , আমার কোনো কাজ সফল হলে আমার মা দারুন খুশী ।আমি এখন যে কাজ করছি তা আমার মাকে যে আনন্দ যুগাচ্ছে তা তার কাছে আমার যত্ন থেকে পাওয়া আনন্দের চেয়ে অনেক বেশী । ভবিষ্যত কার্যক্রম প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন , তিনি নিজের পরিচালনায় চীনের উপর একটি চলচ্চিত্র তৈরীর স্বপ্ন দেখছেন ।
|