গত ৭ বছর চীনে পণ্যদ্রব্যের ডাইরেক্ট সেলিং অর্থাত্ সরাসরি বিক্রয় নিষিদ্ধ ছিল । সম্প্রতি কর্তৃপক্ষ আইন প্রকাশ করে দেশী আর বিদেশী ব্যবসায়ীদের কাছে পণ্যের 'সরাসরী বিক্রয়' পদ্ধতি উন্মুক্ত করেছে।
গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে যুক্তরাষ্ট্রের একটি
স্বাস্থ্যকর খাদ্য কোম্পানি পণ্য বিক্রীর একটি নতুন পদ্ধতি চালু করেছে : কোম্পানিটির কোনো বিক্রয়কারী কর্মী পণ্য বিক্রী করতে নিজেকে সাহায্য করার জন্য কিছু লোকজনকে সংগ্রহ করতে পারলে এবং তাতে বিক্রয় বাড়াতে পারলে তাঁকে অতিরিক্ত বোনাস দেয়া হবে । এই পদ্ধতিতে পণ্য বিক্রয়ের জন্য কোনো নির্দিষ্ট দোকানের প্রয়োজন নেই । এটাকে বলা হয় 'সরাসরি বিক্রয়'
১৯৯০ সালে এই 'সরাসরি বিক্রয়' পদ্ধতি চীনে প্রবেশ করে এবং তার পরের কয়েক বছরে খুব পসারও লাভ করেছিল । কিন্তু এই পসার হবার পেছনে একটি সংকটও নিহিত ছিল । কিছু অসত্ বিক্রেতা মোটা মুনাফার লোভ দেখিয়ে প্রাণপণে তার সাহায্যকারীদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগলো। এই পদ্ধতিতে বিক্রেতাটির আয় প্রধানত নির্ভর করছে তার নিযুক্ত সাহায্যকারীদের সংখ্যা আর তাদের বিক্রয়জনিত আয়ের ওপর। এই বিক্রয় পদ্ধতিকে চীনে বলা হয় 'ছুয়েনসিয়াও' অর্থাত্ 'রিলে বিক্রয়' , বিদেশে বলা হয় 'পিরামিড ধাঁচের বিক্রয়'। এই পদ্ধতিতে বিক্রেতারা তাদের প্রচুর সংখ্যক সাহায্যকারীকে ঠকিয়ে মুনাফা লাভ করে ।
এই অবৈধ 'রিলে বিক্রয়' স্বাভাবিক 'সরাসরি বিক্রয়ের' বাজার বিশৃংখল করে ফেলে। ১৯৯৮ সালে সরকার ' রিলে বিক্রয় নিষিদ্ধকরণের বিজ্ঞপ্তি" জারী করে। এ প্রসঙ্গে চীনের রাষ্ট্রীয় শিল্প ও বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট ডিরেক্টর উ ইয়েন বলেছেন, " অবৈধ 'রিলে বিক্রয়' খুবই ক্ষতিকর বলে চীন সরকারের নির্দেশে এই ' রিলে বিক্রয়' পদ্ধতির ওপর নিষেদ্ধাজ্ঞা আরোপ করা হয় । বিভিন্ন স্তরের শিল্প ও বাণিজ্য বিভাগ এবং নিরাপত্তা বিভাগও এই অবৈধ বিক্রয় পদ্ধতি নিষিদ্ধ করার কতকগুলো ব্যবস্থা নিয়েছে, তাতে স্থানীয় সরকারও অনেক কাজ করেছে ।"
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে চীনাদের ভোগ্য পণ্য পাওয়ার পদ্ধতি ক্রমেই আরও বেশী বহুমুখী হয়, ফলে চীনা বাজারে স্বাভাবিক ধরনের সরাসরি বিক্রয় ব্যবসার চাহিদা বেড়ে যায়। কিছু কোম্পানি এবং ব্যক্তি 'সরাসরি বিক্রয়' পদ্ধতিতে ব্যবসা চালানোর চেষ্টা শুরু করে। তা'ছাড়া চীন বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় অন্তর্ভুক্ত হবার সময়ে যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তা অনুযায়ী চীনকে অবশ্যই ২০০৫ সালের শেষ দিক থেকে 'সরাসরি বিক্রয়' ব্যবসা উন্মুক্ত করে দিতে হবে। এই পরিপ্রেক্ষিতে চীন সরকার " সরাসরি বিক্রয় নিয়ন্ত্রণের নিয়মাবলী" এবং "রিলে বিক্রয় নিষেধের নিয়মাবলী" প্রকাশ করে।
নতুন নিয়মাবলী অনুযায়ী সরাসরি বিক্রয় পরিচালনাকারী কোম্পানির বিক্রেতাদের যার যার বিক্রয়জনিত আয় অনুযায়ী তাদের আয়ের পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে, এবং মোট আয় তার নিজের পণ্যবিক্রয়জনিত আয়ের ৩০ শতাংশের বেশী হতে পারবে না। তা'ছাড়া সরাসরি বিক্রয় পরিচালনাকারী বৈধ কোম্পানি হবার শর্ত বেশ কড়াকড়ী : এক, একটানা ৫ বছরে এই কোম্পানি আইনের গুরুতর লংঘন করে নি, কোম্পানির নিবন্ধিত পুঁজি এক কোটি মার্কিন ডলারের কম হলে চলবে না, কোম্পানি প্রতিষ্ঠার সময়ে নির্দিষ্ট ব্যাংকে ২৫ লক্ষ মার্কিন ডলার পরিমাণের 'আর্নেস্ট মানি' জমা রাখতে হবে এবং কোম্পানির তথ্য প্রকাশের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
চীনের 'সরাসরি বিক্রয়' গবেষণার প্রবীণ বিশেষজ্ঞ ইয়াং ছিয়েন বলেছেন, " উপরোক্ত দুটো নিয়মাবলী প্রকাশিত হবার পর শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো আর সরাসরি বিক্রয় ব্যবসার বিক্রেতাদের জন্য এই ব্যবসা চালানোর বা তা বেছে নেয়ার এক মানদণ্ড এবং আইনগত ভিত্তি হয়েছে । কারণ অতীতে এই পদ্ধতি আইনসংগত কি -না তা খুব স্পষ্ট ছিল না,আমরা জানতাম না, কোন্ কোম্পানি হলো 'সরাসরি বিক্রয় কোম্পানি, কোন্ কোম্পানি তা নয় ।"
"সরাসরি বিক্রয় নিয়ন্ত্রণের নিয়মাবলী" অনুযায়ী , সংশ্লিষ্ট কোম্পানি ১৮ বছরের কম বয়সের লোককে নিয়োগ করতে পারবে না, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রী ,শিক্ষকশিক্ষিকা , চিকিত্সাকর্মী, সামরিক ব্যক্তি প্রমুখ ব্যক্তিকে নিয়োগ করতে পারবে না। শুধু স্থানীয় চীনাকে নিয়োগ করতে পারবে। আইন অনুযায়ী এই ব্যবসা চালানোর অনুপযুক্ত লোককে নিয়োগ করতে পারবে না। তা'ছাড়া সরাসরি বিক্রয় ব্যবসার বিক্রেতার কাছে অবশ্যই সরকারের অনুমোদিত 'সরাসরি বিক্রয় কার্ড' থাকতে হবে।
লিউ সিন একটি বেতারের রেকর্ডিং বিষয়ক কর্মী, বেতারে তার আয় কম নয়, তবুও তিনি চাকরি ছেড়ে 'সরাসরি বিক্রয় ব্যবসার কাজ নিলেন । তিনি সাত-আট বছর আগেও নিজের প্রধান চাকরির সঙ্গে সঙ্গে 'সরাসরি বিক্রয় ব্যবসা' চালিয়েছিলেন। কিন্তু পরে এক সময় ব্যবসাটা নিষিদ্ধ হয়েছিল। এবার নতুন নিয়মাবলী প্রকাশিত হয়েছে । তিনি তা ভাল করে গবেষণা করে উপলব্ধি করেছেন, এটা তবুও তাঁর জন্য এক ভাল সুযোগ। তিনি বলেছেন, " আমি লক্ষ্য করেছি, 'সরাসরি বিক্রয়ের' পদ্ধতি উন্নয়নের অনুকূল। যেমন এটা লোকের ব্যক্তিগত রুচি ও চাহিদা মেটানো যায় এমন এক পরিসেবা। আমি মনে করি, এ রকম ব্যবসায় বেশি টাকা উপার্জন করতে পারি । অবশ্য ভূঁইফোড় হবার মতো হঠাত্ ধনী হতে পারবো না। তবে এটা এক ভাল কাজ। আগে কেউ প্রচারণা করেছিলো যে, 'তুমি এক হাজার ডলার পুঁজি বিনিয়োগ করলে সহজেই খুব ধনী হতে পারবে। এই প্রচারণা খুব বাজে ছিল।"
বিশ্লেষকদের মতে , যে সব কোম্পানি 'সরাসরি বিক্রয়' প্রতিষ্ঠান হবার জন্য আবেদন করতে চায়, তাদের অবশ্যই নিয়মাবলী অনুযায়ী বাজার পরিকল্পনা, বিক্রয়কর্মীদের ব্যবস্থাপনার পদ্ধতি, পণ্যের দাম, লোজিস্টিক্সের ধাঁচ ইত্যাদির দিক থেকে নিজেদের যথাযথ পুনর্বিন্যাস করতে হবে ।
|