তাসি গ্রাম সিনচিয়াংয়ের তাকলামাকান মরুভূমির এক প্রান্তে অবস্থিত । উইগুর ভাষায় তাসি অর্থ লবণের সাগর । ইতিহাসে দক্ষিণ সিনচিয়াংয়ের উই লি জেলায় অবস্থিত এই গ্রাম একটি দরিদ্র গ্রাম বলে পরিচিত ছিল । জানা গেছে , বর্তমানে এই গ্রামে শতকরা ২০ ভাগেরও বেশি পরিবারে মোটর গাড়ি আছে আর অর্ধেকেরও বেশি গ্রামবাসী মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন । সম্প্রতি সি আর আইয়ের সংবাদদাতা এই গ্রামে সাক্ষাত্কার নিয়েছেন ।
সংবাদদাতা দক্ষিণ সিনচিয়াংয়ের কোরলা শহর থেকে দেড় ঘন্টা ধরে গাড়ি চালিয়ে তাসি গ্রামে পৌঁছলেন । গ্রামটি যদিও মরুভূমির এক প্রান্তে লবণাক্ত ও ক্ষারীয় এলাকায় অবস্থিত , তবু ওখানে সংবাদদাতা অন্য ধরণের বিস্ময়কর পরিবেশ দেখেছেন ।
আমার নাম চাং লেই । আমি দেখলাম , গ্রামের নিকটবর্তী নিবিড় বন এলাকায় বিস্তীর্ণ মরুভূমি থেকে গ্রামটিকে পৃথক করা হয় । গ্রামে অধিবাসীদের বাড়িঘর পরিপাটি আর সুন্দর । প্রতিটি পরিবারের উদ্যান বৈচিত্র্যময় ঘাস ও ফুলে ভরপুর । কিছু পরিবারের উদ্যানে নতুন মোটর গাড়ি আর মোটর সাইকেল থামল । গ্রামের বাইরে ফলের গাছে গাছে প্রচুর নাশপাতি , ডালিম আর আংগুর ঝুলছিল । বিস্তীর্ণ তুলোর ক্ষেতে সাদা সাদা তুলো ফুটে আছে । সর্বত্রই প্রাচুর্যময় ফসল দেখা যাচ্ছিল ।
এই দৃশ্য দেখে আপনারা হয়তো মোটেই ভাবতে পারবেন না যে , বিশাধিক বছর আগে তাসি গ্রাম এমন একটি দরিদ্র গ্রাম ছিল , যেখানে গ্রামবাসীরা সরকারের ত্রাণ আর ভর্তুকির ওপর নির্ভর করে জীবনযাপন করতেন । তখন গ্রামবাসীদের মধ্যে শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি উইগুর জাতির লোক । তারা পশুপালন করতেন আর ফল গাছ লাগাতেন । হান জাতির লোকেরা শাক-সব্জি আর তুলো চাষ করতেন । যেহেতু গ্রামের বেশির ভাগ জমি লবণাক্ত আর ক্ষারীয় , সেহেতু গ্রামবাসীরা সারা বছর পরিশ্রম করে অন্ন- বস্ত্রের অভাবও নিষ্পত্তি করতে পারতেন না । গ্রামবাসীরা সংবাদদাতাকে বলেছেন , তাসি গ্রামের যে পরিবর্তন হয়েছে , তার মূলে রয়েছে শাউর মানগ্রিক নামে একজন উইগুর ক্যাডারের নেতৃত্ব ।
৬০ বছর বয়স্ক শাউর মানগ্রিক ব্যবসা করেছেন । তিনি অভিজ্ঞ এবং গ্রামের প্রধান নির্বাচিত হয়েছেন । বিস্তারিতভাবে তদন্ত চালাবার মাধ্যমে তিনি উপলব্ধি করেন যে , দারুণ পরিবেশ তাসি গ্রামের দারিদ্র্যের মূল কারণ নয় ।
তখন গ্রামে ন'শো ৬০ গ্রামবাসী ছিলেন । তাদের চিন্তাধারা সেকেলে ছিল । তারা নিষ্কর্ম দিন কাটাতেন । কর্ম হার নীচু ছিল । চাষাবাদের উন্নত মানের প্রযুক্তি ছিল না বলে ফসলের উত্পাদন পরিমাণ অল্প ছিল ।
সেই জন্য শাউর মানগ্রিক গ্রামবাসীদের পুরানো ধারণা বদলানোর সিদ্ধান্ত নেন । তিনি গ্রামের নেতৃমন্ডলীতে দক্ষ অল্পবয়সীদের অন্তর্ভুক্ত করেন , কৃষকদের চাষাবাদের জ্ঞান ও প্রযুক্তি শেখানোর জন্য প্রকৌশলীদের আমন্ত্রণ করেন । এর সংগে সংগে তিনি পরষ্পরের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণ আর সাহায্য নেয়ার পরামর্শ দেন । ফলে গ্রামে হান জাতির লোকেরা পশু পালন ও ফল গাছ লাগানো আর উইগুর জাতির লোকেরা শাক-শবজি ও তুলো রোপনের দক্ষ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন ।
তা ছাড়া তিনি গ্রামবাসীদের জন্য প্রশিক্ষণ কোর্সও চালু করেন ।
গ্রামে নিরক্ষরতা দূরীকরণ কোর্স চালু হয় । শীতকালে কৃষকদের দেশ-বিদেশের খবর আর কৃষির বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত তথ্য বর্ণনা করার প্রশিক্ষণ কোর্স আয়োজন করা হয় । ১৯৯৭ সালে গ্রামে নিরক্ষরতা দূরীকরণ হয় ।
বাইরের তথ্য আর বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান বেশি শেখার জন্য তাসি গ্রামের কিছু কিছু অলপবয়সী লোকেরা মনে করেন যে , শুধু চাষাবাদ আর পশুপালন করলে আয় বেশি হবে না । তারা বিভিন্ন অঞ্চলের তথ্য সংগ্রহের ভিত্তিতে ময়দা কারখানা , ইট খোলা , পশু ও হাঁস-মুরগি খামার , কৃষি বাজার আর স্বচ্ছ প্ল্যাস্টিক আবরণের জমিতে শাক-সব্জি চাষের ঘাঁটি গড়ে তুলেছেন । এই সব ক্ষুদ্র কারখানা প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় শক্তি সম্পদ কাজে লাগানো হয় , অর্থবিনিযোগ কম , কিন্তু বাজারের চাহিদা বেশি । সুতরাং এই অঞ্চলে গ্রামীণ শিল্প দ্রুত বিকশিত হয়েছে ।
৩৪ বছর বয়স্ক মোহামেদ শাউর গ্রামের একজন দক্ষ কৃষক । তিনি বলেছেন , গ্রামের কৃষি প্রযুক্তি শিক্ষা কোর্সে অংশ নেয়ার পর তার পরিবারের তুলোর উত্পাদন পরিমান বেড়ে গেছে । আয়ও বেশি হয়েছে । কৃষি সম্পর্কিত জ্ঞান বাড়ানোর জন্য তিনি প্রতি বছর বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষাবাদ , পশু ও হাঁস-মুরগি পালন বিষয়ক পুস্তক কিনে থাকেন । এখন তিনি ইন্টারনেট থেকে প্রযুক্তিগত তথ্য সংগ্রহ করেন । কৃষি প্রকৌশলীদের পরামর্শে তিনি যেমন তুলো ও নাশপাতি চাষ করেন , তেমনি পশু ও হাঁস-মুরগি খামারও গড়ে তুলেছেন । তিনি যে সব জ্ঞান আর প্রযুক্তি শিখেছেন , সেগুলো প্রতিবেশীদের মধ্যে জনপ্রিয় করার জন্যও তিনি প্রচেষ্টা চালান । তার প্রস্তাবে গ্রামে যারা নিম্ন মাধ্যমিক স্কুল ও এর উপরের পর্যায়ের স্কুল থেকে পাশ করেছেন , তারা প্রতি বছরের শীতকালে দু'মাসব্যাপী বৈজ্ঞানিক ও প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ কোর্সে অংশ নেন ।
গ্রামের শিক্ষিত ও দক্ষ অল্পবয়সীদের প্রভাবে গ্রামবাসীদের জীবধারাও পরিবর্তিত হয়েছে । এখন যারা কথাবার্তা বলেন , তারা অতীতের কথা বলেন না , বরং চাষাবাদের নৈপুণ্য আর আয় -উপার্জনের বিষয় নিয়ে কথাবার্তা বলেন ।
মোহামোদ শাউর সুখী জীবনযাপন করছেন । তার প্রভাবে গ্রামবাসীদের জীবনযাপনের মানও উন্নত হয়েছে । দু' বছর আগে তিনি চীনের যুবক-যুবতীদের সর্বোচ্চ পুরস্কার পেয়েছেন । রাষ্ট্রীয় নেতৃবৃন্দ তাঁকে সাক্ষাত্ দান করেছেন । অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি খুব উত্তেজিত হয়েছেন ।
সে দিন বিকেলে রাষ্ট্রপতি হু চিন থাও আমার সামনে এগিয়ে এলেন । তিনি প্রীতি ও সম্ভাষণ জানিয়ে আমার সংগে করমর্দন করলেন । আমি উইগুর জাতির একজন গ্রামীণ ক্যাডার জেনে তিনি এই বলে আবার উত্সাহ দিলেন যে , আপনি প্রাথমিক স্তরের একজন ক্যাডার , নিরন্তরভাবে কৃষি প্রযুক্তি ও জ্ঞান শিখতে হবে এবং গ্রামবাসীদের আরো বেশি সাহায্য করতে হবে ।
বর্তমানে তাসি গ্রামের ৩১০টি কৃষক পরিবারের মধ্যে প্রায় ৭০টি কৃষক পরিবার মোটর গাড়ি কিনেছে ।এদের মধ্যে অর্ধেকেরও বেশি লোক মোবাইল ফোন ব্যবহার করছেন । গত বছর গ্রামে কৃষকদের মাথাপিছু গড়পড়তা আয় ৬ হাজার ৩ শো ইউয়ান ছাড়িয়ে গেছ
|