চীনের গ্রামাঞ্চলে অর্থনীতির উন্নয়নের সংগে সংগে চীনের কৃষকদের আয়ও লক্ষনীয়ভাবে বেড়ে গেছে , গ্রামীণ অধিবাসীদের জীবনযাত্রার মান ক্রমাগত উন্নত হচ্ছে এবং তাদের জীনবধারাও বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে । সম্প্রতি সি আর আইয়ের সংবাদদাতা চীনের মধ্য ও দক্ষিণাংশের চিয়াংসি প্রদেশের একটি গ্রামে সাক্ষাত্কার নিয়েছেন । ওখানে তিনি গ্রামবাসীদের সুখী জীবনযাপন উপলব্ধি করেছেন ।
সিংফু নামে গ্রাম অর্থাত্ সুখী গ্রাম চিয়াংসি প্রদেশের পিনসিয়াং শহরের উপকন্ঠে অবস্থিত । গ্রামটি চিয়াংসি প্রদেশের অন্যতম আদর্শ গ্রাম । গ্রীষ্মকালের একটি উজ্জ্বল দিন সংবাদদাতা সুখী গ্রামে সাক্ষাত্কার নিতে গেলেন । মহাসড়ক থেকে দূরে দেখলে চোখে পড়ল প্রচুর কৃষক বাড়ি পাহাড়ের ঢালু বরাবর সুবিন্যাস্ত । যাবতীয় কৃষক বাড়ির সামনে ও পেছনের প্রাঙ্গন নিবিড় সবুজ গাছপালায় ঘেরাও ।
গ্রামের সামনে পৌঁছলে উত্সাহব্যঞ্জক ঢোল বাজানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল । সংগীতের এই আবেগপূর্ণ তালে তালে গ্রামবাসীরা নাচ করছিলেন । এটাই গ্রামের নৃত্য দলের নাচ চর্চা । গ্রামের বিস্তীর্ণ মাঠে তারা প্রতিদিন নাচ করেন ।
নৃত্য দলের সমস্যা ৫৮ বছর বয়স্ক মাদাম লিউ ওয়েন চি সংবাদদাতাকে বলেছেন , গ্রামের বহু মহিলা ঢোল বাজানো আর নাচ করাটাকে খুব পছন্দ করেন । এতে যেমন শরীর চর্চা করা হয়েছে , তেমনি মন সন্তুষ্ট করা হয়েছে । প্রাচুর্য সাংস্কৃতিক তত্পরতা আর আমোদ প্রমোদ সিংফু গ্রামের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যে পরিণত হয়েছে ।
গ্রামের নারীরা সকালে বাড়িতে ঘর পরিষ্কার করেন আর কৃষিকর্ম করেন । বিকেলে তারা নাচ গান করেন । কেউ কেউ বা শরীর চর্চা ক্লাবে গিয়ে খেলেন । গ্রামে বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক তত্পরতা আর শরীর চর্চা জাঁকজমকপূর্ণভাবে চলছে । এই সব আমোদ প্রমোদ চালাতে পোষাক ও বাদ্য যন্ত্র কেনার জন্য যে সব খরচ লাগে , তা সব কিছু গ্রামবাসীরা বহন করেন । তার উদ্দেশ্য গ্রামবাসীদের অবসর জীবনযাপনের স্ফুর্তিপূর্ণ করে তোলা ।
আসলে সুখী গ্রামে শরীর চর্চা মাঠ ছাড়া অন্য ধরণের খেলাধূলা আর আমোদ প্রমোদেরও ব্যবস্থা করা হয় । শীতকালে কৃষিকর্ম কম । বহু গ্রামবাসীরা পাঠকক্ষে বই পড়েন , নাচ করেন আর দাবা খেলেন । কেউ কেউ সংগীত উপভোগ , সিনেমা দেখা আর টেবিল টেনিস খেলাও পছন্দ করেন । গত কয়েক বছরে সুখী গ্রামে যে এত রকমারি সাস্কৃতিক তত্পরতা দেখা দিয়েছে , তার মূলে রয়েছে সংস্কার আর উন্মুক্ততার প্রবর্তন । গত শতাব্দির সত্তরের দশকের শেষ নাগাদ চীনে সংস্কার আর উন্মুক্ততা প্রবর্তিত হবার পর থেকে গ্রামে অর্থনীতির বহুমুখী উন্নয়নের ওপর ব্যাপক গুরুত্ব দেয়া হয় । ফলে গ্রামীণ অর্থনীতিতে দ্রুত বিকাশ অর্জিত হয়েছে । গ্রামের ক্যাডারদের পরিচালনায় গ্রামবাসীরা বৈজ্ঞানিক উপায়ে পশু ও হাঁস-মুরগি পালন করেন আর সবুজ কৃষি উন্নয়ন করেন । ফলে গ্রামবাসীদের আয় ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে । তাতে জীবনযাত্রার মান নিরন্তর উন্নত হয়েছে । বর্তমানে গ্রামে ফুল , গাছ , সংকর ধান আর সবুজ ফল লাগানো সহ বেশ কয়েকটি খামার গড়ে তোলা হয়েছে । এই সব খামারের কৃষি পণ্য দেশের দশাধিক প্রদেশে বিক্রি করা হয় ।
গ্রামবাসীরা ধনী হবার পর গণ কল্যাণ আর পরিবেশ সুরক্ষা ব্রতের ওপর মনোযোগী হয়েছেন । গ্রামবাসী মাদাম লিউ হুই লান গৌরবের সংগে সংবাদদাতাকে বলেছেন , সুখী গ্রামের পরিবেশ যে সুন্দর হয়ে উঠেছে , তার মূলে রয়েছে গ্রামবাসীদের বৃক্ষ ও ঘাস লাগানো ।
পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়েছে । গ্রামবাসীরা পরিবেশ সংরক্ষণ আর জঞ্জাল সুব্যবস্থার ওপর খুব মনোযোগ দেন । গ্রামে কয়লা প্রধান জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করা হয় । কয়লা ব্যবহৃত হবার পর যে জঞ্জাল সৃষ্টি হয় , তা সরানোর জন্য প্রত্যক কৃষক পরিবারের প্রাঙ্গনে একটি জঞ্জাল রাখার গর্ত খনন করা হয় । এতে জমি দূষণমুক্ত হয় এবং সার হিসেবে তা ব্যবহারে শাক-সব্জি চাষের অনুকূল ।
এখন গ্রামে গাছ লাগানোর ফলে শতকরা ৯০ ভাগ জায়গায় সবুজীকায়ন বাস্তবায়িত হয়েছে । পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য বহু কৃষকদের বাসায় বাথরুম নির্মান করা হয়েছে । ৮০ বছর বয়স্ক গ্রামবাসী লিউ ছিং ফেন এই গ্রামে আজীবন বাস করেন । তিনি বলেছেন , এখন গ্রামাবাসীরা ধনী হয়েছেন আর গ্রামের পরিবেশ মনোরম হয়েছে ।
এখন আমাদের জীবনযাত্রার মান দিন দিন উন্নত হচ্ছে । প্রতিদিন বৃদ্ধ ও বৃদ্ধরা ব্যায়াম করেন বা অন্য ধরণের খেলাধূলা করেন । কোনো কোনো সময় আমরা টেলিভিশন দেখি , গ্রামবাসীদের বাসায় বেড়াতে যাই বা দেশ-বিদেশের খবরাখবর নিয়ে কথাবার্তা বলেন ।
বৃদ্ধটা সংবাদদাতাকে বলেছেন , গ্রামের গণ কল্যাণ ব্রত চালানোর জন্য বহু গ্রামবাসীরা চাঁদা দেন । গ্রামে ১২ মিটার চওড়া আর ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি সড়ক আছে । তা নির্মাণ করার জন্য ৪ বছরে ৮ শতাধিক জনের শ্রমশক্তি আর গ্রামবাসীদের ১০ লক্ষ ইউয়ানেরও বেশি অর্থ সংগ্রহ ব্যবহার করা হয়েছে । এই পাকা সড়ক গ্রামের ভেতরে বিস্তৃত হয় । তাতে গ্রামের ১৮৫টি পরিবারের জন্য উপকার হয়েছে ।
সুষ্ঠু ও আনন্দপূর্ণ পরিবেশ বহু পর্যটকদের আগমণ করেছে । এর জন্য সৃষ্ট কৃষক পরিবারের পরিবেশ পর্যটনও সুখী গ্রামবাসীদের জন্য বহু আয় বয়ে এনেছে । গ্রামের প্রধান মিঃ লিউ তে শাং সংবাদদাতাকে বলেছেন , পর্যটকদের স্বাগত আর আতিথেয়তা জানাবার জন্য গ্রামে যে সব সভ্য পরিবার বাছাই করা হয়েছে , সে সব পরিবারে সদস্যদের সম্পর্ক প্রীতিকর এবং বাড়িঘর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। এতে সমগ্র গ্রামের কৃষক পরিবারের পরিবেশ সুরক্ষা আর আন্তরিকতা ও আতিথেয়তার ওপর গুরুত্ব দেয়ার ধারণা ত্বরান্বিত করা হয়েছে ।
যে সব পরিবারে এই সব যোগ্যতা নেই , সে সব পরিবারে পর্যটকদের আতিথেয়তা জানানো যায় না । ফলে গ্রামবাসীদের মধ্যে বাজার অর্থনীতির প্রতিযোগিতার শক্তি বিষয়ক ধারণা বেড়ে গেছে । এ পর্যন্ত গ্রামে মেট ৮০টি কৃষক পরিবারে পর্যটকদের আতিথেয়তা জানানো হচ্ছে । গ্রামবাসীরা পরিশ্রম ও বুদ্ধির ওপর নির্ভর করে নিজের সুখী ও সৌহার্দ্যপূর্ণ জীবনযাপন সৃষ্টি করেছেন ।
|