চলতি বছর চীনা জনগণের জাপানী আগ্রাসন বিরোধী যুদ্ধে বিজয় লাভের ষাটতম বার্ষিকী এবং বিশ্বের ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধে বিজয় লাভের ষাটতম বার্ষিকী। ৬০ বছর আগে জার্মানী ও জাপান যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ বাঁধিয়েছিল মানব জাতির ইতিহাসে তা একটি ভয়াবহ দু:স্বপ্ন । অপরিমেয় ক্ষতি ও ত্যাগ স্বীকার করার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ব জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়াই করে অবশেষে পিশাচী ফ্যাসিবাদী শক্তিকে পরাস্ত করেছিলেন ।মানব জাতি এখন শান্তি ও উন্নয়নের পথে অগ্রসর হচ্ছে ।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিজয় কোনো এক দেশের বিজয় নয় , বরং বিশ্বের যাবতীয় শান্তিপ্রিয় দেশের জনগণের অভিন্ন বিজয় । চীনা জনগণের জাপানী আগ্রাসন বিরোধী যুদ্ধ বিশ্বের ফ্যাসিবাদ বিরোধী যুদ্ধের এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ । জাপানী আগ্রাসন বিরোধী যুদ্ধে চীনা জনগণ অন্যান্য দেশের বলিষ্ঠ সমর্থন ও সাহায্য পেয়েছিলেন । বিশেষ করে সোভিয়েত ইউনিয়ানের লাল ফৌজ হানাদার জাপানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ চালিয়েছিল তা চীনা জনগের চুড়ান্ত বিজয়ের পথ সুগম করেছিল ।
সি আর আইয়ের সংবাদদাতা সম্প্রতি হানাদার জাপানী বাহিনীর বিরোদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী লাল ফৌজের দুজন প্রবীন সেনার সাক্ষাতকার নিয়েছেন ।
প্রবীন সেনা নিকোলাই ফেওডোরোভিচ ফেডোটোভের বয়স এখন ৮৪ বছর । অবসর গ্রহণের সময় তিনি মেজর জেনারেল ছিলেন । তিনি শুধু সোভিয়েত ইউনিয়ানের মাতৃভূমি রক্ষার যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাই নয় , জার্মানীর ভূভাগে গিয়েও যুদ্ধ করেছিলেন এবং ১৯৪৫ সালের আগস্ট মাসে উত্তর পূর্ব চীনে জাপানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন ।
তিনি বলেছেন ,আমি মিন্সেকের নিকটবর্তী এক স্থানে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম । সোভিয়েত ইউনিয়ানের অভ্যন্তরে প্রবেশকারী জার্মান বাহিনীর অভিযান প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের বাহিনী মিন্সেকের অদূরে জার্মান বাহিনীর সঙ্গে তুমুল লড়াই করেছিল । এর পর আমাদের বাহিনী মস্কো প্রতিক্ষা যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। রণনৈতিক পাল্টা আক্রমণ শুরু হওয়ার পর আমরা বেলারুশের তৃতীয় ফিল্ড বাহিনীর সৈন্যদল হিসেবে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হতে থাকি এবং যুদ্ধ করতে করতে অবশেষে জার্মানীর পূর্ব ফুলুসে পৌছি। সেখানে আমরা পুর্বাঞ্চলে ফিরে সামরিক অভিযান চালানোর আদেশ পাই ।
চার বছরস্থায়ী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চালানোর পর ইউরোপে মিত্রবাহিনীর চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয় । ১৯৪৫ সালের ৮ মে ইউরোপে যুদ্ধের অবসান ঘটে । কিন্তু ফ্যাসিবাদী দেশ জাপান তখনো পরাজয়ের কবল থেকে রক্ষা পাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টাকরছিল ।
১৯৪৫সালের ৮ আগস্ট ইয়ার্টা চুক্তি অনুযায়ী সোভিয়েত ইউনিয়ান জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। নিকোলাই ফেওডোরোভিচের বাহিনী আদেশ পেয়ে উত্তর পূর্ব চীনে প্রবেশ করে ।
তিনি বলেছেন , ১৯৫৪ সালের জুন মাস আমাদের বাহিনী জার্মানী ছেড়ে মঙ্গোলিয়ায় গিয়ে জাপানী বাহিনীর উপর আক্রমণ চালানোর আদেশ পায় । তখন সোভিয়েত ইউনিয়ানের প্রথম ও দ্বিতীয় দূরপ্রাচ্য ফিল্ড বাহিনী এবং পশ্চাদ- বাইকাল ফিল্ড বাহিনীর সামরিক অফিসার ও সৈন্যদের সংখ্যা দশ লক্ষেরও বেশী । ৯ আগস্ট আমাদের বাহিনী চীন- মঙ্গোলিয়া সাধারণ সীমান্ত অতিক্রম করে চীনে প্রবেশ করে । ইঞ্জিনিয়ারিং বাহিনী হিসেবে আমাদের প্রধান কর্তব্য ছিল রাস্তা তৈরী করা । আমাদের বাহিনী পর পর জাপানী বাহিনীর খপ্পর থেকে ছাংছুন, সেন ইয়াং ও তালিয়ান শহরকে মুক্ত করে । এক সপ্তাহ যেতে না যেতেই জাপান আত্মসমর্পন করে । উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে লাল ফৌজের ২৫জন সৈন্য নিয়ে আমি লু সুন শহরে গিয়ে এক জাপানী ডিভিশনের আত্মসমর্পন-পত্র গ্রহণ করি।
ফেডোটোভের থেকে টারাস জর্জিয়েভিচ সুডলোর ইতিবৃত্ত আলাদা । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে সুডলো শুধু জাপানী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন।তিনি বলেছেন , ১৯২৭ সালে আমার জন্ম । যুদ্ধ বাঁধার সময় আমার বয়স মাত্র ১৪ বছর । কাজেই জার্মান ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সুযোগ মেলে নি আমার । আমি ১৫ বছর বয়সে কিশোরদের জন্য বিশেষভাবে খোলা একটি গুলন্দাজ কলেজে ভর্তি হই । ১৯৪৫ সালে পড়াশোনা শেষ করে যখন কলেজ থেকে বেরিয়ে আসি তখন আমার বয়স ১৮ বছর । ১৯৪৫ সালের ৮ আগস্ট সোভিয়েত ইউনিয়ান জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করার পর আমি আমার সহযোদ্ধাদের সঙ্গে উত্তর পূর্ব চীনে প্রবেশ করে জাপানী বাহিনীর উপর আক্রমণ চালাই । প্রায় এক সপ্তাহ পর আমরা বিজয় লাভ করি ।
চীনের জাপ বিরোধী যুদ্ধের তাত্পর্য প্রসঙ্গে জর্জিয়েভিচ বলেছেন : অনেক চীনাও সোভিয়েত বাহিনীতে যোগদান করে প্রত্যক্ষভাবে জার্মানীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলেন । কিন্তু যেটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো , ফ্যাসিবাদী দেশ জাপান চীনের যুদ্ধক্ষেত্রের পঙ্কে নিমজ্জিত হয়েছিল , জাপান জার্মানী ও ইটালির সঙ্গে আঁতাত করে সোভিয়েত ইউনিয়ানের উপরে আক্রমণ চালাতে চেয়েছিল , কিন্তু স্টালিনগ্রাদ প্রতিরক্ষা যুদ্ধের বিজয় ও চীনা জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের জন্যই জাপানের সেই চক্রান্ত ব্যর্থ হয়েছে।
ফেডোটোভ এই প্রসঙ্গে বলেছেন : চীনের জাপ বিরোধী যুদ্ধ জয়যুক্ত হওয়ার আগে সোভিয়েত ইউনিয়ান দূর প্রাচ্যে জাপানী বাহিনীর হুমকির সম্মুখীন হত।জাপান আত্মসমর্পনের পর সোভিয়েত-চীন সীমান্তের দুপাশের বাহিনী হয়েছে মিত্র বাহিনী । দুদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক ক্রমেই ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠে এবং নানাক্ষেত্রে পারস্পরিক উপকারিতামুলক সহযোগিতার সূত্রপাত ঘটে । চীনের জাপ বিরোধী যুদ্ধের বিজয়ের দরুন বিশ্ব পরিস্থিতির কাঠামোর পরিবর্তন ঘটেছে । প্রবীন যোদ্ধা হিসেবে আমরা উত্তর পূর্ব চীনে যে লড়াই করেছিলাম তার ঐতিহাসিক তাত্পর্য অক্ষুন্ন হয়ে থাকবে বলে আমরা মনে করি ।
|