ওয়েই হাই শহর পুর্ব চীনের সানতং প্রদেশের একটি উপকুলীয় শহর ।২০০৩সালে সুন্দর ওয়েই হাই শহর জাতিসংঘের আবাসিক পুরস্কার পেয়েছে । এই শহর দক্ষিণ কোরিয়া থেকে খুব দূরে নয় , স্পিডবোটে করে দক্ষিণ কোরিয়ার রেন চুয়ান বন্দরে পৌঁছতে মাত্র দু ঘন্টা লাগে । গত দশ বারো বছরে ওয়েই হাই শহরের গণ সরকার মনোরম আবাসিক পরিবেশ সৃষ্টি করে পুঁজি বিনিয়োগের পরিবেশের উন্নতি সাধনের যে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে তার আকর্ষনে দক্ষিণ কোরিয়ার বহু লোক এখানে কাজ করতে এসেছেন । মি: লিন ছিয়ান সিয়েক তাঁদের মধ্যে একজন । তিনি এখানে শিক্ষকতা করার সঙ্গে সঙ্গে তায়েকোন্দো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও চালাচ্ছেন । তাঁর স্ত্রী আর সন্তানও তাঁর সঙ্গে রয়েছেন ।
লিন ছিয়ান সিয়েকের বয়স চল্লিশের সামান্য বেশী । তিনি অত্যন্ত নম্র ও বিনয়ী । অতিথি পেয়ে তিনি প্রথমে আনত হয়ে কোরিয় ভাষায় বলেন " স্বাগতম " । তা শুনে অতি আপন বলে মনে হয় ।
লিন ছিয়ান সিয়েক সিউলের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চীনা ভাষা বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন । চীনা ভাষার উপরে তাঁর যথেষ্ট দখল রয়েছে। তিনি চীনের সংস্কৃতির উপরে গভীরভাবে গবেষনা চালিয়ে আসছেন ।
লিন ছিয়ান সিয়েক সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , তিনি তাঁর বড় ভাইয়ের সাহায্যে ওয়ে হাই শহরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ,এইজন্য তিনি বড় ভাইয়ের কাছে কৃতজ্ঞ । তাঁর বড় ভাই এক সময়ে ওয়ে হাই শহরে ব্যবসা করতেন , তিনি ওয়ে হাই শহরে বসবাস ও পুঁজি বিনিয়োগের পরিবেশের ভুয়সী প্রশংসা করেছেন । তাঁর বড় ভাইয়ের প্রস্তাব গ্রহণ করে লিন ছিয়ান সিয়েক গত বছরের গ্রীষ্মকালে ওয়ে হাই শহরে এসেছেন ।
তিনি বলেছেন , গত বছরে ওয়ে হাই শহরে এসে আমার মনে হল যে ,আমি যেন নিজের বাড়িতে ফিরে এসেছি । দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে এই শহরের কিছুটা সাদৃশ্য আছে , এখানকার হাওয়া স্নিগ্ধ ও আর্দ্র । স্থানীয় অধিবাসীরা দয়ালু ও বন্ধুভাবাপন্ন । আমি এখানে আনন্দের সঙ্গে দিন কাটাচ্ছি।
মি: লিন ছিয়ান সিয়েক ওয়ে হাই শহরের সিনসিং বিদেশী ভাষা ইন্সটিটিউটে কোরিয় ভাষা পড়াচ্ছেন । রোজ সকাল ন'টায় ক্লাস নিতে যান ।তাঁর ছাত্রছাত্রীরা বলেছেন ,তাঁর ক্লাস শোনা তাঁদের কাছে উপভোগের শামিল । তিনি মাঝে মাঝে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিচিত্র ভাষায় শব্দের অর্থ ব্যাখ্যা করেন। তাঁর মুখের ভাবলীলা ও অতিরঞ্জিত ভংগীমা দেখে ক্লাসরুমে হাসির তরঙ্গ ভেংগে পড়ে ।অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের মধুর সম্পর্ক গড়ে উঠেছে ।
ছাত্রী ছুই ছিং বলেছেন , ক্লাস করার সময়ে কোনো শব্দ আমরা বুঝতে না পারলে তিনি অঙ্গপ্রত্যঙ্গের ভাষায় সরসে ব্যাখ্যা করেন যাতে শব্দটির অর্থ আমাদের মনে থাকে ।ক্লাসরুমের পরিবেশ নিতান্তই প্রাণবন্ত ।
শিক্ষকতা ছাড়া মি: লিন ছিয়ান সিয়েক ওয়ে হাই শহরে তায়েকোন্দো প্রশিক্ষণ কেন্দ্রও চালাচ্ছেন । তিনি বলেছেন , মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রীড়া চর্চা করে দৃঢ় মনোবল লালন করা একান্ত দরকার । তায়েকোন্দো এমন এক ধরনের ক্রীড়াচর্চা যার সাহায্যে মানুষ শক্ত সমর্থ ও দৃঢ়চিত্ত হতে পারে ।
মি: লিন ছিয়ান সিয়েক বলেছেন , যে উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি তায়েকোন্দো
প্রশিক্ষণ কেন্দ্র চালাচছেন তা হলো এই যে , তাঁর ভাষায় যারা আমার প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন তাঁদের একজন ২০০৮ সালে পেইচিং ওলিম্পিক গেমসে তায়েকোন্দো বিভাগের স্বর্ণপদক বিজয় করবেন । এই উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য তিনি ওয়েহাই শহরে এসে প্রশিক্ষন দিতে দক্ষিণ কোরিয়ার পাঁচজন তায়েকোন্দো বিশেষজ্ঞকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন । মি: লিন ছিয়ান সিয়েকের প্রচেষ্টায় সানতং প্রদেশের ইয়ান থাই আর ওয়েফাং শহরেও তায়েকোন্দো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে ।
মি: লিন ছিয়ান সিয়েক তাঁর শিক্ষকতা-জীবনের দীর্ঘকালীন লক্ষ্য ধার্য করেছেন।তিনি বলেছেন , চীনারা যাতে অনায়াসে কোরিয়া ভাষা আয়ত্ত করতে পারেন তার জন্য আমি অধ্যয়নের একটি আধুনিক যন্ত্র আবিস্কারের চেষ্টা করছি ।
সি আর আইয়ের সংবাদদাতা মি: লিন ছিয়ান সিয়েকের বাড়িতে এই যন্ত্রের নমুনা দেখেছেন । এই যন্ত্র দেখতে ল্যাপটপ কম্পিউটারের মত । যন্ত্রটি খুলে বিশেষ পেন্সিল দিয়ে তার পেজ স্পর্শ করলে কোরিয় ভাষা ও ইংরাজী ভাষার শব্দ উচ্চারিত হয় ।
মি: লিন ছিয়ান সিয়েক ও তাঁর চার বছর বয়সী মেয়ে আর এক বছর বয়সী ছেলের দেখাশোনা করেন তাঁর স্ত্রী ইয়ুন মি কেং । ইয়ুন মি কেং শান্ত ,ভদ্র । কন্ঠস্বর শ্রুতিমধুর কথা বলার সময়ে মুখে লেগে আছে মৃদু হাসি । তিনি রোজ ওয়েহাই শহরের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে চীনা ভাষা শিখতে যান । বাড়ি ফিরে শোবার ঘর ও বসার ঘর পরিস্কার করেন । সন্ধ্যায় সুস্বাদু খাবার তৈরী করে তিনি দুটো বাচ্চাকে আদর করতে করতে স্বামীর জন্য অপেক্ষা করেন ।
মি: লিন ছিয়ান সিয়েক বলেছেন , প্রতিদিন বাইরে কাজ করে খুবই ক্লান্ত তিনি । তবে বাড়ি ফিরে স্ত্রী ও সন্তানদের দেখা মাত্র মনটা তাঁর হালকা হয়ে যায় । তাঁর স্ত্রীর হাত ধরে তিনি তাঁর জন্মভুমির একটি গান গেয়েছেন ।
একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী ওয়েহাই শহরে দক্ষিণ কোরিয়ার পুঁজি বিনিয়েজিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা তিন হাজারেরও বেশী । মি: লিন ছিয়ান সিয়েকের মত ওয়েহাই শহরে বসবাসকারী দক্ষিণ কোরিয়দের সংখ্যা প্রায় দশ হাজার । তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ পুঁজি বিনিয়োগ করে ব্যবসা করছেন, কেউ কেউ দুদেশের সংস্কৃতির গবেষনা ও প্রচারের কাজে নিয়োজিত , কেউ কেউ বা নিছক ওয়ে হাইয়ের বিরল আরামদায়ক আবাসিক পরিবেশ উপভোগের জন্য স্থায়ীভাবে এখানে বাস করছেন।
|