চীনের ইতিহাসে পানচেন লামাদের বাসস্থান হিসেবে এই মন্দির পরিদর্শনের জন্য বহু ধর্মাবলম্বী আসেন । কিছু দিন আগে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মতো একই অনুগত মনোবল পোষণ করে সংবাদদাতা ইটখাজে শহরের দক্ষিণাংশের নিমা পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত তাহিলংপো মন্দিরে গিয়েছিলেন ।
সেদিন যখন সংবাদদাতা তাহিলংপো মন্দিরে সাক্ষাত্কার নিতে গেলেন , তখন বৃষ্টি পড়ছিল । সেদিন ছিল রবিবার , মন্দিরে লামারা ছুটি কাটাচ্ছিলেন , এখানে আসা ধর্মাবলম্বীদের ভীড়ও কম ছিল । মন্দিরের এই দুর্লভ শান্ত পরিবেশ সংবাদদাতাকে এমন একটি সুযোগ দিয়েছে , যার মাধ্যমে সংবাদদাতা বিস্তারিতভাবে পাহাড়ের পাদদেশে নির্মিত তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের এই মহান স্থাপত্য উপভোগ করেছেন ।
১৪৪৭ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম দালাই লামার পরিচালনায় তাহিলংপো মন্দির নির্মিত হয় । তার পর এটা পানচেন লামাদের বাসস্থানে পরিনত হয়েছে । এখন মন্দিরে পঞ্চম থেকে নবম পানচেন লামার স্মৃতির উদ্দেশ্যে প্যাগোডা আর ভবন নির্মিত হয়েছে । এটা তিব্বতের দক্ষিণাংশের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্রে পরিনত হয়েছে । মন্দিরের সামনের বিশাল মহাচত্বর থেকে মন্দিরটি সম্পূর্ণভাবে দেখা যায় । তাহিলংপো মন্দিরের কাঠামো খুবই সুশৃংখল । নীচের দিকে সাদা রংয়ের তিব্বতী অধিবাসীদের বাড়িঘরে মন্দিরের লামাদের বাসস্থান। উপর দিক লাল রংয়ের বুদ্ধ ভবন ও প্যাগোডা । সর্বোচ্চ স্থান তো সোনালী টালী ভবন । দূর থেকে উঁচু সোনালী ছাদ দেখা যায় । সোনালী আলো মন্দিরের সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছে ।
বৃষ্টি পড়ায় সংবাদদাতার কিছুটা ঠান্ডা লাগল । কিন্তু তাতে সংবাদদাতার তাহিলংপো মন্দিরের রহস্য অনুসন্ধানের কৌতুহল কমে নি । পাথুরে পথ বেয়ে সংবাদদাতা তাহিলংপো মন্দিরের বৃহত্তম মন্দিরের বৃহত্তম বৌদ্ধ ভবন--ছামবা ভবনে গেলেন । ওখানে বিশ্বের বৃহত্তম ছাম্বা বুদ্ধ মূর্তি উপাসনা করা হয় । চীনের অভ্যন্তরস্থলে ছামবা বুদ্ধকে মৈত্রেয়াবুদ্ধও বলে । বৌদ্ধ ধর্মে এটা বিশ্বের ভবিষ্যত পরিচালনা করে । লামা লুসানদাওয়া বলেছেন ,
এই বুদ্ধ মূর্তি তৈরীর জন্য ২ লক্ষ ৩০ হাজার কিলোগ্রাম ব্রন্জ আর ৫ শো কিলোগ্রাম সোনা ব্যবহার করা হয়েছে । ৩০ মিটার উঁচু এই বুদ্ধ মূর্তি ১৯১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় । ছামবা বৌদ্ধ ভবনে উপাসনা করার জন্য বেশীর ভাগ ধর্মাবলম্বী সপরিবারে আসেন । তারা বুদ্ধ মূর্তির সামনে উপাসনা ছাড়া মাখন ল্যাম্পের জন্য মাখনও উপহার দেন । বুদ্ধ মূর্তির সামনে মোট সাতটি মাখন ল্যাম্প আছে । দুজন লামা মাখন ল্যাম্পের ভিতরে মাখন দেয়ার দায়িত্ব পালন করেন । তাদের ব্যস্ততা দেখে সংবাদদাতা ভবনের গুরু-গম্ভীর ধর্মীয় পরিবেশের জন্য মুগ্ধ হয়েছেন ।
ছামবা বৌদ্ধ ভবন ছেড়ে সংবাদদাতা পঞ্চম পানচেন লামার প্যাগোডা ভবনে পরিদর্শন করতে গেলেন । এই প্যাগোডা ভবনে যাওয়ার জন্য একটি সংকীর্ণ আর খাড়া কাঠের সিড়ি অতিক্রম করা প্রয়োজন । সিড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসার পর একটি ছোট প্রাঙ্গন আছে । তার সামনেই পঞ্চম পানচেন লামার প্যাগোডা । এর দুপাশে একটি বারান্দা আছে । বড় ভবনের দরজার সামনের বারান্দার উপরে একটি ব্রোন্জেরঘন্টা টাঙ্গানো হয় । পর্যটকরা হাতে এই ঘন্টা আন্দোলিত করলে ঢংঢং ঘন্টাধ্বনি শোনা যায় । ঘন্টাধ্বনি এই ছোট প্রাঙ্গনে বেজে উঠলো । টিপ টিপ বৃষ্টিধ্বনির সংগে সংগে মন্দির আরো শান্ত আর রহস্যময় হয়ে উঠলো । সংবাদদাতা পঞ্চম পানচেন লামার প্যাগোডা ভবনে এসে দেখলেন , ভবনে বিরাটাকারের স্বর্ণ প্যাগোডা আছে । প্যাগোডার উপরে বসানো হয়েছে না না রকমের মুক্তা । ভবনের চার দিকের দেয়ালে তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্মের চিত্র টাঙ্গানো হয় । ধর্মাবলম্বীরা প্যাগোডার সামনে অনুগতভাবে উপাসনা করলেন ।
সংবাদদাতা মন্দিরের পুরাকীর্তি সুরক্ষা বিভাগের তোজিছিরেনের সাক্ষাত্কার নিয়েছেন । তাঁর বয়স ষাটের কাছাকাছি , দেখতে সুশিক্ষিত । তার পরনে একটি কাষায় , পিঠে কুঁজের মতো আছে , কেশ পক্ক হয়েছে , ভদ্রতা বেশী । তিনি সংবাদদাতাকে শুভেচ্ছা জানালেন , এবং চেয়ারে বসতে দিলেন , তিনি মন্দিরের পুরাকীর্তি সুরক্ষা সম্বন্ধে আমাকে বর্ননা করলেন ।
১৯৬১ সালে তাহিলংপো মন্দির দেশের পুরাকীর্তি সুরক্ষা সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ ইউনিট বলে ধার্য করা হয়েছে । মন্দিরে বিপুল পরিমান মূল্যবান পুরাকীর্তি সংরক্ষিত রয়েছে । গত কয়েক বছরে মন্দিরে মেরামত আর মজবুত করার কাজ চালাবার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার প্রতি বছর অর্থ বরাদ্দ করে । কিছু মূল্যবান পুরাকীর্তি আর বাড়িঘর ভাল অবস্থায় সংরক্ষিত রয়েছে ।
পঞ্চম পানচেন লামার প্যাগোডা ভবনের সামনে বসে সংবাদদাতা বৃষ্টিতে টং টং ঘন্টাধ্বনি শুনলেন । ভবনের দেয়ালের চিত্র আর এই প্রবীণ লামাকে দেখে সংবাদদাতা এক ধরনের ভীষণ শান্তি বোধ করলেন । এই শান্ত অনুভূতির জন্য সংবাদদাতা এই জায়গা খুব পছন্দ করলেন । সামনের প্যাগোডা , দেয়াল চিত্র , ঘন্টাধ্বনি , বৃষ্টিধ্বনি , ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ আর মাখন ল্যাম্পের সুগন্ধে সংবাদদাতা আত্মহারা হয়েছেন । কাষায় পরা এই সব লামাকে সংবাদদাতার ভাল লেগেছে । তিনি বিশ্বাস করেন , তাহিলংপো মন্দির পরিদর্শনে আসা বহু পর্যটক সংবাদদাতার মতো মন্দিরের রহস্যময় ও গভীর ধর্মীয় পরিবেশের জন্য মুগ্ধ হয়েছেন ।
আমি এখানে আসার পর তিব্বত বিষয়ক অনেক তথ্য পেয়েছি। আমি মনে করি , চীন সরকার তিব্বতের আঞ্চলিক সংস্কৃতি ভালভাবে সংরক্ষণ করেছে । এই মন্দিরের বাড়িঘর ভাল অবস্থায় সংরক্ষিত আছে । তিব্বতী জাতির বহু ঐতিহ্যিক রীতিনীতি এখনো সংরক্ষিত রয়েছে । স্থানীয় লোকেরা যা যা ভাবেন , তা করতে পারেন । তোজেছিরেন লামা সংবাদদাতাকে মহাচত্বর পর্যন্তএসে বিদায় জানালেন । তখন বৃষ্টি থেমেছে । তোচেছিরেনের ছায়া ধীরে ধীরে মন্দিরের ভবনের পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল । সংবাদদাতার কানে আবারও টিপ টিপ বৃষ্টিধ্বনি শোনা যাচ্ছিল । মনের শান্তি আর বুদ্ধের প্রতি আনুগত্য সংবাদদাতা কোনদিনই ভুলে যাবেন না ।
|