চীনে ৫৫টি সংখ্যালঘু জাতি আছে।তাদের বৈচিত্রময় রীতিনীতি, সরল প্রকৃতি এবং আতিথেয়তা খুবই প্রশংসনীয়।সংস্কার ও উন্মুক্ত নীতি এগিয়ে চলার সংগে সংগে বর্তমানে অনেক সংখ্যালঘু জাতি অধ্যুষিত এলাকা পর্যটন আকর্ষণে পরিণত হয়েছে। যার ফলে তাদের জীবনযাপনে বিরাট পরির্বতন ঘটেছে।তাদের জীবনের মানও উন্নত হয়েছে।সম্প্রতি চীন আন্তর্জাতিক বেতারের নিজস্ব সংবাদদাতা চীনের ইয়ুন্নান প্রদেশের হানি জাতি অধ্যুষিত একটি ছোট গ্রামে গিয়েছেন। সেখানে তিনি স্বচক্ষে হানি জাতি এলাকার পরিবর্তন দেখেছেন। এখানে উল্লেখ্য, চীনের সংখ্যালঘু জাতির বিচিত্রদৃক দুনিয়ায় তার লেখা রিপোর্টটি একটি দৃষ্টিক্ষেপ মাত্র।
হানি জাতি প্রধানত চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের ইয়ুন্নান প্রদেশে বাস করে।চীনের ৫৫টি সংখ্যালঘু জাতির মধ্যে হানি জাতি একটি অপেক্ষাকৃত বড় জাতি যার লোকসংখ্যা ১২ লক্ষ ৫০ হাজার। আমাদের সংবাদদাতা যে গ্রামে গিয়েছেন তার নাম হলো মুদেন গ্রাম।ষাটের বেশী পরিবার নিয়ে এই গ্রাম।ছোট হলেও এই গ্রাম এখন একটি পর্যটন-আর্কষণ হয়েছে।প্রত্যেক বছর এই গ্রামে অনেক পর্যটককে স্বাগত জানানো হয়।
আমাদের নিজস্ব সংবাদদাতা গ্রামে প্রবেশ করার বাগে, গ্রামের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তরুণ- তরুণীরা গান গেয়ে গ্রামে প্রবেশ করার পথে দুই পাশে দাঁড়িয়ে অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানোর অপেক্ষায় রয়েছেন।তাদের গাওয়া গানের কোনো শব্দের অর্থই বুঝা যায় না বটে।কিন্তু তা সত্বেও বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের হাসি মুখ এবং যুবক-যুবতীদের উঁচু গলার গানে হানি জাতির উষ্ণতা পুরোপুরি প্রতিফলিত হয়েছে।এ ধরনের দৃশ্য দেখে মানুষ মুগ্ধ না হয়ে পারে না।
সংবাদদাতাকে অর্ভ্যথনা জানানোর জন্য এই গ্রামের প্রধান জেন দে ল্যাণ দ্রুত পায়ে সংবাদদাতার কাছে গেলেন।তার গায়ের পোশাক দেখে সংবাদদাতা একটু অবাক হয়ে গেলেন।তার মাথায় গাছের ছালের টুপি, গায়ে বল্কলের কাপড় এবং কোমরে বাধানো একটি পাতের দড়ি।মনে হয় তিনি এই মাত্র পাহাড়ে শিকারের কাজ শেষ করে ফিরে এসেছন।তিনি কি ইচ্ছে করেই সংবাদদাতার সামনে জাহির করতে চান যে অতীতে এই জাতি শিকারের উপর নির্ভর করে জীবনযাপন করতেন? এই গ্রামে যাওয়ার আগে সংবাদদাতা জানতে পেয়েছেন , এই গ্রামের লোকেরা বেশির ভাগ সমুদ্র-সমতলের তুলনায় ১০০০ মিটার থেকে ২৫০০ মিটার উচু জায়গায় বাস করে ।অতীতে তারা সত্যিই পাহাড়ে শিকারের উপর নির্ভর করে জীবনযাপন করতেন।কিন্তু এখন তারা প্রধানত কৃষির উপর নির্ভর করে থাকেন। গ্রামের চার দিকে পাহাড়ের ক্ষেতখামারগুলো দেখলে বুঝা যায়। নানা ধরনের ফল গাছ, বাশ এবং রাবার গাছ নজরে পড়ে।
চার দিকে ঘুরে ঘুরে দেখছিলেন দেখে গ্রামের প্রধান জেন আমাকে এই গ্রাম সন্বন্ধে ব্যাখা করে বললেন:
আমাদের গ্রামে মোট ৭৪টি পরিবার আছে।লোক সংখ্যা ৩৭০।রাবার চাষ করে আমরা উপার্জন করে থাকি।অতীতে আমরা গাছপালা কেটে কেটে শস্য চাষ করতাম।১৯৯৬ সালের পর আবাদী জমি বণভূমিতে রুপান্তরিত হয়েছে।এখন আমরা প্রধানত রাবার চাষ করে জীবনযাপন করে থাকি।আমাদের বাড়িঘর পূর্ণনিমিত হয়েছে।অতীতে আমরা বাশের তৈরী ছোট ছোট ঘরে থাকতাম।আপনি যেসব বাড়ীঘর দেখতে পেয়েছেন সেসব তৃতীয় প্রসম্মের বাড়ীঘর বলে মনে করা হয়।এখন ঘরের নীচে হাসমুরগী চাষ করা হয় এবং উপরে মানুষ থাকার জায়গা।
এই গ্রামের একটি মাত্র পাকা সড়কের দু পাশে গ্রামবাসীদের ঘন বসতি চোখে পড়ে।ঠিক গ্রামের প্রধানের ব্যাখ্যার মত গ্রামবাসীরা দু তলার বাশের তৈরী ঘরে বাস করেন।তাদের বাড়ীঘরের চার পাশে বাশ আর রাবারের বাগান। বুঝা যায় তারা এখন খুব শান্তপূর্ণ জীবনযাপন করছেন।মাঝে মাঝে হানি জাতির মহিলাদের জন্তু তাড়ানোর শব্দ শোনা যায়্। শুনতে ঠিক গানের মতো। গ্রামের প্রধান জেন সংবাদাতাকে বললেন, এখন নারীরা হচ্ছে এই গ্রামের প্রধান শ্রমশক্তি।অধিকাংশ পরিবারের পুরুষরা শহরে চাকরি খুজতে গেছেন।পরিবারের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের দেখাশুনা করা,সাংসারিক কাজ এবং চাষ করার দায়িত্ব মহিলাদের উপর ন্যস্ত হয়।তবে হানি জাতির মহিলা খুব পরিশ্রমী।তাদের গাযে পরা পোশাক সবই তাদের নিজ হাতের তৈরী।
লাওমুদেন প্রাথমিক ইস্কুল হলো এই গ্রামের একমাত্র ইস্কুল। এই গ্রামের ছেলে-মেয়েদেরকে তাদের তৃতীয় শ্রেণীর পড়া শেষ হয়ার পর উপরের ক্লাসে পড়তে চাইলে অন্য একটি গ্রামে যেতে হবে।এই ইস্কুলের মাষ্টার আর শিক্ষক জেন চিই চিয়েনের শিক্ষাগত যোগ্যতা এ গ্রামবাসীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশী ।তিনি বলেছেন, তিনি এই স্কুলে ২০ বছর শিক্ষাদান করেছেন।অতীতে তার ছাত্রছাত্রীরা তার কাছে এই গ্রামের বাইরের গল্প শুনতে পছন্দ করতো।কারণ তারা বহিবিশ্ব সম্বন্ধে জানতে আগ্রহী।কিন্তু এখন তারা তাকে বহিবিশ্ব সম্বন্ধে গল্প বলতে আর পিড়াপিড়ি করে না। কারণ সম্প্রতি অধিক থেকে অধিকতর পর্যটক এই গ্রাম দেখতে আসছেন। তারা এখন গ্রামের নিয়মিত অতিথি হয়েছে।তিনি বলেছেন,
অতীতে বাইরের লোক এখানে আসতো না, পর্যটক তো আরো দুরের কথা।তবে পর্যটন শিল্প শুরু হবার পর এখানের গ্রামবাসীদের জীবন দিন দিন উন্নত হচ্ছে।এই অন্চল রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের প্রাকৃতিক সংরক্ষণ অন্চল।এই অন্চলে হরিণ,বাঘ প্রভৃতি অনেক প্রাণী আছে।এ কথাও বলা যায় যে ,এখন গ্রামটি ধাপে ধাপে একটি পর্যটন গ্রামে পরিণত হয়েছে। পর্যটকরা ওখানে গেলে হানি জাতির প্রকৃত রীতিনীতি দেখতে পারেন।
কিন্তু এই ছোট ছোট গ্রাম আধুনিকতার দিকে এগিয়ে যাবার সংগে সংগে এখানকার ঐতিহ্যিক বিষয়গুলোও আপনাআপনি আরো মূল্যবান হয়ে দাঁড়িয়েছে।যেমন ধরুণ , শিকারী পোষাক পরা গ্রাম-প্রধান এখন পর্যটকদের ছবি তোলার সবচেয়ে সন্তোষজনক পাত্র।যখন আমাদের সংবাদদাতা গ্রাম প্রধানের সংগে ছবি তুলতে ইচ্ছা প্রকাশ করেন ,তখন তিনি হাসতে হাসতে সংবাদদাতাকে হাত ধরে নিয়ে গেলেন। ব্যাপারটা সম্পূর্ণভাবে বুঝে ওঠার আগে তাকে গ্রাম প্রধানের বাড়িতে নেয়া হল।তিনি সংবাদদাতাকে বললেন, তার সংগে ছবি তুলতে চাইলে তার বাড়িতে যেতে হবে , কারণ তার বাড়িতে গেলে হানি জাতির জীবনযাত্রার মানের একটি লক্ষণ জানা যায়। গ্রাম প্রধানের বাড়িতে ছবি তোলার পর সংবাদদাতা পুরোপুরি বুঝতে পেরেছেন এই ছোট গ্রাম পর্যটকদের আর্কষণ করার কারণ কি ।হানি জাতির ঐতিহ্যিক রীতিনীতি , জীবনযাপনের রুপ, এমনকি এই সংখ্যালঘু জাতির ইতিহাস সর্ম্পকিত জ্ঞানও এই ছোট গ্রামে সহজেই পাওয়া যায়।
এই গ্রাম থেকে বিদায় নেয়ার আগে রাস্তায় কয়েক জন ইস্কুল থেকে বাসায় ফিরে আসা ছাত্রছাত্রীর সংগে আমাদের সংবাদদাতার দেখা হয়েছেন।সংবাদদাতা তার নিজের ব্যাগ থেকে কয়েকটি পেনসিল বের করে উপহার হিসেবে তাদেরকে দিলেন। এই উপহার পেয়ে তারা খুব খুশী। শ্রোতা বন্ধুরা, অবাক লাগে যে, বড় পাহাড়ের বাইরে যে বিচিত্র জগত কি রকম তা সম্বন্ধে জানতে এই গ্রামের ছেলেমেযেরা খুবই আগ্রহী।ইতিমধ্যে যারা সব সময় বড় শহরে থাকে তারা কি এই বড় পাহাড়ের জগত দেখতে চায় না?
|