মধ্য চীনের হোনান প্রদেশের রাজধানী চেনচৌ শহরের উপকন্ঠে সুং চেই নামে একটি গ্রাম আছে । গ্রামে প্রবেশ করলে চোখে পড়ল সারি সারি পরিপাটি বাড়িঘর আর মনোরম অট্টালিকা । সবুজ তৃণাবৃত ভূমিতে আনন্দিত আধিবাসীরা হাঁটাহাটি করছেন । এই আবাসিক এলাকা দেখে নিখুঁত শহুরে দৃশ্য মনে করা হয় । কিন্তু আপনারা হয়তো কখনো ভাবেন নি যে , এই গ্রাম এক সময় নোংরা , বিশৃংখল আর দরিদ্র একটি গ্রাম বলে পরিচিত হতো । এই গ্রামে যে এত ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে , তার মূলে রয়েছে সুং ফুং নিয়েন নামে এই গ্রামের প্রধানের সুব্যবস্থাপনা ।
৫৭ বছর বয়স্ক মিঃ সুং ফুং নিয়েন সুং চেই গ্রামের একজন অধিবাসী । তিনি পাশ্চাত্য পোষাক পরা আর লিপিকলা পছন্দ করেন । তার কাছ থেকে কৃষকের ছায়া মোটেই পাওয়া যাচ্ছে না । তিনি সংবাদদাতাকে সাক্ষাত্কার দেয়ার আগে বলেছেন , চীনের জাতীয় গন কংগ্রোসের এবারকার বার্ষিক অধিবেশনে তিনি দারিদ্র্য বিমোচনের নতুন পদ্ধতি বিষয়ক একটি প্রস্তাব উপস্থাপনা করেছেন ।
তার এই প্রস্তাব অনুযায়ী , আগেকার ঐতিহ্যিক দারিদ্র্য বিমোচনের পদ্ধতির একটু পরিবর্তন হবে । আগে দারিদ্র্য বিমোচনের জন্য শুধু সরকারের শক্তির উপর নির্ভর করা হতো । এমন ঐতিহ্যিক দারিদ্র্য বিমোচন শুধু এক ধরণের অস্থায়ী ব্যবস্থা বলে ব্যবহার করা যেতো । আসলে একটি অঞ্চলকে সাহায্য করার জন্য তার নিজের পরিবেশ আর নানা শর্তের মাধ্যমে উন্নয়ন বাস্তবায়িত করা আর নিজের বাধা-বিঘ্ন কাটিয়ে উঠা উচিত । যেমন সরকারের সাহায্যে সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে , পরিবেশ উন্নত হয়েছে , কিন্তু পরে আপনাদের অঞ্চলের যে কেমন করে দারিদ্র্য বিমোচন করা হবে , সে সম্বন্ধে আপনাদের নিজের পরিশ্রম আ প্রচেষ্টার উপর নির্ভর করা যাবে । এটাই সত্যি দারিদ্র্য বিমোচনই । সুতরাং দারিদ্র্য বিমোচন আর ত্রাণমূলক ব্যবস্থা এই দুটোকে আলাদা করা দরকার ।
চীনের জাতীয় কংগ্রেসের অধাবেশনের কাছে তিনি যে এই প্রস্তাব পেশ করেছেন , তার মূল যুক্তি হলঃ তার পরিচালনায় সুং চেই গ্রামের যে দারিদ্র্য বিমোচন করা হয়েছে , তাতে তিনি ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতা পেয়েছেন । চেন চৌ শহরের উপকন্ঠের একটি গ্রাম হিসেবে সুং চেইয়ের দারিদ্র্য খুব পরিচিত ছিল । কৃষকরা বংশপরম্পরায় কৃষি জমিতে কাজ করেন । তাদের সরকারের ত্রাণের উপর নির্ভর করা প্রয়োজন ।
গত শতাব্দির আশির দশকের প্রথম দিক থেকে গ্রামের প্রধান হিসেবে সুং ফুং নিয়েনের পরিচালনায় গ্রামবাসীরা আয় করার পথ অন্বেষণ করতে শুরু করেন । চীনের সংস্কার আর উমুক্ততা প্রবর্তনের কল্যাণে সুং ফুং নিয়েন আর গ্রামবাসীরা শহরের বাজার লক্ষ্য করে জমিতে বিদেশী আংগুর প্রভৃতি উন্নত মানের ফল বপন করতে শুরু করেন । তিনি ট্রাক কিনে কাঠ পরিবহনের ব্যবসা করেন , শহরবাসীদের জন্য আসবাব পত্র বানান , প্যান্ট কারখানা গড়ে তুলেন এবং গ্রামে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য তিনি আর গ্রামবাসীরা শহরের শিল্প প্রতিষ্ঠানকে গ্রামের আংশিক জমি ভাড়া দেন । দেশের অর্থনীতির উন্নয়নের সংগে সংগে সুং চেই গ্রামের ব্যবসা অধিক থেকে অধিকতর ভাল হয়ে উঠেছে । গ্রামবাসীদের জীবনযাপনও ক্রমাগত সুখী হয়ে উঠেছে । এখন শহরের মেয়েরা এই গ্রামের তরুণদের সংগে বিয়ে করতে ইচ্ছুক ।
মিঃ সুং ফুং নিয়েন সংবাদদাতাকে বলেছেন , এখন সুং চেই গ্রামে মাথা পিছু গড়পড়তা বার্ষিকআয় ৬ হাজার ইউয়ানে দাঁড়িয়েছে । জমি ছাড়া স্থাবর পুঁজি ১ বিলিয়ন ইউয়ান ছাড়িয়ে গেছে । অনেক লোক এই গ্রামে আসতে চান ।
গ্রামবাসীদের জীবনযাপনের মান অনেক উন্নত হয়েছে । আগে আমাদের গ্রামে শুধু ছ'শোরও একটু বেশি কৃষি লোকসংখ্যা ছিল । এখন চাকরি করার জন্য বাইরে থেকে আসা লোকদের সংখ্যা ৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে ।
গ্রামবাসীরা ধনী হয়েছে । সুং ফুং নিয়েনের পরিচালনায় তারা নতুন বাড়িঘন নির্মাণ করতে আর গাছ লাগাতে শুরু করেন । তারা মোট ৭ শোটিরও বেশি ফ্ল্যাটবিশিষ্ট গ্রামবাসীদের ১৯টি অট্টলিকা নির্মাণ করেছেন । তাদের বাড়িঘরে হিটিং ব্যবস্থা , টেলিফোন আর ক্যাবল্ টিভি বসানো হয়েছে । আবাসিক এলাকায় স্কুল , কিন্ডারগার্টেন , দোকান , হাসপাতাল , ক্লাব প্রভৃতি ব্যবস্থা আছে । মিঃ সুং ফুং নিয়েন বলেছেন , গত কয়েক বছরে বাস্তব অনুশীলনের মাধ্যমে তিনি এই অভিজ্ঞতা পেয়েছেন যে , দরিদ্র অঞ্চল বিকশিত করতে চাইলে শুধু সরকারের ত্রাণের উপর নির্ভর করা যাবে না , বরং নিজের শক্তির উপর নির্ভর করে দারিদ্র্য বিমোচনের পথ অন্বেষণ করতে হবে ।
মিঃ সুং সংবাদদাতাকে বলেছেন , গত কয়েক বছরে সুং চেই গ্রাম ধনী হবার সংগে সংগে তার বহু উপকারও হয়েছে । গ্রামবাসীরা তাকে পরিবার পরিজন বলে মনে করেন । এতে তার কাজের আগ্রহ অনেক বেড়েছে । এক বছর তিনি বাতজনিত হৃদরোগে আক্রান্ত হন । অস্ত্রোপচার করার জন্য তার টাকা-পয়সার অভাব ছিল । এই খবর জেনে গ্রামবাসীরা ডিম ও খাদ্য বিক্রি করে যে আয় করেন , তা দিয়ে তারা তাকে সাহায্য করেন ।
১৯৯৮ সালে মিঃ সুং ফুং নিয়েন চীনের নবম জাতীয় গণ কংগ্রেসের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন । তিনি মনে করেন যে , তিনি যা যা করেছেন , কংগ্রেসের একজন প্রতিনিধি হিসেবে তার বেশি ব্যবধান আছে । সুতরাং প্রতিনিধি হিসেবে তিনি নিয়মিত প্রশাসনিক কাজ করেন । তা ছাড়া জনসাধারণের যত্ন নেয়ার জন্য তিনি অবসরে বাড়িতে বাড়িতে যান । জনসাধারণ যে সব মতামত ও প্রশ্ন উথ্থাপন করেন , তিনি তা সব কিছু সুব্যবস্থা করেন ।
কৃষকদের বাচ্চাদের লেখাপড়ার উপর তিনি খুব মনোযোগ দেন । সেজন্য তিনি বহু উত্সাহ ও পুরস্কারমূলক ব্যবস্থা প্রণয়ন করেছেন ।
আমাদের গ্রামে যে লোক বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন , তাকে ১০ হাজার ইউয়ান পুরস্কার দেয়া হয় । চীনে এখন ন'বছরব্যাপী বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তিত হয় । কিন্তু আমাদের গ্রামে প্রাথমিক স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্কুল পর্যন্ত ১২ বছরব্যাপী বাধ্যতামূলক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করা হয় ।
সুং ফুং নিয়েন বলেছেন , কৃষকদের প্রচেষ্টা ছাড়া গ্রামাঞ্চলের উন্নয়ন অসম্ভব। জাতীয় গণ কংগ্রেসের একজন কৃষক প্রতিনিধি হিসেবে তাকে ব্যাপকভাবে কৃষকদের মতামত শ্রবণ করতে হবে ।
|