"পৃথিবীর ছাদ" বলে পরিচিত চীনের তিব্বত স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চলে বিস্ময়কর আর আশ্চর্যজনক প্রাকৃতিক পরিবেশ আছে । ওখানে সারা বছর তুষারাবৃত সারি পর্বত, মালভূমিতে অজস্র হ্রদ , লাল লম্বা পোষাক পরা লামা , মন্দির , মন্দিরের ধর্মীয় পতাকা আর রহস্যময় তিব্বতী বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ক কাহিনী প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক দেশী-বিদেশী পর্যটকদের আকৃষ্ট করে থাকে ।
যারা তিব্বত ভ্রমণে আসেন , তাদের সংগে গাইড ছাড়াও সহস্রাধিক চালক সবচেয়ে বেশি মেলা-মেশা করেন । তেনচেন তাদের মধ্যে এমন একজন , যিনি শ্রেষ্ঠ পরিসেবার জন্য সকল অতিথির প্রশংসা পেয়েছেন ।
তিব্বতের লিন চি আর শান নানে সাক্ষাত্কার নিতে যাওয়ার পথে তেনচেন সংবাদদাতাদের সংগে কথা বেশি বলেন নি । তার বয়স ৩৩ বছর , কিন্তু তার গাড়ি চালানোর বয়স দশ-বারো বছর হয়েছে । হয়তো পেশার কারণে তাকে দেখে তার আসল বয়সের চেয়ে বয়স্ক মনে হয়। গাড়ি চালানো ছাড়াও তিনি সংবাদদাতাদের জন্য গাইড আর দোভাষীর কাজও করেছেন । তিনি সংবাদদাতাদের জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার কাজেও সাহায্য করেছেন ।
যখন সংবাদদাতারা তার গাড়ির প্রসঙ্গে কথাবার্তা বললেন , তখন তিনি বলেছেন , তার এই গাড়ি সুইজারল্যান্ডের একজন অতিথি উপহার দিয়েছেন । কথাটা শুনে সংবাদদাতা খুব অবাক হয়েছেন । প্রথমে তেনচেন এ প্রসংগে বেশি বলতে অস্বীকার করলেন । সংবাদদাতা বারংবার জিজ্ঞাসা করায় তিনি সুইজারল্যান্ডের এই অতিথির সংগে তার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে বলতে শুরু করলেন ।
তেনচেন পর্যটন বিভাগে চালকের চাকরি করতেন । তখন তার আয় বেশি ছিল না । তিনি দু' বছর আগে পর্যটক আনার জন্য একটা গাড়ি কেনার কথা বিবেচনা করেছেন । কিন্তু গাড়ি কেনার পর্যাপ্ত টাকা-পয়সা ছিল না । তিনি লটারী কিনতে পছন্দ করতেন । আশা করতেন , ভাগ্য লক্ষ্মী তার প্রতি প্রসন্ন হবে । তবে সৌভাগ্যের সঙ্গে তার কখনো সাক্ষাত ঘটে নি ।
গত বছরের জুলাই মাসে তেনচেন আর অন্য দু'জন চালক সুইজারল্যান্ডের একটি পর্যটক দলকে নিয়ে তিব্বতের মধ্য আর দক্ষিণাংশে এক মাস ধরে ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন । ভ্রমণ শেষে এই দলের প্রধান- একজন প্রৌঢ় নারী তাকে ১০ হাজার ইউয়ান উপহার দিয়েছেন । গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে পর্যটন বিভাগ তাকে সুইজারল্যান্ডের আরেকটি দলকে স্বাগত জানানোর দায়িত্ব দিয়েছে। অতিথিরা বিশেষ করে তাকে গাড়ি চালাতে অনুরোধ করেছেন । আসলে জুলাই মাসে তিব্বত ভ্রমণে আসা সুইজারল্যান্ডের সেই দলটির প্রধান আবারও একটি দল নিয়ে এসেছেন । তারা তিব্বতে এক মাস ধরে ঘুরে ঘুরে বেড়াবেন । তেনচেন কখনো ভাবেন নি যে , এই এক মাসে তিনি ও তার পরিবারের ভাগ্য বদলে যাবে ।
ভ্রমণের পথে সুইস পর্যটক দলের এই নেত্রী তেনচেনের গাড়ি কেনার ইচ্ছা জানতে পেরেছেন । তিনি তেনচেনকে জানিয়েছেন , ভ্রমণ শেষে তিনি তাকে একটি গাড়ি উপহার দেবেন । তখন তেনচেন তার কথা মোটেই বিশ্বাস করেন নি। কিন্তু যখন তারা লাসায় ফিরে আসলেন , তখন দলের নেত্রী তাকে জানালেন , পরের দিন তিনি তেনচেনকে একটি গাড়ি কিনে দেবেন । পরের দিন নেত্রী তেনচেনকে সত্যি ১ লাখ ৭০ হাজার ইউয়েন মূল্যের একটি পুরানো গাড়ি কিনে উপহার দিলেন । তেনচেন গাড়িটি চালিয়ে বাড়ি ফিরে এলেন । তিনি যেন স্বপ্নে দেখেছেন বলে মনে করলেন । তিনি তা স্মরণ করে বলেছেন ,
আমি তখন একদম বিশ্বাস করি নি। আমার স্ত্রীও বিশ্বাস করেন নি। তিনি বলেছেন , ভূতুড়ে ব্যাপার! পর্যটকরা কেন আমাদের গাড়ি উপহার দিয়েছেন ?
তখন থেকে তেনচেন নিজের গাড়ি চালিয়ে পর্যটকদের নিয়ে তিব্বতের যেখানে সেখানে ঘুরে ঘুরে বেড়ান । তিনি বছরে চল্লিশ- পঞ্চাশ হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত গাড়ি চালান । তিনি খুব পরিশ্রম করেন , কিন্তু তিনি বেশি আয়ও করেছেন । এবছরের জানুয়ারী মাসে সুইজারল্যান্ডের এই ভদ্রমহিলা টেলিফোন করে তাকে একটি নতুন গাড়ি চেঞ্জ করে দেয়ার কথা বলেছেন । তেনচেন তার আন্তরিকতার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন । কিন্তু এবার তিনি তার উপহার গ্রহণ করেন নি ।
তারা বলেছেন , তিনি খুব সত্ আর দয়ালু । তিনি কখনো তাদের এক পয়সারও বেশি চান নি । তিনি সব সময় দূরত্বের নিয়মবিধি অনুসারে অতিথিদের ফি চেয়েছেন ।
সুইজারল্যান্ডের অতিথিরা তেনচেনকে যে এত বেশি পছন্দ করেছেন , তার আরেকটি কারণ এই যে , তেনচেন একজন মাটির মানুষ । তিনি অতিথিদের জিনিসপত্র বহন করতেও সাহায্য করেন । তিনি নিজের তোয়ালে দিয়ে তাদের জিনিসপত্রের ধূলি মুছে দেন। তিনি খুব সযত্নে গাড়ি চালান । অতিথিরা স্বস্তি বোধ করেন ।
ভবিষ্যতের পরিকল্পনা প্রসংগে তেনচেন বলেছেন ,
আমার নিজের গাড়ি আছে । অতিথিদের ভালভাবে পরিসেবা দিতে হবে এবং এর সংগে সংগে আরো বেশি আয় করা যাবে । আশা করি , অভ্যন্তরস্থলে লেখাপড়ার জন্য সন্তানদের পাঠাবো । আমরাও এই সুযোগ ব্যবহার করে ওখানে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে পারবো । সুইজারল্যান্ড ভ্রমণে যেতে পারলে আমরা আমাদের সে সব অতিথির সংগেও দেখা করতে চাই ।
তেনচেন বলেছেন , আগামী বছর তিনি এই পুরানো গাড়ি বিক্রি করতে চান এবং অতিথিদের নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য একটি নতুন গাড়ি কেনার কথা বিবেচনা করছেন । যখন তার বয়স ৫৯ বছরেরও বেশি হবে , তখন তিনি লাসায় একটি চায়ের দোকান খুলবেন । কারণ দশ বারো বছর আগে স্ত্রীর সংগে তার পরিচয় হয়েছে তার স্ত্রীর চায়ের দোকানে । বছরে বেশির ভাগ সময় বাইরে ঘুরে ঘুরে বেড়ানোর দরুণ তিনি পরিবার-পরিজনের খুব কম যত্ন নিয়েছেন । এখন তার স্ত্রী চাকরি করেন না , বাসায় সন্তানকে দেখাশুনা করেন । তিনি সংবাদদাতার জন্য টানা ২০ দিন গাড়ি চালিয়েছেন। কিন্তু তিনি প্রতিদিনই মোবাইল ফোনে বার্তা পাঠানোর মাধ্যমে স্ত্রীর সংগে যোগাযোগ বজায় রেখেছেন । তিনি কখনো কখনো এক দিনে দশাধিক-বার বার্তা বা মেসেহ পান ।
তেনচেনের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময় তিনি সংবাদদাতাকে বলেছেন , সুইজারল্যান্ডের সেই ভদ্রমহিলা আরেকটি পর্যটক দলকে নিয়ে তিব্বতে আসবেন । তারা তেনচেনকে গাড়ি চালাতে বলেছেন। এ কথা ভাবতেই তিনি আনন্দ আর তৃপ্তিতে ডুবে গেলেন । সংবাদদাতা তার আজীবন সৌভাগ্য কামনা করে বিদায় নিলেন ।
|