চীনের একটি জনপ্রিয় গানের কথা এমনই : আমার নিরাবৃত হৃদয় নির্মল ভালোবাসার কাঙ্গালী । তোমার স্নিগ্ধ চোখ দেখে মনে হয়, অন্যের অভিপ্রায় তোমার মন বুঝে । আমার গা ঘেঁষে বসতে চাইলে বসো ! আমি নিশ্চিত , তুমি আমার মনের ব্যাকুল ইচ্ছা জানো ------
এই গানে আজকালকার চীনাদের অনাবিল ভালোবাসা পাওয়ার ব্যাগ্র আকাংক্ষা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে । চীনাদের বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক জীবনের মান উন্নত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রণয় ও বিবাহের পূর্ণতা-প্রয়াসী চীনাদের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে ।
উত্তরপুর্ব চীনের যুবক গুয়ান ওয়ান ছিয়াং এখন পেইচিংয়ের একটি লৌহ ইসপাত কোম্পানিতে চাকরি করছেন । তাঁর মুখে সর্বক্ষণ লেগে আছে সুর্যালোকের মত ঝলমলে হাসি । তিনি রোজ ভীষন ব্যস্ত ও ক্লান্ত, ব্যবসার জন্য প্রায় প্রতি সপ্তাহে তাঁকে চীনের বিভিন্ন স্থানের লৌহ ইসপাত কারখানায় যেতে হয় । তবে তিনি সারাদিন হাসিখুশী। শুধু তাঁর সহৃদয় বন্ধুরাই জানেন , কাজের চাপেও তাঁর মন যে প্রসন্ন হয়ে থাকে তার মুলে কাজ করেছে তাঁর সুখী পরিবার । বস্তুত বছরখানেক আগে তাঁর প্রেমিকার আকর্ষনেই তিনি সুদূর উত্তর পুর্ব চীন থেকে পেইচিংয়ে এসেছেন ।
তিনি বলেছেন ,তখন আমি অন্য কিছুই ভাবি নি , শুধু এইকথা ভেবেছি যে , আমার প্রেমিকা ছাড়া আমি বেঁচে থাকতে পারব না ।তাই দ্বিধাহীনভাবে তার সঙ্গে পেইচিংয়ে এসেছি ।এখন আমরা সুখী জীবন যাপন করছি । আমার রোজগার কম নয় । আমার স্ত্রী এখন শিক্ষকতা করছে । প্রতিবছরের গ্রীষ্মকালে ছুটি কাটাতে আমি তাকে নিয়ে আমার জন্মস্থানে ফিরে যাই ।আমরা সমুদ্রের তীরেও ভ্রমন করেছি ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় গুয়ান ওয়ান ছিয়াং পেইচিংয়ের মেয়ে লি ইয়ং ফেংয়ের প্রেমে পড়েন । লি ইয়ং ফেং তার মাবাবার একমাত্র মেয়ে । স্নাতক হওয়ার পর পেইচিংয়ে ফিরে তার বাবামায়ের সংগে থাকবেন ।তাঁর সঙ্গে পেইচিংয়ে যেতে দিতে গুয়ান ওয়ান ছিয়াং পরিবারের কেউ রাজী ছিলেন না । কিন্তু মি: গুয়ান জেদ ধরলেন , মিস লি ইয়ং ফেং ছাড়া কোনো মেয়েকে ভালোবাসবেন না । শেষ পর্যন্ত পেইচিংয়ে এলেন তিনি । তিনি সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , তিনি কোনোমতে মিস লি ইয়ং ফেংয়ের ভালোবাসা ছেড়ে দিতে পারেন না । তাঁরা ইতিমধ্যে পছন্দসই চাকরি পেয়েছেন । বিয়ে করে নতুন বাড়িও কিনেছেন । পেইচিংয়ে বাঁধা হয়েছে তাঁদের আনন্দপূর্ণ নীড় । মি: গুয়ান এতদিনে তাঁর পরিবার পরিজনের সমর্থন পেয়েছেন ।
চীনে যাঁরা মি: গুয়ানের মত মনের মত প্রেম অন্বেষণ করে সাহসের সঙ্গে নিজের জীবনের পথ বেছে নেন তাঁদের সংখ্যা অনবরত বাড়ছে । তাঁরা পুরনো ধ্যান-ধারনার নাগপাশ ছিঁড়ে সাহসের সঙ্গে পবিত্র প্রেমের অন্বেষণ করছেন এবং অভীষ্ট বৈচিত্র্যময় জীবন উপভোগ করছেন ।
নিখিল চীন নারী গবেষণাগারের গবেষিকা মাদাম ছেন সিন শিন চীনের খ্যাতনামা বিবাহ ও পরিবার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ । তিনি সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন , গত কয়েক বছরে চীনাদের চিরাচরিত রক্ষনশীল মনোভঙ্গী ক্রমশই মিলিয়ে যাচ্ছে । ভালোবাসার ব্যাপারে চীনারা ক্রমেই উন্মুক্ত আর অবিচলিত হয়েছেন ।কাংক্ষীত ভালোবাসা পেলে তাঁরা সযত্নে তা রক্ষা করেন । বিবাহের পবিত্র মন্দিরে প্রবেশ করে তাঁরা বিবাহের গুনমান উন্নত করার নিরলস প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন ।
তিনি বলেছেন , এখন চীনাদের আয় বৃদ্ধি পেয়েছে , তাঁদের জীবনযাত্রার মানের উন্নতিও হয়েছে । যেমন ধরা যাক , তাঁদের বসতবাড়ির আয়তন বেড়েছে , বেতন অপেক্ষাকৃত বেশী । কাজেই তাঁরা বিবাহের মানোন্নয়ন সম্পর্কে আগে থেকে অনেক বেশী সজাগ হয়েছেন। পারিবারিক জীবন সুখী কিনা ,দম্পতির যৌন জীবন সুষম কিনা , বাড়ি আনন্দধামের মত হয়েছে কিনা ,এইসব ব্যাপারে এখন তাঁরা অধিক সচেতন হয়েছেন ।
মাদাম ছেন সিন শিন আরো বলেছেন , গত কয়েক বছরের গবেষণায় তিনি যে একটি নতুন পরিবর্তন প্রত্যক্ষ করেছেন ,তা হল এই যে , অতীতে বিবাহের সংকট দেখা দিলে, অথবা বিবাহিত জীবন নিরস বলে বোধ হলে অধিকাংশ লোক নিরবে তা সহ্য করতেন ,কোনো রকমে দিন কাটাতেন । কিন্তু এখন অনেকে সাহসের সঙ্গে বিবাহ বিচ্ছেদ বেছে নিচ্ছেন ।
চীনাদের যাদের বিয়ে ভেঙ্গে গেছে তাঁদের জন্য চীনা ভাষার কোনো কোনো ওয়েব সাইটে বিশেষ ফোরাম খোলা হয়েছে । তাঁদের অনেকেই বিশেষ ফোরামে খোলাখুলিভাবে তাঁদের বিবাহ বিচ্ছেদের ইতিহাস বর্ণনা করেছেন । হোনান প্রদেশের নেট নাগরিক মি: জাং পিনের বয়স চল্লিশের সামান্য বেশী । তাঁর আট বছরের বিবাহের অবসান সবেমাত্র ঘটেছে । সি আর আইয়ের সংবাদদাতা তাঁর সাক্ষাতকার নেয়ার সময়ে তিনি প্রাণ খুলে স্ত্রীর সঙ্গে তাঁর ছাড়াছাড়ির কারণ বিবৃত করেছেন ।
তিনি বলেছেন: স্ত্রীর সঙ্গে দিন কাটাতে কাটাতে টের পাওয়া গেল যে , নানা দিক থেকে দুজনের অমিল আছে , অভিন্ন ভাষা নিতান্তই অল্প । দাম্পত্য জীবন নিতান্তই নিরানন্দ ।অবশেষে ঝগড়া বিনাই আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়েছে ।
এখন মি: জাং পিন একলা থাকেন একটি ভাড়া করা ছোটো ঘরে । সময় তাঁর নির্ঝঞ্ঝাট কেটে যাচ্ছে । কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা নেই তাঁর । সপ্তাহান্তে তিনি বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের রঁদেভূতে যোগদান করেন , অথবা ওয়েব সাইট পরিদর্শন করে অন-লাইন সংলাপ চালান । তিনি সি আর আইয়ের সংবাদদাতাকে জানিয়েছেন ,তাঁর মনকে গলাতে পারে এমন মেয়ে জুটলে তাঁকে বিয়ে করে নতুন দাম্পত্য জীবন শুরু করবেন ।
একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী চীনে বিবাহ-বিচ্ছেদকারীদের সংখ্যা বছরের পর বছর বেড়ে যাচ্ছে । চীনের বেসামরিক প্রশাসন বিভাগের কর্মকর্তা মাদাম ওয়াং হং লি এই প্রসঙ্গে বলেছেন :১৯৯০সালে চীনে আট লক্ষ দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। বিবাহ বিচ্ছেদের অনুপাত শতকরা এক দশমিক তিন আট ভাগ । কিন্তু ২০০৩ সালে তের লক্ষ তিরিশ হাজার দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে ।
বিবাহ ও পরিবার বিষয়ক বিশেষজ্ঞ মাদাম ছেন সিন শিন এর উপরে মন্তব্য করে বলেছেন , চীনে বিবাহের অনুপাত আর বিবাহ-বিচ্ছেদের অনুপাতে যত পরিবর্তনই ঘটুক না কেন , চীনাদের জীবনে বিবাহ একটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার । তবে বিবাহের স্বাধীনতা বৃদ্ধি পাওয়ায় সুখী দাম্পত্য জীবন সৃষ্টির সম্ভাবনা অনেকখানি বেড়েছে ।
|