৪৩ বছর বয়সী রো ফা পিং চীনের রেলপথ নির্মান সাধারণ কোম্পানির একজন সাধারণ শ্রমিক। সম্প্রতি সি আর আইয়ের সংবাদদাতা যখন তাঁর সাক্ষাতকার নিচ্ছিলেন তখন তিনি সবেমাত্র ছিং হাই -তিববত রেলপথের কর্মস্থল থেকে ফিরে এসেছেন । তিনি লম্বা নন , স্বল্পভাষী ,তাঁ তামাটে মুখে ছিং হাই-তিববত মালভূমির অতি বেগুনী রশ্মি পুড়ানোর চিহ্ন ।
প্রায় বিশ বছর হলো রো ফা পিং বুলডোজার চালিয়েছেন । তিনি চীনের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রেলপথের নির্মানকাজে অংশ নিয়েছেন ।তবে রো ফা পিং বলেছেন , নির্মীয়মান ছিং হাই -তিববত রেলপথই তাঁর মনে অবিস্মরনীয় হয়ে থাকবে । তিনি অপূর্ব কর্মদক্ষতার অধিকারী বলে সাধারণ কোম্পানি প্রায় তাঁর উপর গুরুদায়িত্ব ন্যস্ত করে।
পৃথিবীর ছাদ বলে পরিচিত ছিং হাই -তিববত মালভূমিতে নির্মীয়মান ছিং হাই -তিববত রেলপথের নির্মানকাজ শুরু হয় ২০০২ সালে । ছিং হাই প্রদেশের কেরমু থেকে তিববত স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের রাজধানী লাসা পর্যন্ত এই রেলপথের দৈর্ঘ্য এক হাজার কিলোমিটারেরও বেশী । পৃথিবীর সর্বোচ্চ রেলপথ এবং মালভূমির দীর্ঘতম এই রেলপথের নির্মানকাজ সম্পন্ন করতে প্রায় ২৬ বিলিয়ন ইউয়ান ব্যয় হবে ।
২০০৩ সালের প্রারম্ভে চীনের রেলপথ নির্মান সাধারণ কোম্পানি এই অভূতপূর্ব প্রকল্পের নির্মানকাজের কর্তব্য গ্রহণ করে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রো ফা পিং কোম্পানি কর্তৃপক্ষের কাছে এই রেলপথ নির্মানকাজে অংশগ্রহণের আবেদন জানান ।
তিনি বলেছেন, মালভূমির প্রতিকূল পরিবেশে নানা দিক থেকে চ্যালেঞ্জ এসে পড়তে পারে , দক্ষ শ্রমিক হলেও আমাকে নিশ্চয় কল্পনাতীত পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হবে । আমি মনে করি ,কঠিন পরিবেশ নিজের কর্মদক্ষতা বৃদ্ধির সহায়ক হবে । তাই ব্যাকুল আগ্রহে জাতীয় পর্যায়ের এই প্রকল্পে অংশ নেয়ার জন্য নাম লিখিয়েছিলাম ।
সমুদ্রের উপরি তল থেকে ছিংহাই তিববত মালভূমির গড়পড়তা উচ্চতা চার হাজার মিটার । কনকনে হাওয়া , অক্সিজেনের অপ্রতুলতা এবং অসহ্য অতিবেগুনি রশ্মি প্রভৃতি কারণে সেখানে গিয়ে যাঁরা ভ্রমণ করতে চান , নিজেদের শরীর সেখানকার পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারবে কিনা সেই বিষয়ে তাঁদেরও প্রথমে বিবেচনা করতে হবে । সেখানে ভারি কাজ করতে গেলে তো আরো দূরের কথা ।কিন্তু রো ফা পিং মনে করেন , কঠিন প্রাকৃতিক পরিবেশে নতুন সমস্যা সুরাহা করতে করতে তাঁর সামর্থ্য নিশ্চয় বাড়বে । তিনি শক্ত বলিষ্ঠ ,নিপুনভাবে বুলডোজার চালাতে পারেন বলে তাঁর আবেদন রীতিমত মঞ্জুর হয়ে যায় ।
লাসা থেকে ২০০ কিলোমিটার দূরে নাছু জেলায় ছিংহাই -তিববত রেলপথের একটি অংশ নির্মানের ভার দেওয়া হয় রো ফা পিংয়ের কোম্পানির উপর । রো ফা পিং ও তাঁর সহকর্মীরা যখন সেখানে পৌঁছেন তখন শীতকাল শেষ হয় নি । হাড়কাঁপানো শীত, এবং মালভূমিজাত ব্যাধির জন্য শুধু মানুষ কেন , যন্ত্রপাতিকেও কঠিন পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় ।
রো ফা পিং বলেছেন , অক্সিজেনের অভাবে ইঞ্জিনে তেল পুর্ণমাত্রায় জ্বলে না । তাই বুলডোজার কাঁপতে কাঁপতে চলতে থাকে , সঠিকপথে বুলডোজার চালিয়ে যাওয়া কষ্টকর । বুলডোজারের এক স্ক্রু শক্ত করতে সমতলভূমিতে যত জোর লাগে মালভূমিতে লাগে তার তিন চার গুণ ।
বহু বছর ধরে রো ফা পিং আত্মশিক্ষা ও অনুশীলনে যে যান্ত্রিক বিধি আয়ত্ত করেছেন তা ব্যবহার করে তিনি বুলডোজার সংস্কার করেছেন । ফলে সমতল ভূমির মত মালভূমিতে তাঁর বুলডোজার ইচছামত চালানো সম্ভব হয়েছে ।
কালক্রমে রো ফা পিং মালভূমিতে বুলডোজার মেরামত করার নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন । মালভূমিতে শীতকালে পানি জমে ,অক্সিজেনের দারুন অভাবে ইঞ্জিনে আগুন জ্বালানো সহজসাধ্য নয় । অনেক চিন্তেভেবে রো ফা পিং সন্ধ্যয় কর্তব্য পালন শেষ করে তাঁর বুলডোজার এমন এক জায়গায় চালিয়ে নিয়ে যান সেখানে বুলডোজারের গায়ে শীতল বাতাসের চোট লাগে না এবং পরদিন সুর্য্য উঠতেই রোদ বুলডোজারের মাথায় পড়ে । ফলে ইঞ্জিনে আগুন জ্বালানো বেশ সহজ হয়ে যায় ।
রো ফা পিং মালভূমিতে তাঁর আবিস্কৃত বুলডোজার মেরামত করার নতুন পদ্ধতি যে তাঁর সহকর্মীদের শিখিয়েছেন তা অনেক কঠিন সমস্যা সমাধানে তাঁদের সাহায্য করেছে।
রো ফা পিংয়ের সহকর্মী লি সাও লিয়াঙ বলেছেন , রো ফা পিংয়ের শিক্ষার যোগ্যতা তেমন উচুঁ নয় ,তবে বুদ্ধি খাটানোর সদভ্যাস আছে তাঁর ।তিনি বহু বছর ধরে নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোরভাবে কাজ করেছেন । নিরলস প্রচেষ্টায় তিনি বুলডোজার চালানোর যে নতুন কলাকৌশল আবিষ্কার করছেন তা শিখে আমাদেরও উপকার হয়েছে ।
ছিং হাই- তিববত রেলপথের কর্মস্থলে রো ফা পিংয়ের চালিত বুলডোজারের ফলপ্রসুতা সর্বোচ্চ রেকর্ড সৃষ্টিকরেছে , কিন্তু তেলের ব্যয় সবচেয়ে কম ।তিনিই তারঁ কোম্পানির একমাত্র চালক যিনি রাতে তাপমাত্রা হিমাংকের ২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নীচেও নিরাপদে বুলডোজার চালাতে পারেন ।
তাঁর কম্পানির কর্মকর্তা ছেন সু ছিং তাঁর কীর্তির ভূয়সী প্রসংশা করেছেন ।তিনি বলেছেন, রো ফা পিং আমাদের কর্মস্থলে অগ্রণীর ভুমিকা পালন করছেন, নৈপুন্যের দিক থেকে তাঁর জুড়ি নেই । ।রো ফা পিংয়ের মত সেরা শ্রমিকদের নি:স্বার্থ আত্মত্যাগের সুবাদে আমাদের প্রতিটি প্রকল্পের নির্মানকাজ সময়মত সম্পন্ন হয়েছে ।
ছিং হাই তিববত রেলপথের নির্মানকাজে অংশ নিতে পেরে রো ফা পিং নিজকে ধন্য মনে করেন ।
তিনি বলেছেন , তিববতের যোগাযোগ ব্যবস্থা অনুন্নত , তবে আগামী বছরের গ্রীষ্মকালে ছিং হাই তিববত রেল পথ চালু হওয়ার পর নাছু থেকে লাসা যেতে মাত্র একঘন্টা লাগবে ।
ছিং হাই তিববত রেল পথ নির্মানকাজে অসাধারন অবদান রাখার জন্য চীন সরকার রো ফা পিংকে প্রতিষ্ঠিত শ্রমজীবীর সর্বোচ্চ সম্মান--জাতীয় আদর্শ শ্রমিকের সম্মানে ভূষিত করেছে ।
|