আনুমানিক খৃষ্টীয় প্রথম শতাব্দীর কাছাকাছি ভারতীয় বৌদ্ধ ধর্ম চীন দেশে প্রবেশ লাভ করে। বৌদ্ধধর্ম চীনে আসার পর দীর্ঘকাল ধরে চীনের কনফুসীয় ও তাওবাদী চিন্তাধারার সংমিশ্রণে ধীরে ধীরে চীনের সামন্তসমাজে শিকড় গেড়ে বসে এবং চীনের বিদ্যাচর্চার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অংশ পরিণত হয়। বৌদ্ধধর্ম জনসাধারণের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। চীনের দর্শন, নীতিশাস্ত্র, সাহিত্য ও শিল্পকলা বৌদ্ধধর্ম দ্বারা যথেষ্ট প্রভাবিত হয়েছে।আজের এই আসরে আপনাদের চীনের ধর্ম সংস্কৃতিতে পরিপূর্ণ সেনসি প্রদেশে বাড়াতে নিয়ে যাচ্ছি।সেখানে আপনারা চীনের বৌদ্ধধর্মের প্রভূত আমেজ অনুভূব করতে পারবেন। এখন শুনুন চীন আন্তর্জাতিক বেতারের নিজস্ব সংবাদদাতার লেখা একটি রেকডিংভিত্তিক প্রতিবেদন। উপস্থাপন করছি আমি আপনাদের বন্ধু -----
সেনসি প্রদেশ চীনের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিতি।সেনসি চীনের বৌদ্ধধর্ম সংস্কৃতি আর তাও ধর্ম সংস্কৃতি উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটিগুলোর অন্যতম।ধর্ম সংস্কৃতি বৈচিত্র্যময়।বৌদ্ধধর্ম স্থাপত্য, ভাষ্কর্য এবং চিত্রাঙ্কন পুরো প্রদেশে ছড়িয়ে আছে।তা ছাড়া, সেনসি চীনের বৌদ্ধধর্ম পুরাকীর্তি আর শিল্পকলার ধনভান্ডার । সেখানে বৌদ্ধধর্মের উত্তরাধিকার অত্যন্ত সমৃদ্ধ।পেইচিং থেকে রেলগাড়ীতে সেনসির দ্বিতীয় বড় শহর--ডাডং শহরে পৌঁছতে মাত্র পাঁচ ঘন্টা লাগে।চীনের এক হাজার পাঁচ শো বছরের বেশী ইতিহাসসম্পন্ন ইয়েনগাং গুহা ডাডং শহরের পশ্চিম উপকন্ঠে অবস্থিত বলে চীনে ডাডংয়ের খুব সুনাম আছে। চীনের ঐতিহাসিক তথ্যগুলোতে লিপিবদ্ধ হয়েছে যে, খৃষ্টাব্দ৪৬০ সালে এই গুহার খনন কাজ শুরু হয়। থানইয়া নামে একজন সন্ন্যাসীর উদ্যোগে এই খনন কাজ শুরু হয়।বতর্মানে গুহাতে ৫৩টি ছোট-বড় গর্ত , ৫১০০০টি বৌদ্ধমূর্তি আছে। এ সব বৌদ্ধমূর্তির মধ্যে সবচেয়ে বড় মূর্তির আকার হল ১৭ মিটার উচু এবং সবচেয়ে ছোট আকার মাত্র কয়েক সেটিমিটার।এটা হল যেমন চীনের সবচেয়ে বড় পাথর গুহাগুলোর অন্যতম তেমনি বিশ্বের বিখ্যাত শিল্পকলার ধনভান্ডার। ইয়েনগাংএর সুক্ষ্ম ভাস্কর্য বিশ্ববিখ্যাত।এ সব ভাস্কর্যে ভারতের বৌদ্ধধর্মের শিল্পকলার শ্রেষ্ঠত্ব বিবেচনা করে সংগ্রহের পাশাপাশি সুষমভাবে চীনের ঐতিহ্যিক শিল্পকলার রীতিনীতির সমন্বয় হয়েছে। ইতালির পর্যটক মিল্যানা ইয়েনগাং গুহা পরির্দশন করার সময় আবেগের সঙ্গে বললেন,
আমি প্রথম বার অতো সুমহান পাথর গুহামালা দেখেছি। এগুলো দেখে আমি আবাক না হাওয়ার কারণ নেই।বৌদ্ধমূর্তির ভাস্কর্য অত্যন্ত সুক্ষ্ম এবং প্রাণরসে পরিপূর্ণ।আমি লক্ষ্য করেছি চীনের বৌদ্ধধর্মের সংস্কৃতি সত্যই প্রগাঢ় ।যদিও ভ্রমণে আমি খুব ক্লান্তি পেয়েছি তবু যখন এ সব ভাস্কর্য দেখি তখন আমার ক্লান্ত আপনাআপনি বিলীন হয়ে গেছে। এখানে সবকিছু চমত্কার । ইয়েনগাং গুহা পরির্দশনের পর পশ্চিম দিকে গাড়ীতে চড়ে প্রায় তিন ঘন্টার পর ধর্মের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত সেনসি প্রদেশের আরেকটি দর্শনীয়স্থান----হ্যানসেন বা হ্যান পাহাড় পৌঁছানো যায়।এই পাহাড়ের তলদেশে অবস্থিত একটি ছোট মন্দির। মন্দির নাম শিয়েখং মন্দির ।এই মন্দির পাহাড়ের অকতল অংশে নির্মাণ করা হয়।চীনের একটি প্রবাদে এভাবে বলা হয়েছে " সমতল ভুমিতে অট্রালিকা নির্মাণ করা"। কিন্তু এই মন্দির পাহাড়ের অকতল অংশে নির্মিত হয়েছে।মানুষের চোখে এই মন্দির একটি জীর্ণ স্থাপত্য। তবে এই "জীর্ণ স্থাপত্য" ১৪০০ বছর আগের স্থাপত্য।আসলে এই মন্দিরে বল-বিদ্যা, কান্তিবিদ্যা এবং ধর্মের প্রতিফলিত হয়েছে।এই মন্দির ঝড়-বৃষ্টি এবং প্রচন্ড বাতাস থেকে রেহাই পেতে পারে। তা ছাড়া পাহাড়ের অকতল জায়গায় নির্মিত হয়েছে বলে এই মন্দির জ্বলন্ত রোদের শিকার হতে পারে না।জানা গেছে , গ্রীষ্মকালে দিনবেলায় মন্দিরের উপর মাত্র তিন ঘন্টার রোদ পড়ে।এটা হল হাজারাধিক বছরের মধ্যে এই মন্দির ঝড়-বৃষ্টি , জ্বলন্ত রোদ এমকি ভূমিকম্পের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার প্রধান কারণ।এখনও তা স্থিতিশীলভাবে পাহাড়ের ঢালুতে দাঁড়িয়ে আছে।পর্যটক খং ই ফেন যিনি এক সময় এই মন্দিরে উঠেছিলেন তিনি বললেন, এই উপরের জায়গায় উঠার পর পর্যটকরা সঙ্গে সঙ্গে ভুব ভায় পান ।তিনি বললেন,
মন্দিরের সামনের এই সমতল প্ল্যাটর্ফোম পার হওয়ার পর আমার ভয় বেড়ে থাকে ।কেননা, এর পর পায়ের নিচে যে পথ রয়েছে তা অত্যন্ত সরু ।মাঝে মাঝে টিপিয়ে টিপিয়ে সামনে ওগোতে হয়। মানুষকে সাবধানে উপর যেতে হয়। পুরাতন মন্দির দেখতে এত জীর্ণ হয়েছে যে মনে হয় যে কোনো মুহূর্তেই তা ধসে পড়তে পারবে।আমার মনে হয় মানুষের ভয় বোধসাধ্য।
এই মন্দির কেন এ পাহাড়ের অকতল জায়গায় নির্মিত হয় , প্রশ্নের উত্তরে মন্দিরে যুব সন্ন্যাসী শিয়াংহো ব্যাখ্যা করে বললেন,
অতীতে এই জায়গা ছিলো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবহণের কেন্দ্র। দক্ষিণ দিকে উতাই পাহাড় এবং উত্তর দিকে ডাডং শহর।দক্ষিণ দিকে যাতায়াত করা এবং উত্তর দিকে যাতায়াত করা ধর্মালম্বিদের জন্য এই মন্দির সুবিধা দিয়েছে। আরেকটি কারণ হলো এই জায়গায় বৃষ্টাপাত বেশী পড়ে। সামনের নদীতে মাঝে মাঝে বন্যা হয়। সুতরাং এই পাহাড়ের ঢালুর অকতল অংশে এই মন্দির নির্মাণ করা হয়েছে।
মন্দির বেশ বড় নয়।তবে মন্দিরের ভেতরে আশির বেশী বৌদ্ধ মূর্তি রয়েছে।তাদের মধ্যে কোনো কোনো লোহার ভাষ্কার্য, কোনো কোনোর ব্রান্জের ভাষ্কর্য আবার কোনো কোনো পাথের ভাষ্কর্য।এ সব মূর্তি দেখতে প্রাণবন্ড। এই মন্দির সর্বোচ্চ জায়গায় একটি হলে সাইকমনি, কনফিসীয় এবং লাওজ এক সঙ্গে থাকে। বৌদ্ধধর্ম, তাওধর্ম এবং লুধর্ম এক সঙ্গে একই কক্ষে থাকার লক্ষণ চীনে খুব কম দেখা যায়।হ্যানসেন পাহাড় থেকে দক্ষিণ দিকে গাড়ীতে চড়ে প্রায় তিন ঘন্টার পর উতাই পাহাড় ।উতাই পাহাড় চীনের চাঁরটি বিখ্যাত বৌদ্ধর্ধম পাহাড়গুলোর অন্যতম।এই পাহাড় সনুদ্র-সমতলের তুলনায় ৩০০০ মিটার উঁচু।চাচ দিক পাঁচটি পাহাড়ে ঘেরা।পাহাড়ে প্রায় ৫০টি ছোট-বড় মন্দির আছে।এখানকার সুমহান স্থাপত্য, সুক্ষ্ম ভাষ্কর্য এবং ইতিহাস থেকে বর্তানো পরাকীর্তি মানুষের কাছে একটি রহস্য এনে দিয়েছে।পেইচিং বাণিজ্য পর্যটন কোম্পানির গাইড মিস লি ছিন বললেন,
অকটোবার পর উতাই পাহাড়ে ভ্রমণ না করা ভাল।কারণ অকটোবার মাসে শীত পড়েছে । মাঝে মাঝে অকটোবার মাসে তুষাও পড়ে।উতাই পাহাড়ে দেখার মতো জায়গা হলো এ সব দন্দির। এখানে পুরো দেশের বৌদ্ধ ধর্মালম্বিরা পুজা করতে আসে।
|