আমাদের সংবাদদাতা যখন প্রথমবারের মতো বাসানের সংগে দেখা করলেন , তখন তিনি উত্তর তিব্বত থেকে সদ্য ফিরে এসেছেন । তিনি দেখতে শুধু একজন সাধারণ তিব্বতি নারী , কিন্তু তার কন্ঠস্বর দারুণ মিষ্টি আর মধুর । তিনি তিব্বতের একজন জনপ্রিয় গায়িকা হয়ে উঠেছেন এবং তাকে সেনারা ভরতপক্ষী বলে আখ্যায়িত করে। আজ এই অনুষ্ঠানে তার গান পরিবেশনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে আপনাদের কিছু বলছি আমি…
তিব্বত সামরিক এলাকার শিল্পী দলের গায়িকা বাসান তিব্বতের এক নতুন তারকা। আপনি যা শুনেছেন , তাতে আপনি হয়তো তার মিষ্টি , মধুর ও উচ্চগ্রামের কন্ঠস্বর অনুভব করেছেন । তার কন্ঠস্বর যেন জলপ্রপাতের মতো উচ্চ স্থান থেকে নিম্নে পতিত জলরাশি । তার গান গাওয়ার নৈপুণ্যের ওপর দেশের সংগীত বোদ্ধারা বেশ মনোযোগ দেন। তিব্বতে বাসান খুব জনপ্রিয় । শ্রোতা ও দর্শকরা তাকে তিব্বতের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ গায়িকা ছাইতেজুমার সংগে তুলনা করেন। তারা তাকে ছোট ছাইতেজুমা নামে ডাকেন ।
৩৭ বছর বয়স্ক বাসান লাসা শহরের উপকন্ঠের একটি কৃষক পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন । তার মা'য়ে কন্ঠস্বরও মধুর ছিল। তিনি ছিলেন একজন প্রসিদ্ধ স্থানীয় গায়িকা । ছোট বেলায় যখন বাসান মায়ের সংগে গবাদি পশু চরাতে যেতেন, তখন তিনি পশুপালকদের কাছেবহু সুন্দর গান ও তিব্বতী অপেরা শুনেছেন আর শিখেছেন । বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে অল্পবয়সী বাসান একটি ছোট পাখির মতো অবাধ আর স্বচ্ছন্দে গান গাইতেন । তার পেশাদার গায়িকা হয়ে ওঠার পিছনে বড় বোন সানতেন ছিলেন পথ-নির্দেশক । তখন সানতেন ছিলেন জেলার একটি অপেশাদার শিল্পী দলের সদস্য । সংগীতের প্রতি তার ছোট বোনের অনুরাগ আর প্রতিভা দেখে দলের সদস্য হবার জন্য তিনি বাসানকে পরামর্শ দেন। অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করে সানতেন বলেন, তখন বাসানের বয়স কম হলেও সে গান গাওয়ার প্রতিভা দেখিয়েছে।
যখন বাসানের বয়স ৬ বছর ছিলো, তখন সে গান গাইতে শুরু করে । যখন বাবা মা কৃষি জমিতে কাজ করতেন , তখন তারা তাকে সেখানে নিয়ে যেতেন । কৃষি জমিতে বিরতির সময় বাসান সবাইকে গান শুনাতে পছন্দ করতো। সে গান শোনতে একটুও ভয় পেতেন না ।
জেলার অপেশাদার শিল্পী দলে যোগদান করার পর পুংখানুপুংখভাবে সংগীতের তত্ত্ব আর গান গাওয়ার নৈপুণ্য শেখার জন্য বাসানকে লাসা শহরের শিল্পকলা বিদ্যালয়ে পাঠানো হয়। সেখানে চার বছর অধ্যয়ন তার মনে গভীর রেখাপাত করে । বিদ্যালয়ে ভর্তি হবার প্রথম দিকে তিনি হান ভাষা বুঝতেন না । তিনি ক্লাসে শিক্ষকের কথা বুঝতেন না , হান ভাষার পাঠ্যপুস্তক পড়তে পারতেন না । লেখাপড়ার বেশ অসুবিধা হতো। কিন্তু তিনি এই সব বাধা বিঘ্নের কাছে হার স্বীকার করেন নি । তিনি প্রথম থেকে শিখতে শুরু করলেন । সংগীতের প্রতি তার প্রত্যয় আর উত্সাহের ভিত্তিতে তিনি পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করে স্নাতক হন। কাজের প্রয়োজনে তিনি এই বিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করছেন ।
কিন্তু বাসানের স্বপ্ন এই যে, তিনি মঞ্চে দাঁড়িয়ে গান গাইবেন এবং সংগীতের তালে তালে ধীরে ধীরে নাচবেন । ভাগ্যের ব্যাপার এই যে , তিনি তিব্বত সামরিক এলাকার শিল্পী দলের একজন গায়িকা হয়েছেন । তখন তিনি একদিকে আনন্দিত হয়েছেন , অন্যদিকে চিন্তিত হয়েছেন ।
তখন আমাকে যে কি করতে হবে, সে সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না । তখন সামরিক এলাকার শিল্পী দলের নাম আমি প্রথম শুনেছি । আমার ভবিষ্যত কি, সে ব্যাপারে আমার মনে ভীষণ দ্বন্দ্ব ছিল। এই সময় এই সুযোগকে গুরুত্ব দেয়ার জন্য আমার বোন আমাকে উত্সাহ দিয়েছেন ।
বাসান সেনাবাহিনীর সাংস্কৃতিক শিল্পী দলের একজন সদস্যে পরিণত হয়েছেন । এখন ১৬ বছর হয়ে গেছে । যেদিন তিনি সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন , সে দিন থেকে তিনি একজন সৈনিক হিসেবে নিজের সুশৃঙ্খল তত্পরতা শুরু করেন । সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশনের জন্য প্রতি বছর শিল্পী দলের সদস্যদের প্রায় এক শ'বার সেনাবাহিনীতে যেতে হয় । এতে বাসান ভালভাবে অনুষ্ঠান পরিবেশনের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালান । তারা যে সব সৈন্যদলে যান , তাদের মধ্যে বেশির ভাগ সীমান্তরেখায় অবস্থিত । ওখানের পরিবেশ খুব সাদামাটা , কোনো উন্নত মানের আলোক সজ্জা নেই । মঞ্চে ব্যবহার্য সুন্দর পটভূমি তো আরো দূরের কথা । কিন্তু সৈনিকদের তুমুল হাততালি আর প্রকৃত হাসি মুখ তাকে গান গাওয়ার উত্সাহ আর আবেগ দিয়েছে ।
যখন সৈনিকরা আমার পরিবেশনার জন্য প্রশংসা করে হাততালি দেন , তখন আমি খুব মুগ্ধ হই এবং ক্লান্তিও সংগে সংগে চলে যায় ।
পরিশ্রমের জন্য বাসান বহু মর্যাদা লাভ করেছেন । গত কয়েক বছরে তিনি সমগ্র সেনাবাহিনী আর সমগ্র দেশের প্রতিযোগিতায় বেশ কয়েকটি পুরস্কার পেয়েছেন । চীনের প্রসিদ্ধ তিব্বতী গায়িকা মাদাম ছেতেজুমা তার কথা বলতে গিয়ে বলেছেন ,
আমার মনে হয় বাসান তার শিল্পীর কাজ খুব পছন্দ করেন । গান গাওয়ার নৈপুণ্য আরো উন্নত করার জন্য তিনি অধ্যবসায়ের সংগে চর্চা করেন । তার এই আচরণ খুবই মূল্যবান । তিব্বতের অল্পবয়সী গায়ক-গায়িকার মধ্যে তিনি সবচাইতে সুনাম পেয়েছেন ।
সেনাবাহিনীর এই ভরতপক্ষী গান গাওয়ার ক্ষেত্রে যে এত বেশি সাফল্য পেয়েছেন , তার মূল কারণ এই যে , বহু বছরে তার পরিবার পরিজন তাকে সাহায্য করে আসছেন । নিজের পরিবার প্রসংগে বাসানকে বেশ সুখী আর পরিতৃপ্ত দেখালো । তিনি বলেন , তার স্বামী তাকে খুব সাহায্য করেন , সুতরাং যখন তিনি বাইরে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করতে যান , তখন তার কোনো দুশ্চিন্তা নেই । ছেলেকে দেখাশুনা আর বাড়ির খুঁটিনাটি কাজ তার স্বামী করেন । সাক্ষাতকারে তার স্বামী স্ত্রীর কথা বলতে গিয়ে বলেছেন ,
আমি জানি , তিনি কাজে খুব ব্যস্ত আছেন । তিনি যেমন গান গাইতে তেমনি সেনাবাহিনীর জীবন পছন্দ করেন । তার স্বামী হিসেবে আমি তার কাজ পছন্দ করি । যাতে তিনি নিশ্চিন্তে সেনাবাহিনীর শিল্পী দলের কাজে নিয়োজিত হন ।
স্ত্রী সেনাবাহিনীর শিল্পী দলের কাজে যে এত অধ্যবসায়ের সংগে আত্মনিয়োগ করেন , তা দেখে স্বামীর খুশি হবারই কথা । আশা করি , বাসান সেনাবাহিনীর রি ভরতপক্ষি আরো উঁচুতে উড়ে যাবে ।
|