পৃথিবীতে সুন্দর লম্বা চুল সাধারণতঃ সকল মেয়ের ভাল লাগে । মেয়েদের জন্য লম্বা চুল যেমন দেখতে সুন্দর , তেমনি এতে মেয়েদের সুন্দর আবেগ আর অনুভূতিও শামিল হয়েছে । দক্ষিণ চীনের কুয়াংশি জুয়াং স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের পাহাড়ী এলাকায় মেয়েরা লম্বা চুল আঁচড়ায় , এতে তাদের সুখ ও স্বপ্ন ব্যক্ত করা হয় ।
দক্ষিণ চীনের কুয়াংশি জুয়াং স্বায়ত্ত শাসিত অঞ্চলের লুংচি এলাকা নীল পাহাড় আর সবুজ নদ-নদীতে ঘেরা । এখানে গিয়ে আপনার চোখে পড়বে মেয়েরা নদীর ধারে বসে চুল আঁচড়ায় , তাদের কৃষ্ণ লম্বা চুল জলপ্রপাতের মতো উপর থেকে নীচে গড়িয়ে পড়ছে। লম্বা চুলের প্রশংসা নামের একটি মিষ্টি গানের সুর নদীর ধারে ভেসে উঠে । গানে বলা হয়েছে , প্রেমিকে জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আমি কৃষ্ণ ও উজ্জ্বল লম্বা চুল আঁচড়াছি । মোটা আর উজ্জ্বল চুলে দম্পতির চিরকালের ভালবাসা প্রকাশিত হয় এবং বাবা মা'র উপকার কখনো ভুলে যাবে না । লম্বা চুল সুখী জীবণের পরিচায়ক ।
এই সব দীর্ঘ-বেশী মেয়ে দক্ষিণ চীনের ইয়াও জাতির একটি শাখা । ইয়াও জাতির মেয়েদের শাখা চিহ্নিত করতে হলে তাদের পোষাকের ওপর । নির্ভর করতে হয় । উল্লেখিত মেয়েরা লাল পোষাক পরতে পছন্দ করে বলে তাদের লাল ইয়াও বলা হয় । লাল ইয়াও প্রধানতঃ কুয়াংশির উত্তরাংশের পাহাড়ী অঞ্চলে বাস করে । তাদের লোকসংখ্যা ১৩ হাজার । হান ভাষার ব্যাপক প্রভাবের দরুণ তারা সবাই হান ভাষায় বলে । লাল ইয়াও মেয়েরা ১৩ বছর বয়সে লম্বা চুল আঁচড়াতে শুরু করে । ১৬ বছর বয়সে একবার চুল কাটে । তার পর আর কখনও কাটবে না ।
লাল ইয়াও মেয়েরা মনে করে যে , লম্বা চুল প্রাণের প্রতীক । সুতরাং লম্বা চুল আঁচড়ানো তাদের শত শত বছর ধরে মেনে নেয়া একটি আচার আচরণ । মেয়েদের চুল আঁচড়ানোর সময় অসাবধানে কয়েকটি কেশ মাটিতে পড়লেও তারা সযত্নে কুড়িয়ে নিয়ে তা সংরক্ষণ করে । তাদের কাটা চুল সাধারণতঃ নানীর কাছে সংরক্ষিত থাকে । বিয়ের দিনে এগুলো একটি পণ হিসেবে তাদের লম্বা চুলের ভিতরে ঢুকানো হয় ।
লাল ইয়াও মেয়েদের চুলে তাদের গোপনীয় অভিজ্ঞতা লুকিয়ে আছে । ফাং চি ছিং নামে একজন মেয়ে বলেছেন ,
ইয়াও জাতির মেয়েরা বিবাহিত বা অবিবাহিত কিনা, তা বুঝতে হলে তাদের চুলের স্টাইল দেখা উচিত । আমাদের চুলের স্টাইল আঁচড়ানোর পদ্ধতি ভিন্ন । যাদের চুল গোলাকারে আঁচড়ানো হয় , তারা বিবাহিত , কিন্তু তাদের বাচ্চার জন্ম হয় নি । যাদের মাথার সামনে একটি পরিপাটি খোঁপার মত থাকে, তারা বিবাহিত এবং তাদের বাচ্চার জন্ম হয়েছে । আমার মতো যাদের চুল গোলাকারে আঁচড়ানো হয় এবং তা পাগড়ি দিয়ে জড়ানো , তারা অবিবাহিত ।
লম্বা চুল লাল ইয়াও মেয়েদের মূল্যবান সম্পত্তি , সুতরাং তারা অপরিচিত লোকদের সামনে কখনও নিজেদের চুল দেখায় না । তাদের চুল এক টুকরা লীল রংয়ের রুমাল দিয়ে জড়ানো। স্থানীয় আচার ব্যবহার অনুযায়ী , যে পুরুষ সবচাইতে আগে লাল ইয়াও মেয়ের লম্বা চুল দেখেছে , সে অবশ্যই সেই মেয়ের স্বামী হবে ।
লাল ইয়াও মেয়েদের চুলের স্টাইল আশ্চর্য, চুলের দৈর্ঘ্য সাধারণতঃ এক মিটারেও বেশি । তাদের মধ্যে এক জনের চুলের দৈর্ঘ্য ১.৮ মিটারে দাঁড়িয়েছে । লুংসেন অঞ্চলের হোয়াং লু ইয়াও গ্রামে ষাটাধিক মেয়ের চুলের দৈর্ঘ্য ১.৪মিটারের উপরে । একটি গ্রামে যে এত বেশি মেয়ের চুল আশ্চর্য লম্বা হয়েছে , তা গিনিস বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করেছে । গ্রামবাসী ফাং চি কান বলেছেন ,
লাল ইয়াও মেয়েরা লম্বা চুল সুন্দর বলে মনে করে । তাদের মতে , চুল প্রাণের এক অংশ । তাকে ইচ্ছে মতো করা যায়। লম্বা চুল দীর্ঘায়ু আর সৌভাগ্যের প্রতীক । তাদের চুল রক্ষণাবেক্ষণের দ্রব্যও বিস্ময়কর । চাল পরিস্কার করার পানিতে কিছু বনৌষধি ওষুধ ভিজিয়ে রেখে পচানোর পর যে তরল সৃষ্টি হয় , তা লাল ইয়াও জাতির মেয়েদের ব্যবহার্য চুল রক্ষণাবেক্ষণ দ্রব্য । এই চুল রক্ষণাবেক্ষণ দ্রব্য ব্যবহার করার জন্য কিছু সত্তর আশি বছর বয়স্ক বৃদ্ধার চুল এখনো চকচকে উজ্জ্বল । তা ছাড়া গ্রামের দূষণমুক্ত পরিবেশ , স্বচ্ছ পানিও ওখানকার মেয়েদের চুল ভাল অবস্থায় সংরক্ষিত হবার একটি কারণ ।
লম্বা চুল ছাড়া রৌপ্য অলংকার আর সূচীকর্মের পোষাকও লাল ইয়াও মেয়েদের নিদর্শন । লাল পোষাক পরা এই সব ইয়াও জাতির মেয়েদের একটি উপভোগযোগ্য দৃশ্য । পরিপাটি লাল সূচিকর্মের পোষাক , ময়ুর পাখা বাড়ানোর মতো স্কার্ট আর বড় বেল্ট ,এ সব কিছুতে মেয়েদের আবেগ আর স্ফুর্তিপূর্ণ অনুভূতি প্রকাশিত হয়েছে ।
চুলের স্টাইলের মতো লাল ইয়াও মেয়েদের পোষাকেও তাদের বয়সের গোপনীয়তা অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । ফাং চি ছিং নামে একজন মেয়ে বলেছেন ,
অল্পবয়সী মেয়েরা প্রধানতঃ পুরানো তাঁতে বোনা বস্ত্র দিয়ে বানানো লাল পোষাক পরে । প্রৌঢ় নারীরা সূচিকর্মের পোষাক পরে আর বৃদ্ধারা কালো রংযের পোষাক পরে ।
লাল ইয়াও মেয়েরা সবাই সূচীকর্মে পারদর্শী । তাদের সূচীকর্মের ডিজাইন সরল আর প্রাণবন্ত । তাদের মাথায় চুল পাগড়িতে জড়ানো , তাদের ওপরে রংবেরংয়ের সুতা দিয়ে সূচীকর্মে বানানো চতুর্ধার একটি ডিজাইন ।
রূপ কথা অনুযায়ী , ইয়াও জাতির পূর্বপুরুষরা একজন সম্রাটের প্রাণ বাঁচিয়েছেন , নিজের কৃতজ্ঞতা ব্যক্ত করার জন্য এই সম্রাট তার উপকারীর গায়ে চতুর্ধার নক্সাবিশিষ্ট একটি সীলের ছাপ দিয়েছেন । পরে যাদের গায়ে এই ধরণের সীলের ছাপ আছে , তারা রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক পরিশ্রমমুক্ত । সুতরাং ইয়াও জাতির অর্থ রাষ্ট্রের বাধ্যতামূলক পরিশ্রম থেকে মুক্ত ।
চুল জড়ানো রুমাল ছাড়া রুপোর অলংকারও লাল ইয়াও মেয়েদের এক ধরণের প্রয়োজনীয় সাজানো জিনিষ । বয়স যতই হোক না কেন , ইয়াও জাতির মেয়েদের দুটো রুপোর দুল পরা প্রয়োজন এবং খোপার ভিতরে একটি সৌন্দর্যময় চিরুনি ঢুকানো হয় । রুপোর অলংকার আর কালো চুলের আলোয় লাল ইয়াও মেয়েদের সৌন্দর্য দেখানো হয়েছে । দক্ষিণ আফ্রিকার পর্যটক ভেন লীগ্ বলেছেন ,
লুংচি অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি ও তাদের যার যার ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি সংরক্ষিত আছে । ওখানে ঐতিহ্যিক সংগীত শোনা যায় আর স্থানীয় বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন চালের মদ খাওয়া যায় ।
|