চীনের প্রেসিডেন্ট হু চিন থাও গত মার্চ মাসে বিশেষ করে তাইওয়ান সমস্যা সমাধান প্রসঙ্গে দেয়া ভাষণে বলেছেন, তাইওয়ানের যে কোন লোক, কিংবা যে কোন রাজনৈতিক পার্টির এক চীন মৌলিক নীতির দিকে যাওয়ার প্রচেষ্টাকে আমরা স্বাগত জানাই। এক চীন নীতি স্বীকার করলে কোন ব্যক্তি, বা কোন রাজনৈতিক পার্টি অতীতে কি বলেছে, কিংবা কি করেছে, সব উপেক্ষা করে আমরা তাদের সঙ্গে দু'তীরের সম্পর্ক উন্নয়ন করা এবং শান্তিপূর্ণ পুনরেকত্রীকরণ ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে আলোচনা করতে ইচ্ছুক।
১৯৪৯ সালে চীন গণ প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পর চীন সরকার কখনো দেশের সম্পূর্ণ পুনরেকত্রীকরণের প্রয়াস পরিত্যাগ করে নি। চীন সরকারের তাইওয়ান সমস্যা সমাধানের মৌলিক নীতি হচ্ছে "শান্তিপূর্ণ পুনরেকত্রীকরণ, এক দেশে দুই সমাজ ব্যবস্থা"। এই মূল নীতির কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু হচ্ছে শান্তি আলোচনার মাধ্যমে দু'তীরের পুনরেকত্রীকরণ বাস্তবায়ন করা। পুনরেকত্রীকরণের পর দেশের মূল অংশ অর্থাত্ চীনের মূলভূখন্ডে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বজায় থাকবে। তাইওয়ানের বর্তমান পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পরিবর্তন হবে না।
বহু বছর ধরে চীন সরকার তাইওয়ান প্রণালীর দু'তীরের সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সক্রিয় প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছে। প্রণালীর দু'তীরের মিলিত প্রচেষ্টায় গত শতাব্দীর ৮০'র দশরের শেষ দিকে দু'তীরের প্রায় ৪০ বছর স্থায়ী সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অবস্থার অবসান ঘটে, দু'তীরের অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক আদান-প্রদান এবং লোকজনের আসা-যাওয়া লক্ষণীয় অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দশ বারো বছরে দু'তীরের মধ্যে বাণিজ্যের মূল্য মোট ৪০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি, এর মধ্যে তাইওয়ান পক্ষের বাণিজ্যিক উদ্বৃত্তপ্রায় ৩০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দাড়িঁয়েছে। মূলভূভাগ সক্রিয়ভাবে তাইওয়ানের স্বদেশবাসীদের জন্য মূলভূভাগে আত্মীয়স্বজনদের দেখা , ভ্রমণ করা, ব্যবসায় করার সুযোগ দিয়ে আসছে। এখন কয় লক্ষ তাইওয়ানবাসী মূলভূভাগে চাকরী, লেখাপড়া বা বসবাস করেন। মূলভূভাগে তাইওয়ানবাসীদের বৈধ স্বার্থ সুরক্ষার জন্য চীনের আইন সংস্থা এবং কেন্দ্রীয় সরকার ও বিভিন্ন স্থানীয় সরকার কতোকগুলো আইন ও নিয়ম প্রণয়ন করেছে এবং বাস্তব সম্মতভাবে কার্যকরী করেছে। সঙ্গে সঙ্গে চীন সরকার দু'তীরের মধ্যকার রাজনৈতিক আলাপ-আলোচনা করার জন্যও প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
কিন্তু তাইওয়ান পক্ষ মূলভূখন্ডের অধিবাসীদের তাইওয়ানে গিয়ে আত্মীয়স্বজনদের দেখা, ভ্রমণ করা এবং ব্যবসায় করার ব্যাপারে বহু বাধা সৃষ্টি করেছে, তারা দু'তীরের স্বদেশবাসীদের আরো ঘনিষ্ঠ যোগাযোগে বাধা সৃষ্টি করে। বিশেষ করে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে চীনের কুওমিনটাং পার্টি তাইওয়ানের সর্বোচ্চ ক্ষমতা হারানোর সঙ্গে সঙ্গে তাইওয়ান দ্বীপের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির তত্পরতা আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। কর্তৃপক্ষ চীন থেকে তাইওয়ানকে বিচ্ছিন্ন করার "স্বাধীন তাইওয়ান" নীতি চালু করেছে। তাইওয়ান চীনের অংশ এই সত্যকে অস্বীকার করে, ফলে দু'তীরের সম্পর্কে উত্তেজনাসংকুল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে।
এমন হলেও চীন সরকার দু'তীরের শান্তিপূর্ণ পুনরেকত্রীকরণের প্রয়াস পরিত্যাগ করে নি। চীনের প্রেসিডেন্ট হু চিন থাও এ বছরের মার্চ মাসে তাইওয়ান সমস্যা প্রসঙ্গে দেয়া ভাষণে বলেছেন, মূলভূখন্ড শান্তিপূর্ণ পুনরেকত্রীকরণের প্রয়াস কখনো পরিত্যাগ করবে না। তাইওয়ানের স্বদেশবাসীদের প্রতি অনুকূল কাজ, যেমন দু'তীরের আদান-প্রদান, তাইওয়ান প্রণালী অঞ্চলের শান্তি রক্ষা, মাতৃভূমির শান্তিপূর্ণ পুনরেকত্রীকরণ প্রভৃতি কাজ করতে চীন পক্ষ যথাসাথ্য প্রচেষ্টা চালাবে এবং অবশ্যই ভাল কাজ করবে।
তাইওয়ান কর্তৃপক্ষের নিরন্তর তীব্রতর "স্বাধীন তাইওয়ানের " কার্যকলাপ এবং কিছু কিছু বিদেশী শক্তি চীনের পুনরেকত্রীকরণের উপর হস্তক্ষেপ করার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে চীন সরকার বহু বার কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছে যে, দেশের পুনরেকত্রীকরণের জন্য চীন সরকার বলপ্রয়োগ পরিত্যাগ করার প্রতিশ্রুতি দেবে না। প্রেসিডেন্ট হু চিন থাও মার্চ মাসের ভাষণে পুনর্বার এই দৃঢ় অঙ্গীকার ঘোষণা করেছেন । তিনি বলেছেন, দেশের সার্বভৌমত্ব এবং ভূভাগের অখন্ডতা রক্ষা করা হচ্ছে দেশের মূল স্বার্থ। কেউ চীনের সার্বভৌমত্ব এবং ভূখন্ডের অখন্ডতা লঙ্ঘন করতে চাইলে ১৩০ কোটি চীনা জনগণ কোনো মতে মেনে নেবে না । দেশের বিভক্তির বিরোধিতা এই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে আমরা কোনো মতে ইতস্ততঃ এবং আপোস করবো না। চীন হচ্ছে তাইওয়ানবাসী সহ ১৩০ কোটি চীনা জনগণের চীন। চীনের সার্বভৌমত্ব এবং ভূখন্ডের অখন্ডতা সম্পর্কিত সমস্যার বিষয়ে দেশের ১৩০ কোটি মানুষের যৌথ সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।
মার্চ মাসে চীনের সর্বোচ্চ জাতীয় ক্ষমতাসীন সংস্থা "দেশের বিভক্তি বিরোধী আইন" প্রণয়ন করেছে, যাতে চীন সরকার তাইওয়ান সমস্যা সমাধানের মৌলিক নীতি এবং বিভক্তির বিরোধিতার দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং তা আইনের মাধ্যমে স্থির হয়েছে।
তাইওয়ান প্রণালী অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা এবং দু'তীরের সম্পর্ক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য চলতি বছরের প্রথমার্ধে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক হু চিন থাও তাইওয়ানের বৃহত্তম বিরোধী পার্টি --- চীনের কুওমিনটাং পার্টির চেয়ারম্যান লিয়েন চানকে মূলভূখন্ড সফরের আমন্ত্রণ জানান। এপ্রিল মাসের শেষ দিকে দু'তীরের বৈরি অবস্থায় পড়ার পর অর্থাত্ ৫৬ বছরের পর দুই পার্টির সর্বোচ্চ নেতৃবৃন্দ পেইচিংয়ে প্রথম বৈঠক করেছেন। দু'পক্ষ এক চীনের নীতির ভিত্তিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দু'তীরের মধ্যে আলোচনা শুরু করার বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেছে। কুওমিনটাং পার্টির চেয়ারম্যান মূলভূখন্ড সফরের পর তাইওয়ানের অন্য দুটি বিরোধী পার্টি ছিংমিন পার্টি এবং নতুন পার্টির চেয়ারম্যানও পর পর মূলভূখন্ড সফর করেছেন, এবং হু চিন থাওয়ের সঙ্গে একই বিষয়ে মতৈক্যে পৌঁছেছেন।
এখন কুওমিনটাং পার্টি, ছিংমিন পার্টি এবং নতুন পার্টি সংযুক্ত হয়ে তাইওয়ানের "আইন পরিষদে" সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন দখল করেছে। চীনের মূলভূখন্ড আর উপরোক্ত তিনটি পার্টির অঙ্গীকার "স্বাধীন তাইওয়ান" অনুসরণকারী তাইওয়ান কর্তৃপক্ষের তীব্র সমালোচনা পেলেও প্রণালীর দু'তীর এবং আন্তর্জাতিক সমাজের ব্যাপক প্রসংশা এবং সমর্থন পেয়েছে। জনগণ দু'তীরের সম্পর্কের উজ্জ্বল ভবিষ্যত প্রত্যাশা করছেন।
|