চীনের লেখকদের মধ্যে আর ইউয়ে হো নামক একজন বিশিষ্ট লেখক আছেন , তিনি শুধু ঐতিহাসিক বিষয়গুলো ,বিশেষ করে চীনের রাজাদের কাহিনী লেখেন। আর ইউয়ে হোর বয়স পঞ্চাশের কিছু বেশী , দেখতে একটু মোটা , তিনি সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করেন , তাঁর পরিচিত বন্ধুরা সবাই তাকে পছন্দ করেন , তারা বলেছেন তিনি যেন প্রতিবেশীর একজন চাচা। আর ইউয়ে হোর আসল নাম লিং চিয়ে ফান , আর ইউয়ে হো তার ছদ্মনাম। মধ্য চীনের সান সি প্রদেশে তার জন্ম , কিন্তু তিনি দীর্ঘ দিন হোনান প্রদেশে থাকেন । সানসি ও হোনান মধ্য চীনের হলুদ নদীর অববাহিকার দুটি প্রদেশ , তিনি নিজের জন্য যে আর ইউয়ে হোর ছদ্মনাম দিয়েছেন , তার অর্থ হলো ফেব্রুয়ারী মাসের হলুদ নদী , এই সময় হলুদ নদীর জমা বরফ গলতে শুরু করে , নদীর পানি নিম্ন অববাহিকার দিকে প্রবাহিত ।
আর ইউয়ে হো খুব দেরীতে সাহিত্য রচনা করতে শুরু করেন । ১৯৮৬ সালে তার বয়স যখন ৪০ বছর , তখন থেকে তিনি সাহিত্য রচনা করতে শুরু করেন। তার লেখা প্রথম উপন্যাস ' মহা রাজা খাং সি '-র মোট অক্ষর সংখ্যা ১৫ লক্ষ , এই উপন্যাসে আজ থেকে তিন শ' বছর আগের ছিং রাজবংশের রাজা খাং সির জীবন কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে । এই উপন্যাসের প্রকাশ চীনের সাহিত্য মহলে আলোড়ন সৃষ্টি করেছে , তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় উপন্যাসের প্রধান চরিত্রও ছিং রাজবংশের রাজা , তাদের নাম হলো ইয়োং চেং ও ছিয়েন লুং , চীনের পাঠকরা আর ইউয়ে হোর লেখা এই তিনটি বই পড়তে পছন্দ করেন , এই তিনটি উপন্যাসে আর ইইয়ে হো চীনের তিন শ' বছর আগেকার সামাজিক জীবন আর চীনের ছিং রাজবংশের রাজার খাংসি , ইয়োং চেং ও ছিয়েন লুং এই তিনজন রাজার শাসন আমলের এক শ' ৩০ বছরের ইতিহাস পাঠকদের সামনে তুলে ধরেছেন । এই তিনটে উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত , রাজপরিবারের জীবনের দ্বন্দ্ব ও প্রাচীনকালের যুদ্ধের বর্ণনা পাঠকদের আকৃষ্ট করে । চীনের টেলিভিশন কেন্দ্রে এই তিনটি উপন্যাসের ভিত্তিতে রচিত সিরিজ নাটক প্রচারিত হয়েছে ,বিদেশেও এই তিনটে সিরিজ নাটক আলোড়ন সৃষ্টি করেছে । আর ইউয়ে হোর এই তিনটে উপন্যাস প্রকাশিত হওয়ার পর পাঠকরা অল্প দিনের মধ্যেই সব বই শেষ করেন , দেশবিদেশের পাঠকদের চাহিদা মেটানোর জন্য এই তিনটি বই বার বার ছাপানো হয়েছে । সাহিত্য রচনা সম্বন্ধে আর ইউয়ে হো বলেছেন , সংস্কার ও উন্মুক্ততারনীতি লেখকদের জন্য এক অপেক্ষাকৃত শিথিল রাজনৈতিক পরিবেশ যুগিয়ে দিয়েছে , আমরা স্বাধীনভাবে বই লিখতে পারি , আমাকে কোনো নিষেধের কথা চিন্তা করতে হয় না । রাজপরিবারের জীবন বর্ণনার সময় আমি সংকোচ বোধ করি নি । উপন্যাস তিনটিতে আমি স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর জিনিস দিয়ে পাঠককে মুগ্ধ করার চেষ্টা করেছি , আসলে একটি উপন্যাসে লেখকের মন , রক্ত , চোখের পানি ও ঘাম আছে , পাঠকের সংখ্যা ও তাদের মূল্যায়নই একটি বইয়ের জীবন-শক্তির পরিচায়ক ।
আর ইউয়ে হোর বয়স যখন সোল-সতের বছর , তখন চীনে তথাকথিত সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলছিল , তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সুযোগ পান নি । তিনি কয়লা খনিতে কয়লা খনন করেছিলেন , বাড়ীঘর তৈরীর কাজ করেছিলেন , রাস্তা মেরামতের কাজ করেছিলেন এবং সৈন্যবাহিনীতে দশ বছর কাজ করেছিলেন । জীবনের কষ্টকর অভিজ্ঞতা তার মনোবল আরো দৃঢ করে তুলেছে । তিনি মনে মনে নিজেকে বার বার বলেন , আমাকে অবশ্যই একটা সার্থক কাজ করতে হবে। তিনি যে কোনো শারিরীক পরিশ্রম করেন , বই পড়া কখনো বন্ধ করেন নি । তিনি বিশেষভাবে চীনের ইতিহাস সম্পর্কিত বই পড়তে পছন্দ করেন। তা ছাড়া তিনি বিদেশের বিখ্যাত লেখকের বইগুলোও পড়েন। জীবনের নানা অভিজ্ঞতা তার মনে সাহিত্য রচনার ইচ্ছা সৃষ্টি করেছে , তিনি সাহিত্য রচনার মাধ্যমে জীবন ,পৃথিবী ও ইতিহাস সম্বন্ধে অন্য লোকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চান । প্রথম দিকে তিনি দিনের বেলায় কাজ করতেন , রাত্রে সাহিত্য রচনা করতেন । তিনি বলেছেন , প্রথম দিকে আমি দিনের বেলায় কাজ করতাম এবং রাত দুটা-তিনটা পর্যন্ত বই লিখতাম । প্রচন্ড শীতে ঘরে শরীর গরম করার ব্যবস্থা নেই , তবুও আমি সাহিত্য রচনা বন্ধ করি নি , গরমের সময় মশা বেশী , মশার কামড় প্রতিরোধের জন্য আমি পা দুটি পানির ভিতরে ভিজিয়ে লিখতাম ।
চীনের সাহিত্য মহলে আর ইউয়ে হোর পরিশ্রম সবাই জানেন । তাঁর তিনটে উপন্যাস তার পরিশ্রম ও নিরলস প্রচেষ্টার ফল । উপন্যাস ' ছিয়েন লুন রাজা ' লেখার সময় একদিন তিনি হঠাত অচেতন হয়ে মস্তিস্কের স্ট্রোকে আক্রান্ত হন , চিকিত্সকদের প্রচেষ্টার ফলে তিনি মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পান এবং এই উপন্যাস তিনি বিছানায় সম্পন্ন করেছেন ।
সাহিত্য রচনা ছাড়া আর ইউয়ে হো ডাক টিকিট সংগ্রহ করতে পছন্দ করেন । তার ডাক টিকিট সংগ্রহের ইতিহাস ৩০ বছরেরও বেশী । বই লেখার ফাঁকে ফাঁকে তিনি নিজের সংগ্রহ ডাক টিকিটের এলবাম বের করে সুন্দর ডাক টিকিট উপভোগ করেন , তার পক্ষে এটা সবচেয়ে ভালো বিশ্রাম ।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শারিরীক কারণে আর ইউয়ে হো আর উপন্যাস রচনা করেন নি , তিনি প্রচুর পরিমান ছোট প্রবন্ধ লিখেছেন ।
আর ইউয়ে হোর পারিবারিক জীবন সুখী , তার স্ত্রী ও মেয়ে তাকে খুব যত্ন করেন । নিজের জীবন সম্বন্ধে আর ইউয়ে হো বলেছেন , লেখকের পক্ষে স্বাভাবিক জীবন একান্ত প্রয়োজন । আমি অবসর সময় নিজে বন্ধুদের সঙ্গে দাবা ও তাস খেলি অথবা বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করি ।
আর ইউয়ে হো একজন ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখক হলেও তিনি বর্তমান চীনের সামাজিক সমস্যা সম্বন্ধে মনোযোগ দেন , গরীব অঞ্চলের স্কুল বয়সী ছেলেমেয়েরা যাতে স্কুলে পড়াশুনা করতে পারে , আর ইউয়ে হো একাধিক বার অর্থ অনুদান করেছেন , তার লক্ষ্য হলো তার অনুদান টাকা দিয়ে পাঁচটি আশা স্কুল প্রতিষ্ঠা করা ।
|