পেইচিং শহরের দু শো কিলোমিটার দক্ষিণপূর্বের থিয়েনচিন মহানগরের উপকন্ঠে একটি কোরীয় জাতির গ্রাম আছে যার নাম পাওইউয়ান গ্রাম। গ্রামটিতে রয়েছে ১৫টি কোরীয় জাতির পরিবার। তাঁদের পূর্বপুরুষদের বেশীর ভাগই শতাধিক বছর আগে কোরিয়া থেকে উত্তরপূর্ব চীনে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তার পর উত্তরপূর্ব চীন থেকে আবার থিয়েনচিন মহানগরে স্থানান্তরিত হয়েছেন। চলুন, এখন আমরা একসাথে এই কোরীয়জাতির গ্রামটিতে একবার ঘুরে আসি।
সে দিন ভোরবেলায় গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিলো। বৃষ্টি শেষ হলে আমরা থিয়েনচিন শিক্ষকপ্রশিক্ষণ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষারত দক্ষিণ কোরীয় ছাত্রী লি চিহুয়েনকের সঙ্গে নিয়ে থিয়েনচিন শহর থেকে উপকন্ঠের পাওইউয়ান গ্রামে গেলাম।
গ্রামটিতে প্রবেশ করতেই আমাদের নজরে পড়লো একটি কোরিয় জাতির বাড়ী। কোরীয় জাতির বৃদ্ধা গৃহিনী পিয়াও উকচি আমাদের সাদর সম্বর্ধনা জানিয়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। আর আমাদের সফরসংগী দক্ষিণ কোরীয় ছাত্রী লি চিহুয়েন আর গৃহীনী পিয়াও আপনাআপনিই তাদের মাতৃভাষায় আপনলোকের মতো আলাপ শুরু করলেন, এমনকি আমাদের উপস্থিতিকেও ভুলে গেলেন।
বৃদ্ধা পিয়াও বলেছেন, তাঁর বয়স সত্তর বছর, দীর্ঘকাল ধরে এই গ্রামে বসবাস করছেন। শতাধিক বছর আগে তার পূর্বপুরুষরা দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউল থেকে এসেছেন উত্তরপূর্ব চীনে । সেখানেই বৃদ্ধা পিয়াওয়ের জন্ম। পরে তাদের পরিবার আবার উত্তরপূর্ব চীন থেকে থিয়েনচিনে স্থানান্তরিত হয়েছে।
জন্ম থেকেই তিনি চীনে সত্তর বছর কাটিয়েছেন, তবুও তার পূর্বপুরুষদের জন্মভূমির কথা বৃদ্ধা পিয়াওয়ের মনে খুব পড়ছে। গত বছর শরত্কালে তিনি আর তাঁর স্বামী অবশেষে পূর্বপুরুষদের সেই প্রিয় জন্মভূমি-দক্ষিণ কোরিয়ার সিউলশহরে ফিরে গিয়েছিলেন।
দক্ষিণ কোরিয়া হলো আমাদের পূর্ব জন্মভূমি, যার কথা আমাদের খুব মনে পড়ে। আমার বয়স এতো বেশি হয়েছে, তাই একবার ওখানে বেড়াতে যেতে পেরে সত্যি সত্যিই খুব খুশী হয়েছি। দক্ষিণ কোরিয়ার দৃশ্য মনোরম, বিভিন্ন দিক থেকে বেশ ভালো, ওখানে আমরা আধা মাস থেকেছি।
সেখান থেকে তাদের পূর্বপুরুষের সপরিবার চীনে স্থানান্তারিত হবার কারণ প্রসংগে তিনি বলেছেন, তাঁর বাবার কথা অনুযায়ী তাঁর দাদা বলেছিলেন, সেই সময় তাঁর পরিবারের অবস্থা খুবই কষ্টকর ছিলো, দাদা শুনেছিলেন, উত্তরপূর্ব চীনে জীবিকা উপার্জন করা খুব সহজ। তাই সিউল থেকে উত্তরপূর্ব চীনে আসেন, কিন্তু সেখানে তাদের জীবনযাত্রার তেমন উন্নতি হয় নি।১৯৪৯ সালে নয়াচীন প্রতিষ্ঠার পর বিশেষ করে গত ২০ বছরে তাদের পরিবারের অবস্থার ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে।
বৃদ্ধা পিয়াও তার ঘরের বেশ কিছু বৈদ্যুতিক সমাগ্রি দেখিয়ে বললেন,
এখন জীবনযাত্রার বিভিন্ন দিক আগের চেয়ে অনেক ভাল হয়েছে। খাবার আগের চেয়ে অনেক ভাল। আগে আমরা কোরীয় জাতির লোকেরা সাধারনত চাটনি, আচার, নানা তরকারি আর ভাত খেতাম। এখন নানা রকম সুস্বাদু খাবার যা খুশী খেতে পারি এবং ভালো ভালো পোষাক পরি।
বৃদ্ধা পিয়াওয়ের এক ছেলে, এক মেয়ে আর তিনটি নানী। তাঁর ছেলে একটি কারখানা স্থাপন করে চালাচ্ছেন, একজন নানী দক্ষিণ কোরিয়ারয় গেছেন। সেখান থেকে ঐ নানী প্রায়ই টেলিফোন করে তাদের সংগে আলাপ করে।
বৃদ্ধা পিয়াওয়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমরা আর এক ঘরে গেলাম। সেটি পাওইউয়ান গ্রামের এক নতুন পরিবার। গৃহকর্তা পিয়াও মিংজান মাত্র দশ বছর আগে উত্তরপূর্ব চীন থেকে এখানে স্থানান্তরিত হয়ে এসেছেন। পিয়াও মিনজান এখানে আসার সময়ে সংগে নিয়ে এসেছেন দুটো মস্ত মোটা ভল্লুক, তাতে গ্রামটিতে বিরাট আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। জিংসেন আর হরিণের কচি সিংয়ের মতো ভল্লুকের পিওকোষও উত্তরপূর্ব চীনের তিনটি অমূল্য দ্রব্যের অন্যতম। ভল্লুকের পিত্ত এক রকম দামী চীনা ওষুধ, দক্ষিণ কোরিয়ার লোকেরা তা খুব পছন্দ করে। এই কয়েক বছরে থিয়েনচিন মহানগরের বেশ কিছু দক্ষিণকোরীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মালিক তাঁর এখানে ভল্লুকের পিত্ত কিনতে আসেন। এই সব দক্ষিণ কোরীয় শিল্পপতির একজন তাঁকে দক্ষিণ কোরিয়ায় ভ্রমণ করতে আমন্ত্রণ করেছিলেন। পিয়াওমিংজান বলেছেন, আমি ইতিম্যেই নয় বছর ধরে ভল্লুক পুষেছি। তাতে বছরে আমার আয় হয় ৩০ হাজার ইউয়ান। এই অর্থে আমাদের স্বামীস্ত্রীর সংসার বেশ ভালোউ চলতে পারে।
থিয়েচিন মহানগরে পিয়াও মিংজানের ছেলেমেয়ে আর নানী আছে। ছেলেমেয়ে দক্ষিণ কোরীয় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে কাজ করে, নানী তাদের গ্রামের কোরীয় ভাষার প্রাথমিক স্কুলে পড়ছে।
পিয়াও মিংজানের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার সময়ে তিনি আর তাঁর স্ত্রী আমাদের জন্যে একটি কোরীয় গান গেয়েছেন।
গানটির অর্থ এই: পূর্বপুরুষদের জন্মভূমি থেকে চলে এলেএ সেই জন্মভূমির কথা সবসময়েই মনে পড়ে, তবে নতুন জায়গায় অভ্যস্ত হতে পারলেই জায়গাটা নিজেদের জন্মভূমি হয়ে যায়।
|